মহান নেতা বঙ্গবন্ধু

প্রকাশ | ১৯ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের মহানায়ক ও বাংলাদেশের স্থাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমার নেতা, আমার রাজনীতির হাতেখড়ি তার হাতে। আজীবন তার আদর্শে রাজনীতি করেছি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার অজস্র স্মৃতি। তার আমৃতু্য সংগ্রাম, অমিত সাহস, অতুলনীয় অর্জন ও উদাহরণযোগ্য ত্যাগের কথা আমাকে সর্বদা ভাবায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমন একজন নেতা, যার সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাসের সম্পর্ক গভীর। ঘাতকের বুলেট তাকে হত্যা করলেও সে সম্পর্ক মোটেই ছিন্ন করতে পারেনি। যত দিন যাচ্ছে, ততই ইতিহাসে তার নাম সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। ৬০-এর দশকে আমি সর্বপ্রথম কায়েদ-ই-আজম কলেজে (বর্তমানে সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ) ছাত্রলীগ থেকে জিএস নির্বাচিত হই। তখন থেকেই আমার নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সকালে আমরা বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি বাড়ির চারপাশে লোকে লোকারণ্য। আমরা নগর আওয়ামী লীগের নেতারাই বঙ্গবন্ধুকে রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় নিয়ে আসি। বঙ্গবন্ধু যখন ভাষণ দেন তখন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি গাজী গোলাম মোস্তফার সঙ্গে আমি মঞ্চের কোণায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। সেই ঐতিহাসিক দিনে উপস্থিত থাকতে পেরে নিজেকে সর্বদা ধন্য মনে করি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্কুলজীবনেই জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। কৈশোরে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র থাকার সময় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেওয়ায় প্রথম কারাবরণ করেন তিনি। ১৯৪৬ সালে তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর ঢাকায় ফিরে নতুন রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা নিয়ে অগ্রসর হন তিনি। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল 'আওয়ামী মুসলিম লীগ' গঠিত হলে তরুণ নেতা শেখ মুজিব দলটির যুগ্ম সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৫৩ সালে তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ সালে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় 'মুসলিম' শব্দ বাদ দিয়ে দলটির নামকরণ করা হয় 'আওয়ামী লীগ'। বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলন, আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এসব আন্দোলনের কারণে বারবার কারাগারেও যেতে হয় তাকে। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের মনোনয়নে ইস্ট বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। একই বছর যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় তাকে। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রম্নয়ারি লাহোরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন তথা বাঙালির মুক্তির সনদ ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তানের স্বৈরশাসক জেনারেল আইয়ুব খান ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুসহ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নামে আগরতলা মামলা করে তাদের কারাগারে পাঠান। ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক গণঅভু্যত্থানের মধ্যদিয়ে বাঙালি শেখ মুজিবকে কারামুক্ত করে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধি দিয়ে সম্মান্বিত করে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালি বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার পক্ষে অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের ম্যান্ডেট লাভ করে আওয়ামী লীগ। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এ বিজয় মেনে না নেওয়ায় শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসমুদ্রে ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, 'এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।' যার ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়। একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আক্রমণ শুরু করলে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাসভবন থেকে ওয়্যারলেসে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এরপর বঙ্গবন্ধুকে তার বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের আগে সর্বশেষ ২৫ তারিখ ও আমি বঙ্গবন্ধুর বাসায় গিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলে বললাম, লিডার একটু ক্যান্টনমেন্ট যাবো। এখানে বলে রাখি ক্যান্টমেন্টের সঙ্গে আমার ফার্নিচারের ব্যবসা ছিল। ইস্টার্ন ফার্নিচার নামে আমার একটি ফার্নিচারের প্রতিষ্ঠান ছিল। আমি ক্যান্টনমেন্ট গিয়েছিলাম ফার্নিচারের বিল আনতে। আমি ওই দিন ক্যান্টনমেন্টের পরিস্থিতি একটু অন্যরকম মনে হলো। ফিরে এসে বঙ্গবন্ধুর কাছে সংবাদটি পৌঁছেছিলাম। ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের মানচিত্রে অভু্যদয় ঘটে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে স্বদেশে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু। সদ্য স্বাধীন দেশের পুনর্গঠন ও পুনর্বাসন কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন ও জাতির অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে জাতীয় কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ১৫ আগস্টের কালরাতে নিজ বাসভবনে ঘাতকদের হাতে সপরিবারে নিহত হন। বঙ্গবন্ধুর সময়ে আমি ছিলাম ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ। নগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম কেমন চলছে? কীভাবে করলে ভালো হবে? কোথায় কি সমস্যা আছে? সেসব বিষয় নিয়ে আমরা (তৎকালিন নগর সভাপতি গাজী গোলাম মোস্তফা, সাধারণ সম্পাদক সুলতান, কোষাধক্ষ আমি আর কে চৌধুরীসহ অনেকে) নিয়মিত সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করতাম। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট সন্ধ্যার পর আমরা বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়িতে তার সঙ্গে বসি। আলোচনা হয় দীর্ঘসময় ধরে। আগের মতো বঙ্গবন্ধুর মধ্যে সেদিনও ছিল খুব প্রাণচাঞ্চলতা। বঙ্গবন্ধু কখনই ভাবেননি তার করা স্বাধীন বাংলাদেশে এমন কিছু ঘটবে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর ঘাতকরা তার ঘনিষ্ঠজনদের ওপর নির্যাতন চালায়। আমাকে হত্যা করার জন্য কয়েকবার আমার বাড়িতে আক্রমণ চালায়। তাদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে আমাকে ৬ মাস আত্মগোপনে থাকতে হয়। স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সাম্য ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় অবিস্মরণীয় ভূমিকার জন্য বঙ্গবন্ধু সারাবিশ্বে সমাদৃত। এসব ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য 'জুলিও কুরি' পদকে ভূষিত হন তিনি। এ ছাড়া বিবিসির এক জরিপে বঙ্গবন্ধু সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচিত হন। পরিশেষে বলছি, বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম মহানায়ক। সেরা মুক্তি সংগ্রামী, সেরা রাষ্ট্রনায়ক। জননন্দিত নেতা হিসেবে তার তুলনা ছিলেন তিনি নিজেই। দেশের মাটি ও মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা ও দায়বোধ তাকে মহীরুহে পরিণত করেছিল। ব্যক্তি শেখ মুজিব হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু। বাঙালি জাতি, বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু সমার্থক শব্দে পরিণত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং অস্তিত্বের শত্রম্নরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে প্রকারান্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকেই হত্যা করতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন কেউ বঙ্গবন্ধুর নাম বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে মুছতে পারবে না। বঙ্গবন্ধু অমর, তার মৃতু্য নেই। তিনি আছেন বাংলাদেশের প্রতিটি বাঙালির অন্তরে। আর কে চৌধুরী ঢাকা