সড়ক-মহাসড়কে বিশৃঙ্খলা: দায় কার

আমরা সাধারণ মানুষ, পথচারী কেউ পথের বলি হতে চাই না। প্রতিটি মৃত্যুর দায়ভার সরকার কিংবা গণপরিবহন মালিক শ্রমিকদের নেয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলে দুঘর্টনার সংখ্যা কমবে। কিন্তু দায়ভার কেউ নিতে চায় না।

প্রকাশ | ১৯ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

মোহাম্মদ নজাবত আলী
গত ২৯ জুলাই রাজধানীতে সড়কে দুজন কলেজশিক্ষাথীর্ বাসচাপায় নিহত হওয়ার পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নামে কোমলমতি শিক্ষাথীর্রা। সরকারি সংস্থাগুলো সে সময় বলেছিল, শিশুদের এ আন্দোলন তাদের চোখ খুলে দিয়েছে। সড়কপথে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে নেয়া হয় নানা উদ্যোগ, পরিকল্পনা, প্রতিশ্রæতিও। তবে অপ্রিয় হলেও সত্য যে, চোখ খুলে দেয়ার পরও সড়কপথে থামছে না মৃত্যুর মিছিল। সড়ক দুঘর্টনা আমাদের জাতীয় জীবনে একটি বড় সমস্যা। এ সমস্যাকে কোনোভাবেই ছোট করে দেখার অবকাশ নেই, বরং সড়ক দুঘর্টনা রোধ জাতীয় দাবি হওয়া উচিত। কারণ যেভাবে সড়ক দুঘর্টনা ঘটছে, প্রতিনিয়ত মানুষের প্রাণ ঝরে যাচ্ছে, তাতে যেন জীবনের কোনো মূল্য নেই। পত্রিকার পাতা খুললেই দুঘর্টনার খবর আমাদের চোখে পড়ে। অবস্থা এমন দঁাড়িয়েছে যে, ঘর থেকে বাইরে গিয়ে সুস্থ অবস্থায় ঘরে ফেরা যাবে এমন নিশ্চয়তা নেই। তাই অপ্রিয় হলেও সত্য যে, সড়ক দুঘর্টনা শত শত মানুষের করুণ মৃত্যু, সুস্থ বিবেকবান মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। তাই মানুষ এখন কোথাও নিরাপদ বোধ করতে পারছে না। ঘর থেকে বেরুলেই সুস্থভাবে যে আবার ঘরে ফিরে আসবে এ নিশ্চয়তা নেই। সড়ক দুঘর্টনায় প্রাণ হারাচ্ছে সাধারণ জনগণ, পথচারী থেকে শুরু করে বিদ্যালয়গামী শিশু, কিশোরসহ সমাজের সবর্স্তরের মানুষ। ভয়াবহ সড়ক দুঘর্টনায় সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, ব্যবসায়ী, জাতীয় সংসদ সদস্যসহ অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন। আমাদের দেশে সড়ক দুঘর্টনায় এককভাবে কাউকে দায়ী করা সঙ্গত হবে না। কারণ দুঘর্টনার অনেক কারণ রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, চালকদের অসাবধানতা, অদক্ষতা, ত্রæটিপূণর্ যানবাহন, দুঃসাহসিকতার প্রমাণ ঘটনার চেষ্টা, ওভারটেকিং, ছোট যানবাহনের সংখ্যাধিক্য, সড়কের দুপাশ্বের্ অবৈধ হাটবাজার, ট্রাফিক আইন সম্পকের্ অজ্ঞতা, অতিরিক্ত মাল ও যাত্রী বোঝাই, লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ চালক ইত্যাদি। তবে সড়ক দুঘর্টনার মূল কারণ চালকের অসাবধানতা ও বেপরোয়া গাড়ি চালানো, অতিরিক্ত যাত্রী, চলন্ত বাসে চালকের মুঠোফোন ব্যবহারের প্রবণতা। তা ছাড়া একজন চালকের অবৈধ লাইসেন্সের ব্যাপারও জড়িত। বেশির ভাগ চালকের বৈধ লাইসেন্স নেই। এক প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, বতর্মান দেশের ৬১ শতাংশ চালক পরীক্ষা না দিয়ে লাইসেন্স পাচ্ছেন। আবার ১৬ লাখ চালকের কোনো বৈধ লাইসেন্স নেই। আমাদের দেশটা এমন হয়েছে যে, টাকার জোরে অনেক কিছু অসাধ্য সাধন করা যায়। যাদের সাবধানতা দক্ষতার ওপরে অনেক যাত্রীর প্রাণ রক্ষা পাওয়ার কথা, অথচ তাদের কোনো বৈধ লাইসেন্স ও দক্ষতা নেই। এসব অদক্ষ চালকের দ্বারা তো দুঘর্টনা ঘটতেই পারে। হচ্ছেও তাই। এসব লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ চালকের অসাবধানতার জন্য কত মানুষের যে জীবন প্রদীপ নিভে যাচ্ছে, তার কোনো হিসেব নেই। কত পরিবারে নেমে আসছে অবণর্নীয় দুঃখ কষ্ট জ্বালা যন্ত্রণা। বাংলাদেশে সড়ক দুঘর্টনা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক বেশি। দেশের রাস্তাগুলো ক্রমান্বয়ে উন্নত হচ্ছে কিন্তু সড়কপথে মৃত্যু থামানো যাচ্ছে না। দুঘর্টনা যেন আমাদের পিছু ছাড়ছে না। তাহলে আমাদের নিরাপত্তা কোথায়। স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি কোথায়। আমাদের মনে হয় সড়ক দুঘর্টনা নিয়ে সিরিয়াসলি কেউ ভাবেন না। অনেকে দুঘর্টনাকে দুঘর্টনা বলতে চান। তাদের যুক্তি এতে কারো হাত নেই। এ কথার পেছনে হয়তো যুক্তি থাকতে পারে। কিন্তু সাবধানতা সতকর্তা বলে তো শব্দ আছে। আমরা আমাদের যাপিত জীবনে যদি একটু সাবধান হই, একটু সতকর্ হই, তাহলে অনেক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। আমাদের বিভিন্ন ধরনের যান চালকরা যদি একটু সতকর্ হয়ে গাড়ি চালান তাহলে দুঘর্টনা কমবে। কিন্তু দেখা যায়, অধিকাংশ চালক এ সতকর্তা বা সাবধানতা অবলম্বন করে না। ওভারটেক বা দ্রæতগতিতে গাড়ি চালাতে গিয়ে দুঘর্টনায় পতিত হয় এবং বহু মানুষের মৃত্যু ঘটে। এসব দুঘর্টনার দায়ভার তো কেউ নিতে চায় না। না সরকার, না চালক, না মালিকপক্ষ। সামাজিক বিভিন্ন সংগঠন জোরালো কোনো প্রতিবাদ করে না। প্রতি বছর সড়ক দুঘর্টনায় প্রাণহানির ঘটনা একেবারে কম নয়, বরং রাজনৈতিক সহিংসতার চেয়েও বেশি। কিন্তু সড়ক দুঘর্টনার কোনো সুষ্ঠু বিচার হয় না। অপরাধী বা দোষীদের বিরুদ্ধে আইনের প্রয়োগ দৃশ্যমান নয়। উপরন্তু শাস্তির বিধান লঘু করা হয়েছে। তবে যেটুকু আইন রয়েছে, তা যদি প্রায়োগিক দিক থেকে দৃশ্যমান না হয় তাহলে কিভাবে সড়ক দুঘর্টনা কমবে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারে যে চরম দুভোর্গ নেমে আসে তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন? বিশেষ করে যারা দুঘর্টনার জন্য দায়ী। সড়ক দুঘর্টনায় আর কত লাশ দেখতে হবে। আমরা পথচারী সাধারণ মানুষ যেন অসহায়। আমাদের কিছু করার নেই। আমাদের আর কতকাল দুঃসহ মৃত্যু যন্ত্রণা ও দুঘর্টনায় মৃত্যুর বীভৎস দৃশ্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেখতে হবে, স্বজনদের আহাজারি শুনতে হবে। তবে সড়ক দুঘর্টনায় যে শুধু পরিবারই ক্ষতিগ্রস্ত হয় তা নয়, রাষ্ট্রও আথির্ক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অ্যাকসিডেন্ট রিসাসর্ ইনস্টিটিউটের হিসেব মতে, প্রতি বছর সড়ক দুঘর্টনায় ১ হাজার কোটি টাকার সম্পদ ক্ষতি হয়। এর মধ্যে যানবাহন ও অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। আথির্ক ক্ষতি মোট জিডিপির শতকরা ২ ভাগ। অপরদিকে দেশের স্বাস্থ্যখাতে মোট বরাদ্দের ৩০ শতাংশ খরচ হয় দুঘর্টনার শিকার হওয়া ব্যক্তিদের চিকিৎসায়। তাহলে আমরা দেখছি, সড়ক দুঘর্টনায় ক্ষতির পরিমাণ বহুমাত্রিক। একদিকে দুঘর্টনায় পতিত পরিবার, রাষ্ট্রের অথর্ অপচয়, অপরদিকে যানবাহন। কিন্তু সরকার বা সংশ্লিষ্ট কতৃর্পক্ষ দুঘর্টনা রোধে তেমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করে না। এটা হতে পারে শ্রমিক-মালিকদের স্বাথের্র কাছে পথচারী বা সাধারণ জনগণের স্বাথর্ গৌণ। এ কারণেই কি শাস্তির বিধান লঘু করা হয়েছে? বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ঘনবসতিপূণর্ অঞ্চল। প্রতি বগর্ কিলোমিটারে ৯৯৩ জন লোকের বসবাস। জনসংখ্যাও অধিক প্রায় ১৬ কোটি। ১৬ কোটি লোকের এ দেশে রাস্তা ঘাটে প্রচুর যানবাহন চলাচল করে। কিন্তু প্রচুর যানবাহনের মধ্যে সব যানবাহন যে, চলার উপযোগী তা নয়, অনেক ত্রæটিপূণর্ যানবাহন রয়েছে, আবার অদক্ষ চালকও রয়েছে। এসব যান ও চালকের দ্বারা দুঘর্টনা ঘটা স্বাভাবিক ব্যাপার। কাজেই সড়কপথে যানবাহন চলার ক্ষেত্রে সুস্থ নিয়ম নীতিমালা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। চালকদের কোনো জবাবদিহিতা নেই। ফলে অহরহ দুঘর্টনা ঘটছে এবং তাতে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৫ হাজার ছোট বড় সড়ক দুঘর্টনা ঘটে। আবার সড়ক পরিবহন কতৃর্পক্ষ বা বিআরটিএ এর হিসেব মতে প্রতিদিন সারাদেশে সড়ক দুঘর্টনায় প্রাণ হারান প্রায় ৩০ জন। সে হিসেব মতে বছরে নিহতের সংখ্যা দঁাড়ায় ১০ হাজার ৮০০ জন। আবার বিশ্বব্যাংকের হিসেবে বছরে ১২ হাজার, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রেকডর্ অনুযায়ী ২০ হাজার মানুষ সড়ক দুঘর্টনায় মারা যায়। অন্যদিকে বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসাসর্ ইনস্টিটিউট (এআরআই) এবং নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সড়ক দুঘর্টনায় প্রতি বছর ১২ হাজার মানুষ নিহত হন। বিভিন্ন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যানে নিহতের সংখ্যা কিছু তারতম্য থাকলেও বছরে ১০-১২ হাজার মানুষ শুধু সড়ক দুঘর্টনায় মারা যাওয়ার খতিয়ান আমাদের পিলে চমকে দেয়ার মতো। এতো মানুষ শুধু সড়ক দুঘর্টনায় মৃত্যু হচ্ছে অথচ প্রশাসন বা চালকদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। আমরা জানি, পৃথিবীর সব দেশে সড়ক দুঘর্টনা ঘটে। কিন্তু বাংলাদেশ এ দুঘর্টনা ও মৃত্যুর সংখ্যা অনেক। পৃথিবীর উন্নত বা সাধারণ রাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশে দুঘর্টনায় দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ বা শাস্তির বিধান দৃশ্যমান নয় বিশেষ করে সড়ক দুঘর্টনার ক্ষেত্রে। অথচ পৃথিবীর সব রাষ্ট্রে আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে সড়ক দুঘর্টনা রোধে কোনো কঠোর আইন নেই। আবার তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও তার রিপোটর্ অধিকাংশ ক্ষেত্রে আলোর মুখ দেখে না। ফলে চালকরাও বেপরোয়া। প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারে নেমে আসে চরম দুভোর্গ, সড়ক দুঘর্টনায় মমাির্ন্তক মৃত্যু সহজে মেনে নেয়া যায় না। এর প্রতিকার চাই, আমরা দেখতে চাই নিরাপদ সড়ক, সড়কপথে কোনো প্রাণহানি নয়, দেখতে চাই স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি। তাই জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্বও সরকারের। সড়ক দুঘর্টনায় মৃত্যুর হার কমাতে হলে অবশ্যই দোষীদের শাস্তি দিতে হবে। প্রাকৃতির দুযোের্গর ওপর মানুষের কোনো হাত না থাকলেও মানবসৃষ্ট দুযোর্গ কমানো সম্ভব। এ জন্য আমাদের সতকর্ভাবে রাস্তা পারাপার হওয়া যেমন দরকার, তেমনি চালকদেরও সাবধানতা ও সতকর্ হওয়া জরুরি। আমরা সাধারণ মানুষ, পথচারী কেউ পথের বলি হতে চাই না। প্রতিটি মৃত্যুর দায়ভার সরকার কিংবা গণপরিবহন মালিক শ্রমিকদের নেয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলে দুঘর্টনার সংখ্যা কমবে। কিন্তু দায়ভার কেউ নিতে চায় না। মোহাম্মদ নজাবত আলী: কলাম লেখক ও শিক্ষক