মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকার দূষণের কারণ ও রোধে করণীয়

বায়ুদূষণ রোধে জনসাধারণের সচেতনতার বিকল্প নেই। আইন মানার ইচ্ছা না থাকলে শত আইন করেও অপরাধ বন্ধ করা যায় না।
মাজহারুল ইসলাম সৈকত
  ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যম হলো বায়ু। আর সেই বায়ু যদি দূষিত হয় তাহলে বাঁচার উপায় কি? বায়ুদূষণের কারণে মানুষের মৃতু্যঝুঁকি ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডবিস্নউএইচও) মতে, 'বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বে প্রতি বছর আনুমানিক ৭ মিলিয়ন মানুষ মৃতু্যবরণ করেন। মূলত স্ট্রোক, হৃদরোগ, ফুসফুসের ক্যানসার এবং তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের অর্থাৎ শ্বাসকষ্টজনিত কারণে মৃতু্যহার বৃদ্ধি পায়'। এমতাবস্থায় গত এক সপ্তাহ ধরে বিশ্বের দূষিত শহরের মধ্যে রাজধানী ঢাকা শীর্ষে অবস্থান করছে। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স স্কোর ৩১৫ নিয়ে শীর্ষস্থান ঢাকার- যা অতি বিপজ্জনক হিসেবে ধরা হয়। এর আগে ভারতের দিলিস্ন প্রথমে থাকলেও এবার দিলিস্নকে টপকে প্রথম ঢাকা। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে যেখানে মাত্র ৬১ (একিউআই) স্কোর নিয়ে ৩১ নম্বরে ছিল সেখানে ২০২৩ সালের শুরুতেই তালিকার ১ নম্বরে উঠে এসেছে ঢাকা। এর পেছনে অবশ্য কারণ শুষ্ক মৌসুম, প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুম এলেই বাতাসের দূষণের মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে যায়।

জাতিসংঘের তথ্যমতে, 'বিশ্বব্যাপী প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জন দূষিত বাতাসে শ্বাস নেন এবং বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর প্রধানত নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশে আনুমানিক ৭০ লাখ মানুষের অকাল মৃতু্য ঘটে'। বায়ুদূষণ একেবারে বন্ধ করা কখনোই সম্ভব নয়, কিন্তু দূষণ কমানোর জন্য করার অনেক কিছুই আছে। দূষণ কমানোর জন্য সবার আগে দূষণের কারণ চিহ্নিত করতে হবে। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে উলেস্নখ করা হয়েছে যে, 'ঢাকার বায়ুদূষণের তিনটি প্রধান উৎস হলো- ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণ সাইটের ধূলি'। তাহলে কি আমরা এই তিনটিকে (ইটভাটা, নির্মাণকাজ, যানবাহন) বন্ধ করে দেব? তাতো আর করা যাবে না- যা করতে হবে তা হলো এই ৩টি নিয়ন্ত্রণের জন্য সঠিক পরিকল্পনা।

প্রথমেই ইটের ভাটার কথা বলা যাক, ঢাকা শহরে যেসব ইটভাটা রয়েছে তা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, কিছু ঢাকার উত্তরপ্রান্তে কিছু দক্ষিণপ্রান্তে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তাতে তেমন সমস্যা ছিল না, সমস্যা হচ্ছে বাংলাদেশের ঋতু এমন যে ৬ মাস উত্তর দিক থেকে বাতাস প্রবাহিত হয় বাকি ৬ মাস দক্ষিণ দিক থেকে প্রবাহিত হয়- যার কারণে ইটভাটার দূষিত ধোঁয়া ঘুরে ফিরে ঢাকা শহরের অভ্যন্তরেই ঢুকছে। যদি ঢাকা শহরের ইটভাটার জন্য নির্দিষ্ট স্থান নির্ধারণ করে দেওয়া হতো যেখান থেকে শহরে দূষিত বাতাস ঢুকতে না পারে তাহলে শহরের দূষণ অনেকটা কমানো যেত। ইটভাটায় চাইলে আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে দূষণ কমানো যায়। কি প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভাটা চালালে দূষিত কালো ধোঁয়া বন্ধ করা যায় তা মেনে চলছে না অনেক ভাটায় দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার না করলে ভাটা বন্ধ করে দেওয়া উচিত। বিশ্বের অনেক দেশেই ইটভাটা নেই তারা সিমেন্টর বস্নক তৈরি করে ইটের বিকল্প ব্যবহার করে। আমাদের দেশেও চাইলে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা যায় এতে দূষণ অনেকটাই কমে যাবে।

ঢাকা শহরে যেসব যানবাহন চলাচল করে তার বেশির ভাগের ফিটনেস ঠিক নেই। আর যার মধ্যে বেশির ভাগই পুরাতন ফিটনেসবিহীন ইঞ্জিন দিয়ে চালায়। যার কারণে সেসব ইঞ্জিন থেকে কালোধোঁয়ার পরিমাণও বেশি হয়। তাই প্রথমেই ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল বন্ধ করতে হবে। ঢাকা শহরের যানবাহন কমাতে হবে, একই সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তির জ্বালানি ব্যবহার করেও দূষণের মাত্রা কমানো সম্ভব। বিদু্যৎ চালিত যানবাহন বাড়িয়ে জ্বালানি চালিত যানবাহন কমানো গেলে দূষণ ও কমবে। ইলেকট্রনিক গাড়ি কিংবা মেট্রোরেলের মতো যানবাহন।

নির্মাণ সাইটের ধূলিকণা বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ। প্রথমেই জানা প্রয়োজন, কীভাবে এই দূষণ হয়। নির্মাণকাজ দুই ধরনের হয়- সরকারি নির্মাণকাজ, ব্যক্তিগত নির্মাণকাজ। সরকারি নির্মাণকাজের মধ্যে সাধারণত রাস্তার কাজগুলো থেকে বেশি দূষণ ছড়ায়। একটি ড্রেইনের কাজ বা রাস্তার কাজ বছরের পর বছর চলতে থাকলে দূষণও বাড়ে। বেশি সমস্যা হয় রাস্তার কাজ একপাশে চলে অন্য পাশ দিয়ে যানবাহন চলে যেখান থেকে ধূলিকণা চারিদিকে সহজেই বাতাসের সঙ্গে মিশে যেতে থাকে। ড্রেইনের গর্ত খুঁড়ে পাশেই মাটিস্তূপ করে রাখা হয়, সেখান থেকে যানবাহনের বাতাসে বালি ছড়িয়ে পড়ে বায়ুতে। এই অবস্থা থেকে বাচার জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে কাজ করা উচিত। ব্যক্তিগত নির্মাণকাজ থেকেও বেশি দূষণ হচ্ছে বর্তমানে। একটি দালান উঠবে সেখানে রাস্তার পাশে বালি রাখা হয়, ঢেকে রাখা হয় না নির্মাণসামগ্রী, যেখান থেকে বাতাস এলে সেই বালি বাতাসের সঙ্গে মিশে বায়ুকে দূষিত করছে। শুধু তাই নয়, একটি নির্দিষ্ট সাইটের কাজ শুরু করার আগে পর্যাপ্ত পরিমাণে ঢাকনার ব্যবস্থা করতে হবে- যাতে করে নির্দিষ্ট এরিয়ার বাহিরে একটি বালিকণা ও বাহিরে না যায়।

সিটি করপোরেশন আরো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে। উন্নয়ন কাজের পরিকল্পনা হতে হবে পরিবেশবান্ধব। জনজীবন কে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে উন্নয়ন কাজের কোনো মানেই হয় না। সিটি এলাকায় কোনো নির্মাণকাজ পরিবেশের ক্ষতি করছে কিনা নিয়মিত নজরদারিতে রাখতে হবে। কোথাও কেউ আইন অমান্য করলে ব্যবস্থা নিতে হবে। রাতের বেলা সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মীরা রাস্তা পরিষ্কার করার সময় অনেক বেশি ধূলিকণা বাতাসের সঙ্গে মিশে যায়; কারণ তারা ঝাড়ু দেওয়ার সময় পানি ছিটায় না। সিটি করপোরেশনের উচিত পানি ছিটানো বাধ্যতামূলক করা। এতে বায়ুদূষণ কমবে। সিটি করপোরেশন পর্যাপ্ত পরিমাণে ডাস্টবিন রাখতে হবে সব জায়গায়- যাতে ময়লা-আবর্জনা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলা যায়। কলকারখানার বজ্য অপসারণের জন্য উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। শুষ্ক মৌসুমেই বায়ুদূষণ বেশি হয় সুতারং এই মৌসুমে দিনে রাস্তায় পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এতে করে ধূলিকণা বাতাসে মিশতে পারবে না বায়ুদূষণ কমবে।

বায়ুদূষণ রোধে জনসাধারণের সচেতনতার বিকল্প নেই। আইন মানার ইচ্ছা না থাকলে শত আইন করেও অপরাধ বন্ধ করা যায় না।

\হধরুন, রাস্তার পাশে সিটি করপোরেশনের ডাস্টবিন রাখা আছে কিন্তু আপনি কলা খেয়ে খোসা ঠিকি বাহিরে ফেললেন বিষয়টি এমন। যত কিছুই করুক জনসচেতনতা সবার আগে প্রয়োজন। প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে একটু একটু করে সচেতন হলে আমার আপনার শহর রক্ষা পাবে, রক্ষা পাবে মানুষ।

মাজহারুল ইসলাম সৈকত :কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে