নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা একটি সামাজিক সমস্যা

সম্প্রতি ধষের্ণর ভয়াবহতা ও ধষর্ণ-পরবতীর্ নিযার্তনের লোমহষর্ক সব ঘটনায় অঁাতকে উঠছে দেশবাসী। ধষর্ণ রুখে দিতে প্রতিরোধের চেয়ে প্রতিকার গুরুত্বপূণর্। নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা একটি সামাজিক সমস্যা। মানুষের মধ্যে যে আদিম প্রবৃত্তি, তা দমিয়ে রাখতে হলে শৈশব থেকে বা পরবতীর্কালে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যথাযথ জ্ঞানচচার্, নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে।

প্রকাশ | ২৪ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

অ্যাডভোকেট শেখ সালাহ্উদ্দিন আহমেদ
বাংলাদেশে ধষর্ণ বাড়ছে, বাড়ছে ধষের্ণর পর হত্যা। সামাজিক অবক্ষয়, মাদকের বিস্তার, কমর্হীনতা, আকাশ সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাব, আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকা, পনোর্ ছবির অবাধ বিক্রি, সবোর্পরি নারীর প্রতি পুরুষের হীন দৃষ্টিভঙ্গির কারণে দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে নারী ও শিশু ধষের্ণর ঘটনা। ধষের্ণর সঙ্গে জড়িতরা হয়ে পড়ছে অপ্রতিরোধ্য। শিশু থেকে কিশোরী, যুবতী থেকে বৃদ্ধা, স্কুলছাত্রী থেকে পোশাককমীর্, ডাক্তার, আইনজীবী এমনকি ভিখারিনীও রেহাই পাচ্ছে না মানুষরূপী এসব হায়েনাদের হিংস্র থাবা থেকে। ধষর্করা শুধু ধষর্ণ করেই ক্ষান্ত থাকছে না, ঘটনা ধামাচাপা দিতে ঘটাচ্ছে নৃশংস হত্যাকাÐ। সম্প্রতি ধষের্ণর ভয়াবহতা ও ধষর্ণ পরবতীর্ নিযার্তনের লোমহষর্ক সব ঘটনায় অঁাতকে উঠছে দেশবাসী। ধষর্ণ রুখে দিতে প্রতিরোধের চেয়ে প্রতিকার গুরুত্বপূণর্। নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা একটি সামাজিক সমস্যা। মানুষের মধ্যে যে আদিম প্রবৃত্তি, তা দমিয়ে রাখতে হলে শৈশব থেকে বা পরবতীর্কালে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যথাযথ জ্ঞানচচার্, নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। মূলত সচেতনতার অভাবেই বাড়ছে ধষের্ণর মতো ঘটনা। নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোতে ধষের্ণর ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে। এসব পরিবার সবসময়ই নানা ধরনের টানাপড়েনের মধ্যে থাকে। এর সুযোগ নেয় এক ধরনের নরপশুরা। তারা সুযোগ বুঝে এসব পরিবারের শিশুদের নিজের কাছে নেয় এবং অবুঝ শিশুরা তাদের লালসার শিকার হয়। সামাজিক লোকলজ্জার ভয়ে ধষের্ণর শিকার হয়ে বেশির ভাগ নারীই বিচার চাইতে যান না। আবার যেসব নারী বিচার চাইতে যান, তাদের পুলিশ, প্রশাসন ও সমাজের বিভিন্ন পযাের্য় যথেষ্ট হেনস্তা হতে হয়। ধষের্ণর অভিযোগগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রমাণ হয় না। এর মধ্যে প্রধান কারণ হচ্ছে, ঘটনার তদন্ত প্রভাবিত হওয়া। বতর্মানে যেভাবে শিশুরা ধষের্ণর শিকার হচ্ছে, তা তাদের আতঙ্কিত করে তুলেছে। পরিষদ এ জন্য উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ। কেন এমন নৃশংসতা? এ ধরনের খবর আমাদের সবাইকে ব্যথিত করে, কঁাদায়, উদ্বিগ্ন করে। যারা এ জন্য দায়ী, তাদের বিচারের দাবি ধ্বনিত হচ্ছে। শিশুদের নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা দান ও মৌলিক অধিকার রক্ষা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। রাজনৈতিক, পারিবারিক বা অন্য যে কারণেই হোক শিশু খুনের ঘটনা সামাজিক সংহতির অভাব ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের স্মারক। শিশুদের প্রতি নিমর্মতা থামছে না। জাগতিক পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত বলে শিশুদের বলা হয় স্বগের্র দূত। ভবিষ্যতের কাÐারী শিশুদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির বিকল্প নেই। এ সমাজ কলুষমুক্ত করতে হলে সব অভিযুক্তকে আইনের আওতায় আনতে হবে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে পঙ্কিলতার আবতের্ ঘুরপাক খাবে সমাজ। আমি মনে করি, ধষর্ণ রোধে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা জোরদার করার পাশাপাশি এই প্রবণতার কারণগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে। ধষর্ণপ্রবণতার পেছনে দেশের প্রচলিত রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থা কতটা দায়ী সেটাও অনুধাবন করার প্রয়োজন পড়েছে। আথির্ক দুনীির্ততে ছেয়ে গেছে দেশ, এই দুনীির্ত হয়তো মানুষকে উৎসাহী করছে চারিত্রিক অন্যান্য স্খলনেও। অনেকেই বলছেন, সমাজটা যেহেতু ভোগবাদী হয়ে পড়েছে, তাই মানুষ নানা ধরনের ভোগে প্রলুব্ধ হতেই পারে। এই প্রলুব্ধতার পেছনে কোনো ধরনের নৈতিকতা কাজ করছে না। বাংলাদেশ এক জনবহুল রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রের কোথায় কী ঘটছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে তার সব খেঁাজ রাখা সম্ভব নয়। জাতিকে নৈতিকতাসমৃদ্ধ করে তুলতে না পারলে ধষের্ণর মতো অপরাধ থেকে মুক্ত হওয়া যাবে না। আমরা জোর দিয়েই বলতে চাই, দেশের অপরাধ বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে সমাজবিশারদ, রাজনৈতিক নেতৃত্বÑ সবাইকে একত্র হয়ে ধষর্ণপ্রবণতার কারণগুলো চিহ্নিত করে সে মোতাবেক এই রোগের নিরাময়ের উপায় বের করতে সচেষ্ট হতে হবে। মনে রাখতে হবে, নারীর প্রধান প্রতিপক্ষ পুরুষ এবং পুরুষ শাসিত সমাজ। নারীরা প্রথমে নিকটাত্মীয় বা দূরাত্মীয় কতৃর্ক যৌন হয়রানির শিকার হয়। শৈশবে আদর সোহাগ করার নামে অনেক আত্মীয় যৌন হয়রাানি করে থাকে। নারীরা শরীর বিষয়ে প্রথম হেঁাচট খায় আত্মীয়দের দ্বারাই। এটাকে অনেকে দুঘর্টনা বললেও প্রথম জীবনের এসব অপ্রীতিকর ঘটনা কোনো নারীই ভুলতে পারে না। তবে বিবাহিত জীবনে নারী স্বামী কতৃর্ক যৌন নিযার্তনের বা হয়রানির শিকার হয় সবচেয়ে বেশি। এই নিযার্তনের কথা সে অন্য কারো সঙ্গে শেয়ারও করতে পারে না। কেবল স্বামী নয় দেবর, ভাসুর, শ্বশুর কতৃর্কও অনেকেই যৌন নিযার্তনের শিকার হয়। স্বীকার করতেই হবে যে, ধষর্করাও আমাদের সমাজেরই কোনো না কোনো পরিবারের সদস্য। তাদের বখে যাওয়ার দায় রয়েছে পরিবার-সমাজেরও। তরুণদের সুস্থ-সুন্দর মন ও মূল্যবোধ সম্পন্ন করে গড়ে তুলতে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর যথাযথ ভ‚মিকা রাখতে পারছে না, এটাও স্পষ্ট। মাদকের ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গেও এরকম অপরাধের হার বৃদ্ধির যোগসূত্র আছে বলে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। ধষের্ণর মতো জঘন্য অপরাধ যে মাত্রায় বেড়েছে, লাগাম টেনে না ধরা গেলে তা সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নেবে। ধষর্ণ প্রতিরোধে জরুরি অপরাধীর যথাথর্ শাস্তি নিশ্চিত করা। দুবর্ল ভিকটিমদের পক্ষে রাষ্ট্রকেই এগিয়ে আসতে হবে। অপরাধ তদন্তে ও অপরাধীদের আইন আমলে এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নিরপেক্ষ ভ‚মিকা ও সঠিক তদন্ত অত্যন্ত জরুরি। সমাজে যৌন নিযার্তন ও ধষের্ণর ঘটনা এতই বেড়ে গেছে যে, এর থেকে পরিত্রাণের কোনো রাস্তাই যেন খোলা নেই। এটি ভয়াবহ এক সামাজিক অবক্ষয় এবং নারীর প্রতি চ‚ড়ান্ত অবমাননা। এর মাধ্যমে নারীর জীবনে কেবল কলঙ্ক তিলকই পড়ছে না, তাদের জীবনও চলে যাচ্ছে। অথচ এই জীবন রক্ষার দায়িত্ব সমাজ ও রাষ্ট্রের। যতদিন সমাজ ও রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক এবং সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত না হবে, দেশের মানুষ উন্নত রুচি ও সংস্কৃতির অধিকারী না হবে ততদিন নারী যৌন হয়রানি, নিযার্তন ও ধষের্ণর শিকার হবেই। একুশ শতকে এসে যেখানে নারীর স্বাধীনতা ও আত্মপ্রতিষ্ঠার জাগরণ ঘটবে, সেখানে নারীরা কেবল আথির্ক কারণে যেমন আত্মনিভর্রশীল হতে পারছে না ঠিক তেমনি অথের্ক কেন্দ্র করে নারীর ভাগ্য বিড়ম্বিত হচ্ছে, নিযার্তন-শোষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। এ বাংলাদেশেই মাত্র ছয় হাজার টাকার কারণে মা তার সন্তানকে বিক্রি করে দিচ্ছে। নিজের স্ত্রীকে টাকার বিনিময়ে পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়া বা দেশের বাইরে পাচার করে দেয়ার ঘটনা তো প্রায়ই ঘটছে। সবই যেন অথর্দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং নারীকে তুচ্ছ জ্ঞান করা, নিযার্তন শোষণের প্রতীক হিসেবে দেখা। নারী যে কেবল ধষর্ণ গণধষের্ণর শিকার হয়ে, যৌতুকের কারণে নিজের প্রাণ বিসজর্ন দিচ্ছে তা নয়, ইভ টিজিংয়ের অসহায় শিকার হয়ে গত এক দশকে বহু নারীকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছে। বতর্মান সমাজে নারীরা নানামুখী নিযার্তনের শিকার। নারীদের উচিত এ নিযার্তনের প্রতিবাদ করা কিংবা এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। নিযার্তনের নিষ্ঠুর শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়া নয়। ইভ টিজিংয়ের যারা প্রতিবাদ করছে তারাও অত্যাচার-নিযার্তনের শিকার হয়েছে। মনে রাখতে হবে, নারীমুক্তিতে বাধা শাস্ত্রীয় বিধিনিষেধ, সামাজিক নিয়মনীতি, প্রথা পদ্ধতি, কুসংস্কার ও অলীক বিশ্বাস। আর এ বাধা দূর করতে হবে রাষ্ট্র তথা সরকারকেই। অ্যাডভোকেট শেখ সালাহ্উদ্দিন আহমেদ: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোটর্ ও সভাপতি, সাউথ এশিয়ান ল’ ইয়াসর্ ফোরাম