ভোক্তা অধিকার হরণ

প্রকাশ | ১৯ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
ভোক্তা হলেন এমন ব্যক্তি যিনি পুনঃবিক্রয় ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য ছাড়া মূল্য পরিশোধে বা মূল্য পরিশোধের প্রতিশ্রম্নতিতে পণ্য ক্রয় করেন বা সেবা ক্রয় করেন। আর সঠিকভাবে পণ্য বা সেবা ক্রয় করার অধিকারই ভোক্তা অধিকার। বিশেষত দেশের সাধারণ জনগণ যারা টাকার বিনিময়ে দ্রব্য ক্রয় করে, চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করে, যানবাহনে যাতায়াত করে এরা সবাই ভোক্তা। এক কথায় দেশের সবাই ভোক্তা। কারণ সবাই কোনো না কোনোভাবে পণ্য এবং সেবা ক্রয় করে। অসাধু চক্রের হাত থেকে ভোক্তাদের রক্ষার্থে রয়েছে ভোক্তা অধিকার আইন। আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত ভোক্তা অধিকার হরণ হচ্ছে বিভিন্নভাবে। বর্তমানে তেলের দাম দেশের একেক জায়গায় একেক রকম নিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়ানোর ঘটনা দেশে প্রতি বছরই ঘটে। যে পেঁয়াজের দাম ২৫-৩০ টাকা কেজিপ্রতি সেই পেঁয়াজের দাম ৩০০-৪০০ টাকাও হয়েছে একসময় কিছু অসাধু ব্যবসায়ীদের চক্রান্তে। এটা ভোক্তা অধিকারের চরম পরিপন্থি। রমজান মাস আসার আগে প্রতি বছরে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়িয়ে দেয় অসাধু ব্যবসায়ীরা। সরকারের নির্ধারণ করে দেওয়া বিভিন্ন জিনিসের দাম মানের না তারা। সরকারি সিদ্ধান্তেরও কোনোরকম তোয়াক্কা করে না। এতে সাধারণ মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রতি বছর। করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়া সময়কালে গণপরিবহণে অর্ধেক যাত্রী নেওয়া এবং ভাড়া ৬০ ভাগ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। কিন্তু যে যার মতো করে দ্বিগুণ তিনগুণ ভাড়া নিয়েছে তখন?এ ছাড়া ঈদের সময় যখন গ্রামে যাওয়ার জন্য মানুষের ঢল নামে তখন ইচ্ছেমতো যানবাহনের ভাড়া বাড়িয়ে দেয় কিছু অসাধু মানুষ। এটা প্রতি বছরই হয়। আর ভাড়া আদায় নিয়ে গণপরিবহণে যাত্রীদের সঙ্গে বাস কর্তৃপক্ষ এবং কর্মচারীদের বাজে ব্যবহার তো নিত্যদিনের ঘটনা। সবচেয়ে বেশি বাজে ব্যবহারের শিকার হয় শিক্ষার্থীরা। অনেক সময় তাদের বিভিন্নভাবে হেনস্তা করা হয়। রেলে টিকিট কালোবাজারি হয়। যে কারণে যাত্রীরা অনেক সময় টিকিট পান না। দেশের হাসপাতালগুলোর অবস্থা আরও নিদারুণ। ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড ক্লিনিক সেন্টারে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ সংরক্ষণ, লাইসেন্স নবায়ন না করা ও সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি জীবাণু মুক্ত করার ব্যবস্থা না থাকাসহ আসন সীমার অতিরিক্ত রোগী ভর্তি করা জাতীয় সমস্যা তো অহরহ ঘটে চলেছে। এ ছাড়া যে কোনো পরীক্ষায় বেশি টাকা রাখা তো আছেই। ওষুধের দামও বেশি রাখা হয় মানুষভেদে। দেশের আনাচে-কানাচে গড়ে উঠেছে অসংখ্য বেকারি এবং খাবার তৈরির ফ্যাক্টরি। এসব জায়গায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবার তৈরি করা হয় এবং সেইসব খাবারের উৎপাদন এবং মেয়াদের বিষয়ে লেখা থাকে না। যে কারণে এসব খাবার খেয়ে প্রায়ই অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে মানুষ। অলিগলিতে রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে। এসব রেস্তোরাঁয় কয়েকদিনের বাসি খাবারও রাখা হয়। অনেক সময় দোকানদাররা ক্রেতাদের সঙ্গে বাজে ব্যবহার করে। মফস্বলে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আশপাশের খাবারের দোকান এবং রেস্তোরাঁগুলোর অবস্থা একদমই খারাপ। তারা প্রায়ই কয়েকদিনের বাসি খাবার ভালো খাবারের মধ্যে মিশিয়ে দেয়। খাবারের দাম ইচ্ছেমতো বাড়ায়। এই সবকিছুই ভোক্তা অধিকারের উলস্নঙ্ঘন। ভোক্তা অধিকার বিরোধী যে কোনো কাজই দন্ডনীয় অপরাধ। ভোক্তা অধিকার নিয়ে বিশ্বের সব দেশে কাজ করা হয়। ভোক্তা অধিকারবিরোধী কাজ করলে তাকে শাস্তি পেতে হয়। আমেরিকায় নব্বইয়ের দশকের একটি ঘটনা সম্পর্কে জানলে বোঝা যাবে উন্নত দেশগুলো ভোক্তা অধিকার সম্পর্কে কতটা সতর্ক। ১৯৯৪ সালে ইসা লিসবেক নামের এক মার্কিন নারীর শরীরে ম্যাকডোনাল্ডসের ৫০ সেন্টের কফি পড়ে যাওয়ার ঘটনায় ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে ছয় লাখ ডলার! শুধু স্বাভাবিক তাপমাত্রা থেকে অতিরিক্ত তাপমাত্রার কফি দেওয়ার অভিযোগে। (তথ্যসূত্র : প্রথম আলো, ১৫ মার্চ, ২০১৭) আর আমাদের দেশে তো প্রতিনিয়ত ভোক্তা অধিকারবিরোধী কাজ করছে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ সরকার ২০০৯ সালে জনগণের বহুল প্রতীক্ষিত জনবান্ধব আইন 'ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯' মহান সংসদে ২৬নং আইন হিসাবে পাস করে। আইন হয়েছে এবং কিছু ক্ষেত্রে প্রয়োগও হচ্ছে কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীদের কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। ২০০৯ সালে প্রণীত ভোক্তা অধিকার আইনে মোট ৮২টি ধারা রয়েছে। এ ছাড়া কয়েকটি ধারার উপধারা রয়েছে। ৩৭ ধারা মোতাবেক কোন ব্যক্তি কোন আইন বা বিধি দ্বারা কোন পণ্য মোড়কাবদ্ধভাবে বিক্রয় করার এবং মোড়কের গায়ে সংশ্লিষ্ট পণ্যের ওজন, পরিমাণ, উপাদান, ব্যবহারবিধি, সর্বোচ্চ খুচরা বিক্রয়মূল্য, উৎপাদনের তারিখ, প্যাকেটজাতকরণের তারিখ এবং মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ স্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ করার বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করে থাকলে তিনি অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদন্ড বা অনধিক পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। ৩৯ ধারা মোতাবেক কোন ব্যক্তি আইন বা বিধি দ্বারা আরোপিত বাধ্যবাধকতা অমান্য করে তার দোকান বা প্রতিষ্ঠানের সেবার মূল্যের তালিকা সংরক্ষণ না করলে এবং সংশ্লিষ্ট স্থানে বা সহজে দৃশ্যমান কোন স্থানে উক্ত তালিকা প্রদর্শন না করলে তিনি অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদন্ড, বা অনধিক পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। ৪০ ধারা মোতাবেক কোন ব্যক্তি কোন আইন বা বিধির অধীন নির্ধারিত মূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্যে কোনো পণ্য, ওষুধ বা সেবা বিক্রয় বা বিক্রয়ের প্রস্তাব করলে তিনি অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদন্ড বা অনধিক পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। ৪২ ধারা অনুযায়ী মানুষের জীবন বা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক কোন দ্রব্য, কোন খাদ্যপণ্যের মিশ্রণ কোন আইন বা বিধির অধীন নিষিদ্ধ করা হয়েছে, কোন ব্যক্তি উক্তরূপ দ্রব্য কোন খাদ্যপণ্যের সঙ্গে মিশ্রিত করলে তিনি অনূর্ধ্ব তিন বছর কারাদন্ড বা অনধিক দুই লাখ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। ৫১ ধারা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি মেয়াদোত্তীর্ণ কোনো পণ্য বা ওষুধ বিক্রয় করলে বা করতে প্রস্তাব করলে তিনি অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদন্ড বা অনধিক পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। পণ্য বা সেবা কিনে কেউ প্রতারিত হলে যে কেউ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ পরিষদে মামলা দায়ের করতে পারবে। এবং এই প্রক্রিয়া খুবই সহজ। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে সরাসরি ই-মেইলের (হপপপ-ফহপৎঢ়.মড়া.নফ) মাধ্যমেও অভিযোগ করা যায়। ই-মেইলে অভিযোগকারীর নাম, পিতা-মাতার নাম, ঠিকানা, ফোন, জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর, অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান ও ঘটনার বিবরণ এবং প্রমাণস্বরূপ পণ্য ক্রয়ের রসিদের ছবি সংযুক্ত করতে হবে। আবার কেউ চাইলে ০১৭৭৭৭৫৩৬৬৮ ও ০৩১-৭৪১২১২ নম্বরে কল দিয়েও অভিযোগ জানাতে পারবে। এরপর তদন্ত শেষে অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেলে যে আর্থিক জরিমানা করা হবে, তার ২৫ শতাংশ অভিযোগকারী ভোক্তাকে ক্ষতিপূরণ বাবদ দেওয়া হবে। তবে অভিযোগটি পণ্য কেনার ৩০ দিনের মধ্যে দায়ের করতে হবে। ভোক্তা অধিকার আইন রয়েছে। কর্তৃপক্ষ চেষ্টাও করছে যাতে ভোক্তার অধিকার হরণ না হয়। কিন্তু অসাধু লোকজনকে কোনোভাবেই দমানো যাচ্ছে না। এ জন্য শুধু আইন এবং বিচার করে কাজ হবে না। ভোক্তার অধিকার সমুন্নত রাখতে প্রয়োজন সর্বস্তরের মানুষের এ বিষয়ে সচেতনতা। সরকারের উচিত ভোক্তা অধিকার পরিষদের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভোক্তা অধিকার বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা। তাহলেই খাদ্য ভেজাল মুক্ত হবে এবং সঠিক সেবা পাবে ভোক্তারা। সুকান্ত দাস শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া