শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আত্মহত্যা প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিন

কেউ কোনো সমস্যায় আক্রান্ত হলে তার সঠিক চিকিৎসা না পেলে বিষণ্নতা ও হতাশায় নিমজ্জিত হয়। ভুগতে থাকে মানসিক রোগে। আর এর শেষ পরিণতি গিয়ে ঠেকে আত্মহত্যায়।
দয়াল কুমার বড়ুয়া
  ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে দেশের দেড় শতাধিক জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকা এবং অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে আঁচল ফাউন্ডেশন যে সমীক্ষা প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে, তা কোনো আশার কথা শোনাচ্ছে না। 'স্কুল ও কলেজ শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা : সমাধান কোন পথে' শীর্ষক এই সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে দেশে মোট ৫৩২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। তাদের মধ্যে স্কুল ও সমমান পর্যায়ের শিক্ষার্থী রয়েছে ৩৪০ জন। কলেজ ও সমমান পর্যায়ে ১০৬ জন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৬ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদের মধ্যে নারী শিক্ষার্থী ৩২০ জন এবং পুরুষ শিক্ষার্থী ২১২ জন। আত্মহত্যার শীর্ষে রয়েছে নারী শিক্ষার্থী। প্রতি মাসে ৩৭ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে।

মানুষ নানা কারণে আত্মহত্যা করে বা করতে পারে। এর মধ্যে আছে বিষণ্নতা, ব্যক্তিত্বে সমস্যা এবং গুরুতর মানসিক রোগ। তা ছাড়া মাদকাসক্তি, অপরাধবোধ, আত্মহত্যায় প্ররোচনা, অশিক্ষা, দারিদ্র্য, দাম্পত্য কলহ, প্রেম-কলহ, অভাব-অনটন, দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভোগা, যৌন নির্যাতন, অভিমান, পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট, প্রেমে ব্যর্থ ও প্রতারণার শিকার হয়ে অনেকে আত্মহত্যা করে। সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা সংঘটিত হয় ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতার জন্য। তুচ্ছ কারণেও অনেকে আত্মহত্যায় ঝুঁকছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মহত্যার প্রতিরোধ করতে হলে প্রথমে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কাজ করতে হবে। অভিভাবক ও পরিবার এখানে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মা-বাবা ও পরিবারের সদস্যদের বুঝতে হবে বিষয়টি। তাদের একটি বিশাল ভূমিকা রয়েছে। ভূমিকা রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরও। দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পর্যায়ক্রমে একজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেওয়া দরকার। আবার সমাজও এখানে অনেক বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। চিকিৎসাক্ষেত্রের্ যাশনাল ইমোটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি বা সংক্ষেপে আরইবিটি নামে একটি বিশেষ থেরাপি আছে। এই থেরাপি মানসিক সংকট ও নেতিবাচক চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করে। হতাশা দূর করা, বিষণ্নতা কাটিয়ে ওঠা, আসক্তি থেকে মুক্তি, ভয় দূর করাসহ বিভিন্ন মানসিক সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে আরইবিটি।

মানসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যদি উন্নত থাকে, তাহলে এটি প্রতিরোধ সম্ভব। মানসিক রোগ এবং পারিবারিক ও সামাজিক নানা প্রতিক্রিয়া থেকে জন্ম নেওয়া মানসিক চাপের সঠিক ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। এ জন্য দরকার সচেতনতা এবং দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। আগে থেকে সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া হলে জীবনের এই মর্মান্তিক পরিণতি এড়ানো সম্ভব।

শুধু বয়স্ক নারী-পুরুষ নয়, অল্পবয়সি এমনকি কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আশঙ্কাজনক হারে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষ অতিমাত্রায় হতাশাগ্রস্ত ও সংবেদনশীল হয়ে পড়ায় আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। সব বয়সি মানুষের মধ্যেই বেড়েছে এর প্রবণতা।

সামাজিক বৈষম্য, পারিবারিক কলহ, মাদক, ইন্টারনেটের অপব্যবহার, সন্তানের প্রতি অভিভাবকদের উদাসীনতা, পারিবারিক বন্ধন ফিঁকে হয়ে আসার মতো কারণগুলো প্রকট আকার ধারণ করায় মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার মতো জঘন্য অপরাধের প্রবণতা বাড়ছে। এ ছাড়া নৈতিক স্খলন, তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার, বস্ন্যাকমেইলিং অনেককে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

তথ্য অনুযায়ী, তরুণদের মধ্যে অধিকাংশই মানসিক বিষণ্নতায় ভোগেন। যেমন, অধিকাংশ সময় মন খারাপ থাকা, পছন্দের কাজ থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা। অস্বাভাবিক কম বা বেশি ঘুম হওয়া, কাজে মনোযোগ হারিয়ে ফেলা, নিজেকে নিয়ে নেতিবাচক চিন্তা করা, সবকিছুতে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা। এ সমস্যাগুলো তীব্র আকার ধারণ করলে আত্মহত্যার চেষ্টা করে তরুণরা।

সাম্প্রতিক সময়গুলোতে যৌথ পারিবারিক কাঠামো ভেঙে একক পরিবারের দিকে ঝুঁকে পড়ার কারণে মানুষ ছোটবেলা থেকেই একটু বেশি সংবেদনশীল হয়ে পড়ছে। অতিমাত্রায় সংবেদনশীল হয়ে পড়াও আত্মহত্যার অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে। বর্তমানে ডিজিটাল পস্ন্যাটফরমে শিশুরা বেশি সময় ব্যয় করছে। এ কারণে স্বাভাবিকের চেয়ে তাদের চোখ, মাথা ও কানের মতো পঞ্চন্দ্রীয়ের ওপর অতিমাত্রায় চাপ পড়ছে। এতে তারা সংবেদনশীল হতে বাধ্য। মূলত প্রত্যাশিত চাহিদা পূরণ করতে না পারা মানুষকে বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয়। একজন মানুষের জীবনে একের পর এক এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি তাকে চরম মাত্রায় হতাশ করে তোলে। একপর্যায়ে সে আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকে পড়ে। দীর্ঘদিন ধরে এটাই হয়ে আসছে।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মহত্যার ঘটনা নির্মূলে সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ ও প্রয়াস থাকলেও এ প্রবণতা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। তবে প্রচেষ্টাগুলো আরও বেশি মনোযোগ পাওয়ার দাবি রাখে। পাশাপাশি অবকাশ রাখে নতুন ভাবনা ভাবার। শিল্পায়নের সঙ্গে নগরায়ণ, একই সঙ্গে প্রযুক্তিনির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় পালস্না দিয়ে সমাজে নানা জটিলতা বাঁক নিচ্ছে। আমাদের পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক মূল্যবোধগুলো দিন দিন হালকা হয়ে যাচ্ছে। সঠিক সামাজিকীকরণ, শক্তিশালী ও কার্যকর সামাজিক এবং পারিবারিক মূল্যবোধসমূহ ধারণ ও লালন, সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের সংহতি স্থাপন করা সম্ভব হলে তা হবে আত্মহত্যা নিরসনের মূল হাতিয়ার।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটকে আরও বেশি শক্তিশালী করা প্রয়োজন এবং বাংলাদেশের তৃণমূল পর্যন্ত মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সঠিকভাবে পৌঁছে দেওয়া বিশেষভাবে প্রয়োজন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও জরুরি মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে হবে। মেয়েদের জন্য তৈরি করতে হবে সামাজিক সুরক্ষার বলয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় মেয়েরা শুধু মেয়ে হওয়ার কারণেই নানা সংকটের সম্মুখীন হয়- যা তাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার আবহ তৈরি করে। সেই সঙ্গে নারীবান্ধব নীতি প্রণয়ন ও এর যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে লিঙ্গসাম্য প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হতে হবে।

কেউ কোনো সমস্যায় আক্রান্ত হলে তার সঠিক চিকিৎসা না পেলে বিষণ্নতা ও হতাশায় নিমজ্জিত হয়। ভুগতে থাকে মানসিক রোগে। আর এর শেষ পরিণতি গিয়ে ঠেকে আত্মহত্যায়।

দয়াল কুমার বড়ুয়া : কলামিস্ট ও রাজনীতিবিদ, কো-চেয়ারম্যান জাতীয় পার্টি

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে