শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষকতা পেশায় আগ্রহী নয় মেধাবীরা

নতুনধারা
  ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

প্রাসঙ্গিক বিষয় উপস্থাপনার আগে একটা অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের অবতারণার কৌতূহল প্রশমন করতে পারছি না। জনৈক শিক্ষকের শ্রেণিতে পাঠদানকালে 'কপোল ভিজিয়া গেল দু'চোখের জলে'-এই বাক্যটি প্রাসঙ্গিকভাবে আলোচ্য হয়ে পড়ে। এক মেধাবী ছাত্র 'কপাল' আর 'কপোল'কে অনুরূপ শব্দ মনে করে শিক্ষকের নিকট জানতে চান চোখের উপরে কপাল থাকায় চোখের জলে কীভাবে কপাল ভেজে। 'কপাল' আর 'কপোল'-এর অর্থগত পার্থক্য জ্ঞাত না হওয়ায় নিজেকে বিব্রতকর অবস্থা থেকে রক্ষা করতে পরিস্থিতি সামাল দিতে শিক্ষক ত্বরিত বলে ওঠেন, 'লোকটির পা দু'খানি বাঁধা ছিল কদমের ডালে।'

জীবন বাঁচানোর জন্য চিকিৎসকের ভূমিকা সর্বাগ্রে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। মর্যাদা এবং প্রয়োজনীয়তার দিক থেকে সমাজে চিকিৎসা পেশার পরের জায়গাটি দখলে বোধ করি শিক্ষকতা পেশার। অসামান্য সম্মান নিহিত যে পেশায় এবং প্রতিভাবান মানুষ গড়ার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সংশ্লিষ্ট যে পেশা, সে পেশায় আগ্রহী নয় আজকের মেধাবীরা। মানুষ গড়ার কারিগরখ্যাত একজন শিক্ষককে অবশ্যই অসামান্য মেধার অধিকারী হওয়া কর্তব্য। অথচ আজকের মেধাবী প্রজন্ম সম্পূর্ণভাবে অনাগ্রহী এ পেশাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করতে। একজন মেধাবী শিক্ষকই জানেন শিক্ষাদানের প্রকৃত কৌশল। পাঠের প্রতি শিক্ষার্থীর মনোযোগ আকর্ষণের সর্বোচ্চ চেষ্টা এবং পাঠদানে নির্ভুল ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগ একমাত্র যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকের পক্ষেই সম্ভব। অথচ উচ্চতর পারিশ্রমিক এবং আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধার অনুপস্থিতির কারণে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিতে নারাজ আজকের মেধাবী প্রজন্ম। শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে তাদের মধ্যে কাজ করছে হতাশা আর আস্থার সংকট। এ মহৎ পেশার প্রতি তাদের অনীহা ক্রমেই বাড়ছে। যেসব শিক্ষার্থীদের এখনো তাদের প্রাথমিক পাঠই সম্পন্ন হয়নি তারাও জীবনের লক্ষ্য হিসেবে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বাছাই কিংবা পছন্দ করতে নারাজ।

ইদানীং স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণরা যখন উচ্চ বেতনের কোনো কর্মসংস্থান খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয় তখন নিরুপায় হয়ে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে। মন থেকে গ্রহণ না করায় আন্তরিকতা আর সদিচ্ছার যথেষ্ট ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। আর এ পেশায় মেধাবীদের অনুপস্থিতির সুযোগে অপেক্ষাকৃত দুর্বল কর্মজীবীর প্রবেশ ঘটছে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এ পেশায়। শিক্ষাজীবনে যাদের একাধিক তৃতীয় বিভাগ তাদের সবচেয়ে বেশি সমাবেশ ঘটেছে এই পেশায়। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে 'শিক্ষা' মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার। এটা নিয়ে গাফিলতি কিংবা অবহেলা করার সুযোগ নেই।

মফস্বলের একটি বিদ্যালয়ের জনৈক বিএসসি শিক্ষক বাংলা শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে প্রক্সি ক্লাস নিতে গিয়ে শ্রেণিতে পাঠদানের সময় 'কাঠ' বানান চন্দ্রবিন্দু সহযোগে বোর্ডে লেখেন। জনৈক ছাত্রী শব্দটির বানানের ব্যাপারে আপত্তি তুললে ওই শিক্ষক শ্রেণিতে ব্যাখ্যা দেন এভাবে-'কাঁঠাল' থেকে 'কাঠ'। 'কাঁঠাল' বানানে চন্দ্রবিন্দু আছে তাই 'কাঠ' বানানে চন্দ্রবিন্দু হবে।

স্নাতক পাস করে ব্যাপক প্রচলিত বাংলা বানানগুলোই যে আয়ত্ত করতে পারেনি, তার শিক্ষকতা পেশায় আসার কোনো অধিকারই নেই। নৈতিক দায়বদ্ধতা থেকেই এরূপ ব্যক্তির শিক্ষকতা থেকে দূরে থাকা উচিত কিংবা শিক্ষকতা ছেড়ে দেওয়া উচিত। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যারা সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সঠিকভাবে দেশ পরিচালনা করে এ উন্নয়নশীল দেশকে উন্নত দেশে পরিণত করার সংগ্রামে শামিল হবে, তাদের উপযুক্ত মানুষ করার দায়িত্ব এই যোগ্যতাসম্পন্ন (!) শিক্ষকের কাঁধে। ভাবা যায়? লেখার শুরুতেও একটা বাস্তব ঘটনার উলেস্নখ করেছি।

বেসরকারি ব্যাংকের একজন 'সিকিউরিটি গার্ড' প্রারম্ভিক বেতন পান ১৬-২০ হাজার টাকা। বোনাসসহ আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা তো রয়েছেই। সেখানে প্রশিক্ষণবিহীন একজন সহকারী শিক্ষক বেতন পান সাড়ে ১২ হাজার টাকার মতো। বোনাস মূল বেতনের শতকরা ২৫ ভাগ। এই দুর্মূল্যের বাজারে এই টাকায় দিন গুজরান করা যে কোনো মানুষের পক্ষেই অসম্ভব। একজন রিকশাচালকের আয়ও দৈনিক গড়ে ৮০০-১০০০ টাকা। বেসরকারি ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা প্রারম্ভিক বেতন পান প্রায় ৪০ হাজার টাকা (প্রতিষ্ঠানভেদে ভিন্ন)। সঙ্গে আছে নামেমাত্র মুনাফায় গাড়ি ক্রয় আর গৃহনির্মাণ বাবদ প্রায় ১ কোটি টাকার আর্থিক সুবিধা। পক্ষান্তরে শিক্ষকদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে মাত্র ৭-৮ লাখ টাকার ঋণ সুবিধা, যা দিয়ে বাড়ি করতে গেলে ভবনের ভিতও হয় না। এ ঋণের মুনাফাও অত্যন্ত চড়া।

শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে মেধাবীদের এ পেশায় আকৃষ্ট করতে না পারলে জাতি হিসেবে আমরা অর্জন করতে পারব না সমৃদ্ধি। দেশ ব্যর্থ হবে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে।

দীপঙ্কর পোদ্দার অপু

শিক্ষক এবং সাংবাদিক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে