বাংলাদেশে রাজনীতির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

এ দেশের কোনো নাগরিক কখনোই চায় না তারা আবার পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে যাক। কোনো বিদেশি শক্তি এ দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করুক। প্রতিটি নাগরিকের প্রত্যাশা, এ দেশে যেন আবার এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি না হয় যেখানে আমাদের বন্দি হতে হয় সামরিক সরকারের কারাগারে।

প্রকাশ | ৩১ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

শাহাজালাল সজিব
স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলেও বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থান করছে চরম রাজনৈতিক সংকট। যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম দুর্ভাগ্যবশত আজ সে গণতন্ত্র অনুপস্থিত। আমাদের অতি কাছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন- যা অনুষ্ঠিত হবে ডিসেম্বর-২০২৩ কিংবা ২০২৪-এর জানুয়ারিতে। ইতোমধ্যেই নির্বাচনকে সামনে রেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় তৎপর হয়ে উঠেছে দেশের ছোট বড় সব রাজনৈতিক দল। দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ ছোট বড় সব দল জানান দিচ্ছে নির্বাচন নিয়ে তাদের অবস্থান। বিশেষ করে বিএনপি গত বছর থেকে যে অহিংস বিভাগীয় সম্মেলন এবং পরবর্তী সময়ে ঢাকাসহ সারাদেশে গণমিছিল ও গণঅবস্থান পালন করে আসছে নিঃসন্দেহে তা বাংলাদেশের আগামী দিনের রাজনীতির জন্য খুবই ইতিবাচক সংকট বহন করে। বাংলাদেশ বিশ্বমানচিত্রে ভৌগোলিক এবং কৌশলগত কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান করায় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিরোধী দলগুলোর পাশাপাশি তৎপর হয়ে উঠেছে বিদেশি রাষ্ট্রগুলো। ইতোমধ্যেই আমরা এর প্রমাণও পেয়েছি। ছোট থেকে বড় সব রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দেওয়ার জন্য পশ্চিমা দেশগুলো প্রতিনিয়ত সরকারকে চাপ প্রয়োগ করছে। পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে আরো যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম বন্ধু রাষ্ট্র 'জাপান'। ইতোমধ্যেই জাপান বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। জাপানের সাবেক রাষ্ট্রদূত 'ইতি নাওকির' ঢাকায় 'মিট দ্য অ্যাম্বাসাডরস' অনুষ্ঠানে বলেন, 'গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আগের রাতেই পুলিশ ব্যালট বাক্স ভর্তি করেছিল। অন্য কোনো দেশে এমন দৃষ্টান্ত নেই। আমি আশা করব, এবার তেমন সুযোগ থাকবে না বা এমন ঘটনা ঘটবে না।' বিশ্ব রাজনীতির মোড়ল হিসেবে খ্যাত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও আসন্ন নির্বাচন নিয়ে অনেক আগে থেকেই সরব দেখা যাচ্ছে। জানিয়েছেন নির্বাচন নিয়ে তাদের অবস্থান, মানবাধিকারের প্রশ্নে এক চুলও ছাড় নয়। ইতোমধ্যেই বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে নিষেধাজ্ঞা পেয়েছে বাংলাদেশর্ যাব পুলিশের উচ্চপদস্থ কয়েকজন কর্মকর্তা। পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়েছে গত কিছু দিন আগে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের গাড়িতে আওয়ামী পন্থী 'মায়ের কান্না' নামক এক সংগঠনের হামলার মধ্য দিয়ে। এ বিষয়ে খোদ বাইডেন প্রশাসন সরাসরি প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে এবং ঘটনাটিকে অনাকাঙ্ক্ষিত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ের রাশিয়াও যুক্ত হয়েছে এ বিষয়ের সঙ্গে। রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র 'মারিয়া জাখারোভা' তার এক বক্তব্যে বাংলাদেশের মার্কিন কর্মকান্ডের বিরোধিতাপূর্বক বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হস্তক্ষেপ বলে অভিহিত করেন। বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত এ দৌড়ে সবচেয়ে বেশি অগ্রসর। মোদি সরকার বরাবরের মতোই হাসিনা সরকারকে সহায়তা করার কথা জানিয়ে আসছে। বাংলাদেশের অন্যতম বাণিজ্যিক বন্ধু রাষ্ট্র 'চীন' নির্বাচন বিষয়ে স্পষ্ট করে বেশি কিছু না বললেও তারা যে বর্তমান সরকারকে পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছে এবং দেবে তা অনুমেয়। তবে আগামী দিনগুলোতে হাসিনা সরকারের সঙ্গে চীন ও ভারতের সম্পর্ক কেমন হবে তা অনেকটাই নির্ভর করবে বাংলাদেশের বহুল আলোচিত তিস্তা প্রকল্পের ওপর। এখনো পর্যন্ত সরকার এ বিষয়টিকে খুবই সতর্কতার সঙ্গে মোকাবিলা করে আসছে। বাংলাদেশ ভৌগোলিক কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ বিষয়টি সরকার গঠনে আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভের সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। সম্প্রতি একাধিক ক্ষমতাধর দেশের উচ্চপদস্থ কূটনীতিবিদদের বাংলাদেশ সফর এই বিষয়টিকে অনেকটা জটিল করে তুলেছে। ২০০৭ সালে জাপানের নেতৃত্বে জাপান, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা এ চারটি দেশের সমন্বয়ে গঠিত হয় সামরিক জোট 'কোয়ার্ড'। জোটটির মূল উদ্দেশ্য হলো চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি ও সামরিক অগ্রযাত্রার প্রতিরোধ করা। কোয়ার্ড ভুক্ত দেশগুলো চায় যত দ্রম্নত সম্ভব বাংলাদেশ জোটে অংশগ্রহণ করুক। তারা বাংলাদেশকে সামরিক ও অর্থনৈতিকসহ সব ক্ষেত্রে পূর্ণ সহায়তা প্রদানের আশ্বাস দিয়েছে। অন্যদিকে চীন বাংলাদেশকে তাদের 'বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ' প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য মরিয়া হয়ে আছে। চীন সরকার বাংলাদেশকে অধিকতর সহায়তার আশ্বাস জানিয়েছে। এ বিষয়ে সরকার বর্তমানে খুবই বিপাকের আছে, যদিও এখনো পর্যন্ত 'সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রম্নতা নয়' এই নীতি অবলম্বন করে আসছে। শেখ হাসিনা সরকার ইতোমধ্যেই বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে চীনের কাছ থেকে বিপুল অংকের ঋণ নিয়ে তাদের কাছে জিম্মি, অন্যদিকে, কোয়ার্ডভুক্ত দেশগুলো ক্রমবর্ধমান চাপ অব্যাহত রেখেছে। এই অবস্থাতেই দেখা দিয়েছে রিজার্ভে ডলার সংকট। এর থেকেই আমরা অনুমান করতে পারি, আগামী জাতীয় নির্বাচনে বৈশ্বিক ক্ষমতাধর দেশগুলোর বড় একটি প্রভাব থাকবে। একদিকে আন্তর্জাতিক চাপ অন্যদিকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর লাগাতার সরকারবিরোধী আন্দোলন এবং কর্মসূচি সব মিলিয়ে বর্তমান সরকার খুবই সংকটপূর্ণ একটি জায়গা অবস্থান করছে। সরকারের সব পর্যায়ে থেকে এখনো পর্যন্ত সবকিছু কৌশলে মোকাবিলা করে এলেও আর কতদিন পর্যন্ত তা সম্ভব হবে এটি এখন ভাবার বিষয়। বর্তমানে সরকারের সৎ এবং সঠিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে কেমন হবে বাংলাদেশের আগামী দিনগুলোর রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি এবং পররাষ্ট্রনীতি। আমরা যদি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেই তাহলে দেখতে পাই পৃথিবীর কোনো শাসকই জনগণের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে চিরদিন ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। এ দেশের জনগণ পরপর দুই নির্বাচনে তাদের অধিকার হারানোর পর এখন তারা আগামী নির্বাচনে তাদের অধিকার আদায়ে খুবই সোচ্চার। শত বাধাবিপত্তি পেরিয়ে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীরা রাজপথে জানান দিচ্ছে তাদের উপস্থিতি। এমনকি অন্যায়ভাবে পুলিশের গুলিতে অনেককে প্রাণ হারাতে হয়েছে। ১৯৭১ সালে মানুষ তাদের রক্ত দিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছিল তাদের মুক্তির জন্য, তাদের অধিকার আদায়ের জন্য, এ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। এ দেশের মালিক একমাত্র জনগণ, জনগণের সরকার নির্বাচনের দায়িত্ব থাকবে শুধু জনগণের হাতে। জনগণ তাদের চুরি হয়ে যাওয়া ভোটের অধিকার চায়। দিনের ভোট রাতে নয়, দিনের ভোট দিনে দিয়ে সরকার নির্বাচিত করতে চায়। জনসাধারণের প্রত্যাশা এমন এক সরকার যে প্রকৃতপক্ষে দেশকে ভালোবাসবে, দেশের মানুষকে ভালোবাসবে এবং মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে কাজ করবে। এ দেশের কোনো নাগরিক কখনোই চায় না তারা আবার পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে যাক। কোনো বিদেশি শক্তি এ দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করুক। প্রতিটি নাগরিকের প্রত্যাশা, এ দেশে যেন আবার এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি না হয় যেখানে আমাদের বন্দি হতে হয় সামরিক সরকারের কারাগারে। শাহাজালাল সজিব : কলাম লেখক