বায়ুদূষণের নগরী ঢাকা ঘুম ভাঙুক কর্তাব্যক্তিদের

উন্নয়নের বিড়ম্বনায় একের পর এক নির্মাণ কাজে ঢাকার দূষণ কিছুটা বাড়লেও বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে যানবাহনের বিষাক্ত ধোঁয়া। এগুলো যারা নিয়ন্ত্রণ করেন তাদের সঙ্গে যানবাহন মালিকদের গোপন সমঝোতা থাকায় দূষিত নগরীর বদনাম অনিবার্য হয়ে উঠছে। এ বিষয়ে কর্তাব্যক্তিরা দিবানিদ্রা থেকে জেগে উঠলে ভালো করবেন।

প্রকাশ | ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

দয়াল কুমার বড়ুয়া
রাজধানী ঢাকার শিরোস্ত্রাণে একের পর এক কলঙ্কের তিলক দেড় কোটি নগরবাসীর নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকা এক সময় ছিল দুনিয়ার অন্যতম নোংরা নগরী। তিন দশক আগের এক সেনাপতি শাসক সেই নোংরা নগরীকে তিলোত্তমা ঢাকা বলে অভিহিত করে আত্মপ্রসাদ লাভ করতেন। ঢাকার সে নোংরা অবস্থা কিছুটা বদলে গেলেও যানজটের আগ্রাসনে তা অচল নগরী হয়ে উঠেছে কয়েক দশক ধরে। এ সমস্যার সমাধানে একের পর এক ফ্লাইওভারসহ নানা ব্যবস্থা নেওয়া হলেও কাঙ্ক্ষিত ফলাফল মেলেনি। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে উঠেছে ঢাকার বায়ুদূষণ। রবিবার সকাল ৭টায় আন্তর্জাতিক বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা- এয়ার ভিজুয়ালের বায়ুমান সূচক একিউআই ৩১৬ স্কোর নিয়ে ঢাকার বাতাসের মান 'বিপজ্জনক' অবস্থায় ছিল। এ সময় প্রতি ঘনমিটার বাতাসে দূষণের সবচেয়ে বিপজ্জনক উপাদান পিএম-২.৫ অতি সূক্ষ্ন বস্তুকণা ছিল ২৬৬ মাইক্রোগ্রাম। বিকাল ৫টা নাগাদ দূষণ কিছুটা কমে বায়ুমান সূচকে স্কোর ১৯০-তে নামলেও ঢাকা ছিল দূষিত নগরীর তালিকায় শীর্ষে। একই দিন সকালে ভারতের দিলিস্ন ও চীনের শেনইয়াং যথাক্রমে ৩১৩ ও ২৪৫ স্কোর নিয়ে তালিকার দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে ছিল। একিউআই স্কোর ৫০-এর মধ্যে থাকলে তাকে স্বাস্থ্যকর, ৫১ থেকে ১০০ পর্যন্ত সহনশীল, ১০১ থেকে ১৫০ সংবেদনশীল অর্থাৎ শিশু, বৃদ্ধ ও নানা রোগে আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর, ১৫১ থেকে ২০০ অস্বাস্থ্যকর, ২০১ থেকে ৩০০ খুবই অস্বাস্থ্যকর ও ৩০০ ছাড়িয়ে গেলে বিপজ্জনক মাত্রায় দূষিত হিসেবে বিবেচনা করা হয়- যা বাসিন্দাদের জন্য গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। এয়ার ভিজুয়ালের তথ্যানুযায়ী, ২১ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৬টা থেকে ২২ জানুয়ারি বিকাল ৫টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১২ ঘণ্টা বিপজ্জনক মাত্রায় দূষিত ছিল ঢাকার বাতাস। বায়ুদূষণের কারণগুলোর মধ্যে ইটভাটার পরই রয়েছে ধুলাবালি। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন ভবন। কিন্তু এসব স্থাপনা তৈরির সময় মানা হচ্ছে না ইমারত নির্মাণবিধি। ভবন তৈরির সময় সেগুলো কোনো কিছু দিয়ে ঢেকে দেওয়া বা পানি ছিটিয়ে কাজ করার প্রবণতা একদম নেই। এসব তদারকের কার্যকরী ব্যবস্থা বা নীতিমালার অভাবও লক্ষণীয়। ফলে ধুলা উড়ছে বাতাসে। দূষিত হচ্ছে বায়ু। এ ছাড়া ফুটপাতের উন্নয়ন, ইউলুপ ও উড়ালসেতু নির্মাণ, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার জন্য খোঁড়াখুঁড়ি তো চলছেই। এসব উন্নয়ন প্রত্যাশিত হলেও দেখা যায় কোনো কাজই নির্ধারিত সময়ে শেষ হয় না। ফলে বায়ু দূষিত হচ্ছে। ঢাকা শহরসহ অন্যান্য বড় শহরে অনেক সময় দেখা যায়, ড্রেনের ময়লাগুলো রাস্তার পাশে জমিয়ে রাখা হয়। এক সময় এগুলো শুকিয়ে ধূলিকণায় পরিণত হয় এবং পরিবেশ দূষিত করে। আবার সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়িগুলো ময়লা বহনের সময় অধিকাংশ সময় না ঢেকেই বহন করে, ফলে বায়ুদূষণ হয়। বোঝাই যাচ্ছে বায়ুদূষণের পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। ফলে এই সমস্যা সমাধানে একটি সামগ্রিক চিন্তা ও পরিকল্পনা জরুরি। সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও কর্তৃপক্ষ সমন্বিতভাবে কোনো উদ্যোগ নিতে না পারলে পরিস্থিতি সামনের দিনগুলোতে ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। দূষিত বায়ু জনস্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ধূলিকণা মানবদেহের ভেতরে ঢুকে ফুসফুসে গেঁথে থাকে এবং একনাগাড়ে এসব উপাদানের ভেতর দিয়ে চলাচল করলে হৃদরোগ, হাঁপানি ও ফুসফুসের ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। বায়ুদূষণ রোধসহ পরিবেশ রক্ষায় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের আওতায় পরিবেশ অধিদপ্তর 'নির্মল বায়ু এবং টেকসই পরিবেশ প্রকল্প' বাস্তবায়নের পথে থাকলে শুধু এই প্রকল্প দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে না। যেসব সুনির্দিষ্ট কারণে বায়ুদূষণ হচ্ছে সরকারকে সেসব দিকে মনোযোগ দিতে হবে। সনাতন পদ্ধতির ইটভাটাগুলোকে জ্বালানি সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব ইটভাটায় রূপান্তর করা গেলে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ দূষণ কমানো সম্ভব। বিশেষজ্ঞদের মতামত, জনগণকে সম্পৃক্ত করে সুপারিশমালা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন শুরু করলে এ দেশের বায়ু দূষণমুক্ত হবেই হবে। এ জন্য ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। ব্যক্তিগত, সামাজিক ও আইনিভাবে বায়ুদূষণ প্রতিকার ও প্রতিরোধ করতে হবে। বায়ুদূষণের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে এবং অন্যদের বায়ুদূষণের ব্যাপারে সচেতন করতে হবে। যানবাহনে ক্যাটালাইটিক কনভার্টার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ডিজেলের পরিবর্তে সিএনজি গ্যাসের ব্যবহার বৃদ্ধি ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার না করে পাবলিক পরিবহণ ব্যবহারের প্রতি সবাইকে আগ্রহী করতে হবে। ফিটনেসবিহীন লক্কড়ঝক্কড় যানবাহন থেকে বায়ুদূষণ বেশি হচ্ছে। এ বিষয়ে লেখালেখিও হচ্ছে প্রচুর। এখানেও একই অবস্থা। আইন আছে। কিন্তু ঠিকমতো বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না বিভিন্ন কারণে। গণমাধ্যমকে বেশি পরিমাণে এগিয়ে আসতে হবে। ভয়াবহতার অবস্থা তুলে ধরে সচেতনতার কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে করণীয় কী কী তা তুলে ধরতে হবে। জনসচেতনতা সৃষ্টিই পারে বিভিন্ন রকমের দূষণের ভয়াবহতা কমাতে। পাশাপাশি আইনের যথাযথ প্রয়োগও নিশ্চিত করতে হবে। বোঝাই যাচ্ছে বায়ুদূষণের পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। ফলে এ সমস্যা সমাধানে একটি সামগ্রিক চিন্তা ও পরিকল্পনা জরুরি। সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও কর্তৃপক্ষ সমন্বিতভাবে কোনো উদ্যোগ নিতে না পারলে পরিস্থিতি সামনের দিনগুলোয় ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। উন্নয়নের বিড়ম্বনায় একের পর এক নির্মাণ কাজে ঢাকার দূষণ কিছুটা বাড়লেও বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে যানবাহনের বিষাক্ত ধোঁয়া। এগুলো যারা নিয়ন্ত্রণ করেন তাদের সঙ্গে যানবাহন মালিকদের গোপন সমঝোতা থাকায় দূষিত নগরীর বদনাম অনিবার্য হয়ে উঠছে। এ বিষয়ে কর্তাব্যক্তিরা দিবানিদ্রা থেকে জেগে উঠলে ভালো করবেন। দয়াল কুমার বড়ুয়া : কলামিস্ট ও রাজনীতিবিদ, কো-চেয়ারম্যান জাতীয় পার্টি