১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রম্নয়ারি। প্রতিদিনের মতো ওই ভোরেও রাঙা আভা ছড়িয়ে সূর্যের উদয় হলো বাংলার আকাশে। ঢাকার পিচঢালা পথে ঝিলিমিলি খেলছে সূর্য-কিরণ। ওই দিনটিই যে হবে বাঙালির ইতিহাসের চিরশ্রেষ্ঠ দিন, আড়ালের সেই মহাসত্য তখন কে জানত? পাকিস্তানি সরকার সারা দেশে সেদিন ১৪৪ ধারা জারি করে রেখেছিল। কিন্তু কেন এই চুয়ালিস্নশ ধারা? তা জানতে হলে ইতিহাসের কয়েক পাতা পিছনে আমাদের ফিরে যেতে হবে।
১৯৪৭ সালের মধ্য আগস্টে ইংরেজদের কালো হাত থেকে মুক্তি লাভ করে ভারতবর্ষ। ১৪ আগস্ট পূর্ব পাকিস্তান নাম গ্রহণ করে পাকিস্তানের সাথে একাত্ম হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে বাংলাদেশ। পরদিন ১৫ আগস্ট স্বাধীন হয় ভারত।
যেদিন থেকে স্বাধীন হলো এই ভূখন্ড, সেদিন থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানিরা ষড়যন্ত্র শুরু করে পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। স্বাধীনতার স্বাদ আর আস্বাদন করতে পারেনি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ। ক'দিন না যেতেই আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জিয়াউদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব পেশ করেন। বাংলা থেকে ড. মুহম্মদ শহীদুলস্নাহ এই প্রস্তাবের ঘোর বিরোধিতা করেন। দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর ভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও এভাবেই শুরু হয় উর্দুকে এ দেশের মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার হীন চক্রান্ত। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন, 'উর্দু হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা'।
তার এ ঘোষণায় সারা বাংলাজুড়ে শুরু হয় জোরালো প্রতিবাদ। মাতৃভাষার টানে রাজপথে নেমে আসে বাংলার আপামর জনসাধারণ। ঢাকার রাজপথে মিছিল ও প্রতিবাদ সভা করতে থাকে ছাত্রজনতা। দেশের সর্বস্তরের মানুষ একাত্মতা পোষণ করে তাদের সঙ্গে। দিন আসে দিন যায়। এভাবেই আমাদের ইতিহাসকে পূর্ণতা দান করে 'সচেতনতার পথে দ্বিধাহীন অভিযাত্রী নানামুখী হাজার লোকের এক অস্তিত্ব একুশে ফেব্রম্নয়ারি।'
১৯৫২ সালের প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনকে সামনে রেখে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি আরও জোরদার হয়। পাল্টা প্রতিরোধ হিসেবে পাকিস্তানিরা জারি করে ১৪৪ ধারা। কিন্তু চুয়ালিস্নশ ধারার কোনো তোয়াক্কা না করে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা মিছিল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ঢাকার রাজপথে। মিছিল টেকাতে গুলিবর্ষণ শুরু করে পাকিস্তানি বাহিনী। দৃঢ়প্রত্যয়ী ছাত্রজনতা মিছিল নিয়ে বুলেট বর্ষণের মধ্যেই এগিয়ে যেতে থাকে। শহীদ হয় রফিক, সালাম, বরকত ও জব্বার। হত্যাকান্ডের খবর খুব দ্রম্নত ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। পরদিন বাইশে ফেব্রম্নয়ারি। রাজপথে আবারও মিছিল নিয়ে বের হয় বাংলার আপামর জনতা। পাকিস্তানি বাহিনী বেপরোয়া হয়ে সেদিনও গুলি চালায় মিছিলের ওপর। শহীদ হয় শফিউর, অহিউলস্নাহ, আং আউয়ালসহ নাম-যশহীন বাংলা মায়ের আরেক দামাল ছেলে। এভাবে আন্দোলন ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হতে থাকে। হার না মানা বাঙালির পদযুগলে শেষপর্যায়ে মাথা নোয়াতে বাধ্য হয় পাকিস্তানিরা। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয় সরকার। কত সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন কবি, 'আবার ফুটেছে দ্যাখ কৃষ্ণচূড়া থরে থরে, শহরের পথে কেবল নিবিড় হয়ে কখনও মিছিলে কখনও বা একা হেঁটে যেতে মনে হয়, ফুল নয় ওরা শহীদের ঝলকিত রক্তের বুদ্বুদ, স্মৃতির গল্পে ভরপুর একুশের কৃষ্ণচূড়া আমাদের চেতনারই রং।'
ভাষা আন্দোলনের প্রেরণায় উজ্জীবিত বাঙালি ১৯৬৬ সালে রাজপথে নামে ছয় দফা দাবি নিয়ে। উনসত্তুরে হয় গণঅভু্যত্থান, আর সত্তুরে হয় সাধারণ নির্বাচন। ভাষা আন্দোলনের চেতনার শেষ ফলাফল বটবৃক্ষরূপে আত্মপ্রকাশ করে একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে। চির-উন্নত শিরের বাঙালি জাতি মুক্তির স্বাদ আস্বাদন করে। পাকিস্তানি হানাদার তাড়িয়ে ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতার সূর্য। বাংলার আকাশে-বাতাসে পতপত করে ওড়ে লাল সবুজের পতাকা।
একুশের স্মরণে বাঙালি : বাঙালি জাতি ভাষার জন্য শহীদ হওয়া অমর বীরদের সম্মানে ত্রম্নটি করেনি কখনো। বছর না পেরোতেই সারা দেশে শুরু হয় শহীদ দিবস উদযাপন। সে সময়ও বাংলার আকাশ ভেদ করে শহীদ-স্মরণে উত্থিত হতো কালো পতাকা। নগ্ন পায়ে বের হতো প্রভাতফেরি। সমবেত কণ্ঠে আবৃত হতো একুশের গান। শহীদদের কবরে অর্পিত হতো পুষ্পমাল্য। পরে এগুলোই পরিণত হয় বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে। পরের বছরই প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা একাডেমি। শুরু হয় অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা। আয়োজিত হয় জাতীয় বইমেলা।
শহীদদের স্মরণে বাংলার প্রতিটি গ্রাম-মহলস্নায় স্থাপিত হয় শহীদ মিনার। শহীদ-সম্মানে সেখানে নগ্ন পায়েও ওঠার দুঃসাহস দেখায় না কোনো বাঙালি। শহীদদের স্তুপতিপাঠে রচিত হয় 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রম্নয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।' এরকম স্তুতিপাঠ পৃথিবীর সাহিত্য জগতে আর কোথাও কি দেখা মেলে? রচিত হয় মুনির চৌধুরীর 'কবর' নামি ইতিহাস-শ্রেষ্ঠ নাঠক।
এত কিছুর পরও যেন শহীদ-স্মরণে কিছু একটা কমতি থেকে যায়। যেটির অভাব পীড়া দিচ্ছিল পুরো বাঙালি জাতিকে। সেই আকাঙ্ক্ষাই যেন পূর্ণ হয় ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বরে। এই দিনই জাতিসংঘের ইউনেস্কো বিশ্বের ২৭টি দেশের সমর্থন নিয়ে আমাদের মহান একুশে ফেব্রম্নয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।
২০০০ সালের একুশে ফেব্রম্নয়ারি বিশ্বব্যাপী পালিত হয় প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সারা বিশ্বে ভাস্বর হয়ে ওঠে ভাষার জন্য বাঙালির রক্তদান। পৃথিবীর ইথারে ইথারে অনুরিত হয় ভাষার তরে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেদের আত্মবিসর্জন। কবির ভাষায়,
'মাগো, ওরা বলে সবার কথা কেড়ে নেবে
তোমার কোলে শুয়ে গল্প শুনতে দেবে না
বলো মা, তাই কি হয়?'
জাতীয় জীবনে একুশের চেতনা : একুশ ইতিহাসের কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনামাত্র নয়। একুশ বাঙালি জাতির চেতনা। বাঙালি জাতির অহংকার। একুশকে চেতনার বাতিঘররূপে গ্রহণ করেছি আমরা। তার পানে তাকিয়ে আমরা পথ চলেছি ছেষট্টি, উনসত্তর,সত্তর ও একাত্তরে। ড. এনামুল হকের ভাষ্যই এখানে যথার্থ, 'একুশে ফেব্রম্নয়ারি কোনো বিশেষ দিন, ক্ষণ বা তিথি নয়, একটি জাতির জীবন্ত ইতিহাস। এ ইতিহাস অগ্নিগর্ভ; যেন 'সজীব লাভা দ্রাবক আগ্নেয়গিরি', কখনো অন্তর্দাহে গর্জন করছে আর কখনো চারদিকে অগ্নি ছড়াচ্ছে। সত্যি এ ইতিহাস মৃত নয়, একেবারে জীবন্ত।'
বাঙালি জাতি একুশকে গ্রহণ করেছে তাদের মন-প্রাণ সঁপে দিয়ে। কিন্তু এখন, আমাদের এই সময়ে দাঁড়িয়ে তথাকথিত কিছু প্রগতিশীল মহান একুশকে নোংরা করার পাঁয়তারা করছে। একুশকে নিয়ে পথে পথে বাঁধাচ্ছে শত হট্টগোল। কেউ কেউ একুশ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আস্পর্ধা পর্যন্ত দেখিয়ে চলছে। কবির বলা,
'তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে কী থাকে আমার?
উনিশশো বাহান্নর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি
বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহীয়সী।
এখন তোমাকে নিয়ে খেঙরার নোংরামি
এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তি-খেউড়ের পৌষ মাস!
তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো
বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা।'
না, কস্মিনকালেও একুশ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে না বাঙালি। বাতিঘর থেকে কেউ যদি কখনো মুখ ফিরিয়ে নেয়- তাহলে তুমিই বলো হে মানব, সে কি পারবে নিজেকে এগিয়ে নিতে? নিজেকে পূর্ণতা দান করতে? আমরা মিশে আছি একুশের সঙ্গে। একুশ মিশে আছে আমাদের জাতিসত্তার সঙ্গে।
একুশের পথ ধরেই এসেছে আমাদের বহুদিনের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ একুশের চেতনারই ফসল। এ চেতনা অম্স্নান রেখে সব হিংসা-হানাহানি ভুলে জাতির সব ধরনের কল্যাণ ও অগ্রগতির পথে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে; আর তাতেই পূরণ হবে ভাষা শহীদদের আজন্ম লালিত স্বপ্ন।
বাশার জাহাঙ্গীর
ঢাকা