বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

পদ্মা সেতুুর উপর দিয়ে চলবে ট্রেন অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ

পদ্মা সেতুু চালু হওয়ায় দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে টার্গেট করে নতুন নতুন শিল্পোদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। পদ্মা সেতুুর সঙ্গে নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং পর্যটনকেন্দ্রগুলোর সংযোগ সড়ক মহাসড়কগুলোর উন্নয়ন, প্রশস্তকরণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। এতে করে বাগেরহাট, সুন্দরবন ও কুয়াকাটায় নতুন পর্যটন সম্ভাবনা শুধু দেশীয় দর্শনার্থীদেরই আকৃষ্ট করেনি, আন্তর্জাতিক পর্যটনেরও অপার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আশা করি, এই অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে সফলভাবে কাজে লাগাতে পারলে অন্য যে কোনো শিল্পোদ্যোগের চেয়ে অনেক বেশি কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে।
মো. খসরু চৌধুরী
  ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

স্বপ্নের পদ্মা সেতুুর উপর দিয়ে জুলাইয়ে চলবে ট্রেন। পদ্মা সেতুু নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে। এটি ছিল ১৭ কোটি মানুষের স্বপ্ন পূরণের ঘটনা। স্বপ্নের এ সেতুু নির্মাণে ঋণ বরাদ্দ করেও কাল্পনিক অভিযোগে পিছুটান দেয় বিশ্বব্যাংক। সেতুু নির্মাণের অন্য ঋণদাতারাও সরে যেতে বাধ্য হয়। তবে এসংক্রান্ত অভিযোগের তদন্তে এবং বিদেশি আদালতের বিচারে প্রমাণিত হয় পুরো অভিযোগটি ছিল ভুয়া। বাংলাদেশের অব্যাহত উন্নতি বাধাগ্রস্ত করার এই পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিল ঘরের শত্রম্ন বিভীষণরা। ষড়যন্ত্রকারীদের মুখে ছাই দিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত হবে পদ্মা সেতুু। এমনকি সেতুুর উপর দিয়ে ট্রেন চলাচলের জন্য নেওয়া হয় আরেক মহাপ্রকল্প। ৩৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নেওয়া সেই প্রকল্পের ৭৫ শতাংশ কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা-টু ভাঙ্গা অংশের ৮২ কিলোমিটারের কাজ ৮৫ শতাংশ শেষ। এ বছর জুনের মধ্যে এ অংশের কাজ শেষ হলে জুলাইয়ে তা চালু করা সম্ভব হবে। দ্বিতীয় ধাপে ভাঙ্গা-যশোর অংশ চালু হবে আগামী বছর। এর ফলে রেলপথে ঢাকা-খুলনার দূরত্ব ২১২ কিলোমিটার কমে যাবে।

পদ্মা সেতুু ও এর দুই প্রান্তে রেললাইন নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে ২০১৮ সালে। প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল ২০১৬ সালে। শুরুতে যানবাহনের সঙ্গে একই দিন রেল চালুর পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হয়। পদ্মা সেতুু নির্মাণ সম্পন্ন করার দায়িত্ব সেতুু বিভাগের হলেও ট্রেন চলাচল নিশ্চিত করার দায়িত্ব রেলপথ মন্ত্রণালয়ের। ফলে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতুু হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার দীর্ঘ রেললাইন বসানো এবং স্টেশন ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণে আলাদা প্রকল্প নেয় রেলওয়ে মন্ত্রণালয়। জিটুজি পদ্ধতিতে বাস্তবায়নাধীন এই প্রকল্পে অর্থায়ন করছে চীন। এই প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। স্বপ্নের পদ্মা সেতুুতে রেল চলাচলের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ রূপ পাবে পদ্মা সেতুু প্রকল্প।

পদ্মা সেতুু বাঙালি জাতির মর্যাদার প্রতীক। নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতুু নির্মাণের ফলে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর একটি সাহসী সিদ্ধান্ত তাকে একজন আত্মবিশ্বাসী, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি, ধারাবাহিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং বিভিন্ন সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানের উন্নতি আজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।

পদ্মা সেতুুকে কেন্দ্র করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের অর্থনীতি। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে দেশের অন্যান্য অংশের সেতুুবন্ধনে তৈরি হয়েছে নতুন মাত্রা। দ্রম্নত যাতায়াতের পাশাপাশি তৈরি হয়েছে নানা ধরনের অর্থনৈতিক সুযোগ। পদ্মা সেতুু এখন বাংলাদেশ ও বাঙালির গর্বের প্রতীক, আনন্দের ঝরনাধারা। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন এ পদ্মা সেতুু।

পদ্মা সেতুু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পর্যটন ও শিল্পায়নে যে আকাশচুম্বী সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তার প্রেক্ষাপটে উন্নয়ন পরিকল্পনার সমন্বিত রূপরেখা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। দেশের ওই অঞ্চলে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন, একই স্থান থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার অপূর্ব মনোরম সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটা, খানজাহান আলীর মাজার ও ষাটগম্বুজ মসজিদসহ অনেক দর্শনীয় স্থান ও পর্যটন স্পট রয়েছে- যা এতদিন উত্তাল পদ্মা নদী পেরিয়ে যাতায়াতের অসুবিধার কারণে জমে ওঠেনি। পদ্মা সেতুুর মেলবন্ধন দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষিতে যেমন নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে, একইভাবে সেখানে শিল্পায়নে নতুন নতুন বিনিয়োগের পাশাপাশি পর্যটন খাতেও অপার সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছে।

পদ্মা সেতুু চালু হওয়ায় দক্ষিণ বাংলার ২১টি জেলার কৃষক, মৎস্যজীবী, তাঁতি, ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ী বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভোক্তার সমাবেশ যে রাজধানী ঢাকা তার সঙ্গে অনায়াসে সংযুক্ত হতে পেরেছে। অন্যদিকে, তারা রাজধানী থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে নিয়ে যেতে পারছে তাদের গ্রামের ও আশপাশের এসএমই উদ্যোগগুলোর জন্য। দক্ষিণাঞ্চলের সামগ্রিক উৎপাদন, সেবা, পর্যটন, শিল্প-বাণিজ্যেও বিনিয়োগ বেড়েছে। বেড়েছে কর্মসংস্থান। ২১ জেলায় মানুষের আয়-রোজগার ও জীবনের মান বাড়ার প্রভাব জাতীয় অর্থনীতিতে পড়ছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পদ্মা সেতুু চালু হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের জিডিপি অন্তত ৩.৫ শতাংশ বাড়বে। আর দেশের জিডিপি বাড়বে অন্তত আরো ১.২৬ শতাংশ। ট্রান্স-এশিয়ান রেল ও সড়ক এই সেতুুর মাধ্যমেই যুক্ত হবে। এডিবি বলছে, ২০৫০ সালে ৬৭ হাজার যান চলাচল করবে এই সেতুু দিয়ে। জরিপে আরো বলা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যেই পাঁচ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থানের সুবিধা পাবে এই সেতুুর কল্যাণে। দক্ষিণাঞ্চলের দারিদ্র্য প্রতি বছর ১ শতাংশেরও বেশি হারে কমবে। অর্থাৎ সমৃদ্ধ বাংলাদেশের পথে আমাদের যাত্রা আরো ত্বরান্বিত হবে। এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।

আগে যেখানে মাওয়া-জাজিরা ফেরিঘাটে পারাপারের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করতে হতো, এখন তা মাত্র ১০ মিনিটেই পার হওয়া যাচ্ছে। পদ্মা সেতুু প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় থেকে শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুরসহ দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলাগুলোতে জমির মূল্য বেড়ে চলেছে। হাজার হাজার বেসরকারি ও করপোরেট উদ্যোক্তা বিভিন্ন সেক্টরে শত শত কোটি টাকার বিনিয়োগের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। সেই সঙ্গে সরকার এবং বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) তত্ত্বাবধানে ১৭টি নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতি চলছে। এর মধ্যে বাগেরহাটে পরিকল্পিত ইকোটু্যরিজম পার্ক এবং মংলা অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত কেন্দ্রিক পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন পরিকল্পনা সেখানে লাখো মানুষের নতুন কর্মসংস্থান ও কর্মচাঞ্চল্যে ভরিয়ে তুলছে।

পদ্মা সেতুু চালু হওয়ায় দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে টার্গেট করে নতুন নতুন শিল্পোদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। পদ্মা সেতুুর সঙ্গে নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং পর্যটনকেন্দ্রগুলোর সংযোগ সড়ক মহাসড়কগুলোর উন্নয়ন, প্রশস্তকরণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। এতে করে বাগেরহাট, সুন্দরবন ও কুয়াকাটায় নতুন পর্যটন সম্ভাবনা শুধু দেশীয় দর্শনার্থীদেরই আকৃষ্ট করেনি, আন্তর্জাতিক পর্যটনেরও অপার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আশা করি, এই অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে সফলভাবে কাজে লাগাতে পারলে অন্য যে কোনো শিল্পোদ্যোগের চেয়ে অনেক বেশি কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে।

মো. খসরু চৌধুরী : রাজনীতিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে