ভেজাল খাবার না নিরাপদ খাবার?

প্রকাশ | ২০ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

সোয়াইব আহমেদ শিক্ষাথীর্, সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
রাজধানী ঢাকার হোটেল বা রেস্টুরেন্টের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও নিম্নমানের খাবার পরিবেশন নিয়ে প্রচার-প্রচারণা বা অভিযান পরিচালনা নতুন কোনো ঘটনা নয়। এক কোটি ৭০ লাখ লোকের বসবাসের শহর ঢাকায় হোটেল বা রেস্টুরেন্ট থেকে নগরবাসী খাবার গ্রহণ করে একপ্রকার বাধ্য হয়েই। কিন্তু রাজধানীবাসীর গ্রহণকৃত এসব খাবার কি আদৌ সুষম। এর উত্তর যারা এসব হোটেল থেকে খাবার গ্রহণ করেন তারাই ভালো বলতে পারবেন। বতর্মানে ঢাকায় অভিজাত রেস্টুরেন্টের সংখ্যা যেমন বাড়ছে সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে যত্রতত্র ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ছোট বা মধ্যম মানের হোটেল-রেস্তোরঁা। যার থেকে প্রতিদিন খাদ্য গ্রহণ করছেন লাখ লাখ নিম্ন ও মধ্যবিত্ত নগরবাসী। এসব হোটেলে নেই বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ, একদিকে যেমন এদের রান্নাঘরের পরিবেশ দূষিত, অন্যদিকে এদের থালাবাসন একেবারেই অব্যবহারযোগ্য, তা ছাড়া ভাসমান এসব হোটেলে রান্নায় ব্যবহৃত হচ্ছে ওয়াসা থেকে আসা পানি, বিষাক্ত তেল, এদের খাবারের উপরে ঢাকনা রাখার কোনো বালাই নেই, তবে রয়েছে পোকা-মাকড়ের অবাধ বিচরণ। ওয়াসার পানি বিশুদ্ধকরণ ছাড়া বোতলজাত করেই ‘বিশুদ্ধ মিনারেল পানি’ বলে ক্রেতাদের সরবরাহ করা হচ্ছে এসব হোটেল রেস্তোরঁায়। মোদ্দাকথা এসব হোটেল বা রেস্তোরঁায় সুষম খাবার পরিবেশনের কোনো বালাই নেই। রাজধানীর চঁানখারপুল, আজিমপুর, বংশাল, কাজীপাড়া, মিরপুর, শ্যামলীতে এই চিত্র নিয়মিতই চোখে পড়ে। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য অধ্যাদেশ-১৯৫৯ (সংশোধনী-২০০৫) এ বলা হয়েছে, খাবার হোটেলগুলোর রান্নাঘর পরিষ্কার থাকতে হবে, খাবার ঢাকা থাকতে হবে, বাবুচির্র হাতের নখ ছোট থাকবে ইত্যাদি। কিন্তু রাজধানীর হাতেগোনা কয়েকটি হোটেল ছাড়া বাকিগুলো এ নিয়ম-নীতি আমলেই নিচ্ছে না। রাজধানীর জনবহুল এলাকার অলিগলিতে গড়ে উঠছে সারি সারিভাবে পোলাও-বিরিয়ানির দোকান। কিসের মাংস দিয়ে তৈরি হচ্ছে এসব দোকানের বিরিয়ানিগুলো তার নেই কোনো হদিস। তবে মরা গরু ও মুরগি-ছাগলের মাংস এখন হোটেলে কমবেশি বিক্রি হচ্ছে বলে মাঝেমধ্যেই পত্রপত্রিকায় আমরা দেখতে পাই। তবে এটা অস্বীকার করলে চলবে না যে রাজধানীতে মরা মুরগি ক্রয় বিক্রয়ে রয়েছে বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট। রাজধানী ঢাকায় যারা হোটেলে খাদ্য গ্রহণ করছেন তারা একরকম বাধ্য হয়েই করছেন। কেননা বিপুলসংখ্যক ব্যাচেলর বা কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের একমাত্র ভরসা রাস্তার পাশের ঝুপড়ি হোটেলগুলো। তবে শ্রমজীবী বা স্বল্প আয়ের মানুষের খুঁজতে হয় সবচেয়ে কম দামে খাবার সরবরাহকারী হোটেল। সে ক্ষেত্রে সেই হোটেলের খাবারের মান কতটা নিম্ন হতে পারে তা কল্পনাতীত। এসব হোটেলের দূষিত খাবার ও পানি গ্রহণের মাধমে ডায়রিয়া, কলেরা, আমাশয়, প্যারাটাইফয়েড, ও ইউরিন ইনফেকশন হতে পারে। এ ছাড়া এধরনের খাদ্যে ফরমালিন, বিষাক্ত রং, কাবার্ইড কলিফমর্ থাকায় অনেকেই নানা রোগে আক্রান্ত হতে হচ্ছে। অনেককে আবার খাদ্যে বিষক্রিয়া, ডায়রিয়া, জন্ডিস, টাইফয়েডে আক্রান্ত হচ্ছে। আবার কারও দেখা দিচ্ছে গুরুতর জীবনঘাতী ক্যান্সারের মতো রোগ। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও খাদ্য এবং কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ খাদ্যে বিষক্রিয়ার ফলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ২০০৫ সালে দেশে ভেজালবিরোধী অভিযান বেশ জোরেশোরে শুরু হয়েছিল এর প্রেক্ষিতে অধিকাংশ হোটেল-রেস্তোরঁা সতকর্ হয়ে যায়। বতর্মানে এসব অভিযান নিয়মিত পরিচালনা সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে । সেই সঙ্গে অবৈধ ভাবে গড়ে ওঠা বিভিন্ন পানির কারখানা গুঁড়িয়ে দিতে হবে। খাদ্যে ভেজাল মেশানোর অপরাধ হিসেবে ভারতে সাজা যাবজ্জীবন; চীনে মৃত্যুদÐ, যুক্তরাষ্ট্রে সশ্রম কারাদÐের বিধান রয়েছে। সেই সাথে বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে বলা আছে রাষ্ট্রের সব নাগরিকের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে। আর এ কারণে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণের দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। এর ধারাবাহিকতায় সরকার ২০১৩ সালে নিরাপদ খাদ্য আইন তৈরি করে। ‘ভোক্তা অধিকার ও অভিযোগ’Ñ নামে অ্যাপ দিয়ে স্মাটর্ ফোনের মাধ্যমে মুহ‚তের্ই অভিযোগ করা যায়। কিন্তু এ ব্যাপারে আমরা অনেকেই জানি না। তাই নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে দরকার নাগরিক সচেতনতা। এ জন্য গণমাধ্যম বেশ বড় ভ‚মিকা রাখতে পারে। অসাধু হোটেল ব্যবসায়ীদের প্রতিরোধে আমাদের সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সে ক্ষেত্রে স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিরা ও জনপ্রতিনিধিরা বেশ কাযর্কর ভ‚মিকা রাখতে পারেন। সময় এসেছে এসব অসাধু নীরব ঘাতকদের প্রতিরোধের। আমাদের এসব পদক্ষেপ নিশ্চিত করবে জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা তথা নিরাপদ খাদ্য অধিকার।