কুষ্ঠমুক্ত দেশ কেন দরকার

প্রকাশ | ২৯ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
আজ ২৯ জানুয়ারি বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস পালিত হচ্ছে। প্রথা অনুযায়ী প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের শেষ রোববার বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস হিসাবে পালন করা হয়। এই দিবসের উদ্দেশ্য হলো কুষ্ঠমুক্ত বিশ্ব গড়ার লক্ষ্যে এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা এবং এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করা। জনবিচ্ছিন্ন কুষ্ঠ আক্রান্ত ব্যক্তিদের সমাজে পুনঃগ্রহণ, সর্বপ্রকার কুষ্ঠজনিত কুসংস্কার দূরীকরণ- এই সব লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে জনসাধারণ এবং কুষ্ঠ আক্রান্ত ব্যক্তিদের সঠিক তথ্য ও শিক্ষা প্রদান করাই হচ্ছে এই দিবসের লক্ষ্য। কুষ্ঠ একটি স্বাস্থ্যগত সমস্যা হলেও এটাকে ঘিরে কুসংস্কারের কারণে আক্রান্ত ব্যক্তিরা এমনকি তাদের আত্মীয়-স্বজনরা বৈষম্যের শিকার হয়, এর ফলে বড় ধরনের এক সামাজিক সমস্যার উদ্ভব ঘটে। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তিরা পরিবারের জন্য বোঝা হয়ে যায় এবং তারা পারিবারের জন্য কোনো উপার্জনমূলক কাজ করতে পারেন না। এই কারণে কুষ্ঠকে ঘিরে আর্থিক একটি প্রভাবও রয়েছে। বাংলাদেশে এই দিবস উপলক্ষে কুষ্ঠ আক্রান্ত ব্যক্তিরা ও কুষ্ঠ নিয়ে কর্মরত প্রতিষ্ঠানগুলো কুষ্ঠরোগ ও আক্রান্ত ব্যক্তিদের অধিকারের বিষয়ে সচেতনতার জন্য নানান অনুষ্ঠান (যেমন আলোচনা সভা,র্ যালি) আয়োজন করে থাকে। সরকারের তরফ থেকেও এই বিষয়ে নানান আয়োজন থাকে। এই বছর এই দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে 'এখনি কাজ শুরু করি। কুষ্ঠ রোগ নির্মূল করি'। কুষ্ঠ দূরীকরণে বিশ্বের দেশগুলোকে ক্ষমতায়ন করা ও প্রকৃত প্রতিশ্রম্নতির জন্য উৎসাহ প্রদান করার বিষয়টিকে এই বছরের প্রতিপাদ্যে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এই বছরের প্রচারাভিযানে সরকার, নীতিনির্ধারক, দাতাগোষ্ঠীগুলো এবং বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সম্প্রদায়কে কুষ্ঠমুক্ত বিশ্ব অর্জনের জন্য কুষ্ঠ দূরীকরণ প্রচেষ্টাকে অধিকতর গুরুত্ব প্রদানের জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা'র মতে, এই বছরের প্রতিপাদ্যতে তিনটি মূল বিষয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করা হয়েছে। কুষ্ঠ দূরীকরণ সম্ভব : কুষ্ঠ সংক্রমণ বন্ধে এবং এই রোগকে পরাজিত করতে আমাদের ক্ষমতা ও টুল রয়েছে। এখনই সক্রিয় হওয়া দরকার : কুষ্ঠ সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের দরকার সম্পদ ও প্রতিশ্রম্নতি। কুষ্ঠ দূরীকরণকে অধিক গুরুত্ব প্রদান করা দরকার। যাদের পৌঁছানো যায় না তাদের কাছে পৌঁছানো : কুষ্ঠ প্রতিরোধযোগ্য ও চিকিৎসাযোগ্য। কুষ্ঠের কারণে দুর্ভোগের প্রয়োজন নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা'র তথ্যমতে, প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ২১০,০০০ নারী, পুরুষ ও শিশু এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে বলে চিহ্নিত হয়। তাদের মধ্যে প্রায় ৫০% মানসিক সমস্যায় পতিত হয়, এবং আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও লক্ষ্য করা যায়। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যেমন- এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকাতে অনেকেই রয়েছেন যারা এই রোগের কারণে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। সুইজারল্যান্ড-ভিত্তিক কুষ্ঠ-বিরোধী সংগঠনগুলোর আন্তর্জাতিক ফেডারেশন 'আইলেপ', যা ১৩টি আন্তর্জাতিক এনজিওর সমন্বয়ে গঠিত, এই দিবসটি পালনে উদ্যোগ নেয়। আইলেপের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রাউল ফোলেরো বিশ্বব্যাপী কুষ্ঠরোগ বিষয়ক ব্যাপক সচেতনতা বৃদ্ধিকল্পে ও কুষ্ঠরোগের প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ১৯৫৪ সালে দিবসটি উদযাপনের জন্য উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কুষ্ঠ মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন রোগ। মানব সভ্যতার বিকাশ ও সামাজিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে উন্নত দেশগুলোতে এই রোগের প্রাদুর্ভাব একবারেই কমে এসেছে। কিন্তু আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কুষ্ঠরোগের প্রাদুর্ভাব এখনো রয়ে গেছে। বর্তমানে বাংলাদেশসহ ব্রাজিল, ভারত, নেপাল, মোজাম্বিক, অ্যাঙ্গোলা, কঙ্গো এবং তানজানিয়ায় কুষ্ঠরোগাক্রান্ত ব্যক্তিরা শনাক্ত হচ্ছে বলে জানা গেছে। ১৮৭৩ সালে নরওয়ের চিকিৎসা বিজ্ঞানী ডা. আরমার হ্যানসেন কুষ্ঠরোগের জীবাণু 'মাইকোব্যাকটেরিয়াম লেপ্রি' আবিষ্কার করেন। এই আবিষ্কারের ফলে প্রমাণিত হয়, কুষ্ঠ একটি ব্যাকটেরিয়া জনিত রোগ, জন্মগত, বংশগত বা অভিশাপের ফল নয়। হাজার হাজার বছর ধরে কুষ্ঠরোগ ও কুষ্ঠরোগাক্রান্ত ব্যক্তিগণকে অভিশপ্ত এবং অস্পৃশ্য বলে গণ্য করা হতো এবং অনেককেই দীপান্তরিত, বনবাস, গৃহচু্যত করা হতো। সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্কগুলো শিথিল হয়ে যেত। হাজার হাজার কুষ্ঠরোগাক্রান্ত মানুষ মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হতো। চিকিৎসকদের মতে, কুষ্ঠরোগ একটি মৃদু সংক্রামক রোগ। দুর্বল প্রতিরোধ ক্ষমতার অধিকারী মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়। দরিদ্রতা, অপুষ্টি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস, প্রচুর আলো-বাতাসের অভাব ইত্যাদি এই রোগ সংক্রমণের অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়। কুষ্ঠ সাধারণত আক্রান্ত রোগীর প্রান্তিক স্নায়ুর কার্যকারিতা নষ্ট করে। ফলে আঙুল বাঁকা হওয়া, মুখের প্যারালাইসিস, বেদনাহীন ঘা ইত্যাদি বিকলাঙ্গতা দেখা দেয় এবং রোগীর শারীরিক সমস্যার চেয়েও মানসিক ও সামাজিক সমস্যা ও বৈষম্য প্রকটরূপে দেখা দেয়। চামড়ার অবশ দাগ দিয়ে এই রোগ শুরু হয়, অনেক সময় দানা গুটিও দেখা দেয়। কুষ্ঠরোগ প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত হলে ও চিকিৎসার আওতায় এলে কুষ্ঠজনিত প্রতিবন্ধিতা প্রতিরোধ করা সম্ভব। ব্যাপক সচেতনতা কার্যক্রম এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গুরুত্বের বিষয় হলেও বিভিন্ন কারণে কুষ্ঠ বিষয়টি বাংলাদেশে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। করোনাকালীন সময়ে এটি আরও গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। বাংলাদেশে কুষ্ঠরোগের চিকিৎসা বিনামূল্যে করা হলেও এবং নিয়মিত চিকিৎসায় সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য রোগ হওয়া সত্ত্বেও এখনো রোগটি জনস্বাস্থ্য সমস্যারূপে রয়ে গেছে। দ্য লেপ্রসি মিশন ইন্টারন্যাশনাল-বাংলাদেশের (টিএলএমআই-বি) মতে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রতি বছর প্রায় ৩৫০০ থেকে ৪০০০ নতুন কুষ্ঠরোগাক্রান্ত ব্যক্তি বাংলাদেশে শনাক্ত হচ্ছে। এদের মধ্যে প্রায় ৮-১০% সময়মতো চিকিৎসার অভাবে পরবর্তীতে পঙ্গু হয়ে যায়। এর ফলে এক দুর্বিসহ জীবনের সূত্রপাত হয়। বাংলাদেশ কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণে তার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, তবে এই ক্ষেত্রে বেশকিছু সমস্যা রয়েছে। কম গুরুত্ব দেওয়ার কারণে এই খাতে বাজেট প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম, বাজেট স্বল্পতার কারণে কুষ্ঠবিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তি ও প্রতিবন্ধীরা দেশের বোঝা নয়, তাদেরও রয়েছে সব নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার। আমাদের জাতীয় সংবিধানে প্রতিটি নাগরিকের সমান সুবিধা নিশ্চিত করে। তাই কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়। আসুন আক্রান্ত ব্যক্তিদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাই একত্রে কাজ করি এবং ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে একটি কুষ্ঠমুক্ত দেশ হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে প্রতিষ্ঠা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হই। মো. সাজেদুল ইসলাম ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক