শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

হে স্বাধীনতা তোমার চেতনায় ঋদ্ধ করো

সাধন সরকার
  ২৮ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

'স্বাধীনতা' শুধু একটি শব্দ নয়, এর বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। স্বাধীনতা মানে সত্য ও সুন্দরের পথে চলা। চিন্তা ও মতপ্রকাশে স্বাধীন, অনিয়মের বিরুদ্ধে শুভবোধ জাগ্রত করার অধিকার, সর্বদা ভালো কাজ করা ও ভালো কাজ করতে দেওয়ার অধিকারই স্বাধীনতা। সময়, স্থান ও ক্ষেত্রবিশেষে স্বাধীনতা শব্দটি বিশেষ বিশেষ অর্থ বহন করে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার অর্থ আর স্বাধীন দেশে তথা বর্তমান সময়ে স্বাধীনতার অর্থের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। একজন নারীর কাছে স্বাধীনতা হলো পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি থেকে মুক্তি। একজন কৃষকের কাছে স্বাধীনতা হলো ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়া। বাস্তবতার জাঁতাকলে পিষ্ট বাল্যবিয়ের শিকার হওয়া একজন নারীর কাছে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার স্বাধীনতা অনেক বেশি অর্থবহুল। একজন পথশিশুর পড়ালেখার অধিকার বা স্বাধীনতা তার কাছে সবচেয়ে দামি। শেয়ারবাজারে কারবার করা একজন বিনিয়োগকারী অবশ্যই এ স্বাধীনতা পাওয়ার অধিকার রাখে যে; হঠাৎ করে সে সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাবে না। একজন দুধ বিক্রেতা দুধের ন্যায্য দাম পাওয়ার অধিকার রাখে। একজন নারী তার পোশাকের কারণে রাস্তাঘাটে কটু কথা বা নেতিবাচক আচরণের শিকার হবে না- এটা একজন নারীর অধিকার। পড়ালেখা শেষ করা একজন তরুণ চাকরি করতে এসে ঘুষ-দুর্নীতি-হয়রানির শিকার হবে না- এটা একজন তরুণের অধিকার। হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজতে থাকা একজন বেকার যুবকের অবশ্যই নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য তথা উদ্যোক্তা বা ভিন্ন কিছু হওয়ার জন্য রাষ্ট্র থেকে সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা বলে, উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য বেকার তরুণদের পদে পদে বাধার সম্মুখীন হতে হয়। একজন স্বাধীন নাগরিককে অন্যের অপকর্মের দায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে হয়রানি না হওয়ার অর্থ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। হাসপাতালে সেবা নিতে এসে চিকিৎসা শেষে বিলের নামে গরিব রোগীর 'গলাকাটা' হবে না- স্বাধীন দেশে এমন স্বাধীনতা ভোগ করার অধিকার গরিব জনগণের রয়েছে।

জীবনে স্বাধীনতা যেমন দরকার আছে, তেমনি স্বাধীনতার মান রক্ষা করা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচারিতা নয়, স্বাধীনতা হলো নিজের বিবেক আর সুইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। স্বাধীনতা মানে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা, অনিয়মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। স্বাধীনতা মানে অন্যের উপকারে আসা, অপরের প্রতি মার্জিত ও রুচিশীল ব্যবহার। স্বাধীনতা মানে ক্ষমতা বলে অন্যের অধিকার কেড়ে নেওয়া নয়। স্বাধীনতা মানে গরিব, প্রান্তিক মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের ন্যায্য অধিকারের কথা বলা। যুক্তির আলোয় মুক্তির সন্ধান করা মানুষের নিজের মতামত প্রকাশ বা চিন্তাকে বাধাগ্রস্ত করার নাম স্বাধীনতা নয়। স্বাধীনতা মানে স্বাধীন চেতনায় বাস করা। অন্যের মতামত বা ভিন্নমত দমন করা নয়, স্বাধীনতা মানে অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। স্বাধীনতা মানে ধর্মকে ব্যবহার করে ফায়দা লোটা নয়, স্বাধীনতা মানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর চাপ প্রয়োগ নয়, স্বাধীনতা মানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিকের সমান অধিকার। দুই-তিন দশক আগেও একটি রাষ্ট্রে যে অনিয়ম, দুর্নীতি, অপকর্ম, ভিন্নমত দমন, সংখ্যালঘু নির্যাতন, গুম ও ক্ষমতার অপব্যবহার হতো দুই-তিন দশক পরেও যদি একইভাবে বা ভিন্নভাবে ওইসব অব্যবস্থাপনা চলতে থাকে তাহলে বুঝতে হবে স্বাধীনতার অর্থ জনগণের কাছে পৌঁছায়নি। একজন বয়স্ক ব্যক্তির বয়স্ক ভাতার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘোরার নাম স্বাধীনতা নয়। স্বাধীনতা হলো রাষ্ট্রপ্রদত্ত অধিকার সঠিকভাবে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া।

স্বাধীনতা মানে পরাধীনতার শিখলে বন্দি থাকা নয়, স্বাধীনতা মানে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া। একজন বেকার তরুণ যদি চাকরি না পেয়ে, পরিবারের আশা পূরণ করতে না পেরে পদে পদে বাধার সম্মুখীন হয়ে আত্মহত্যার মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় তাহলে বুঝতে হবে পরিপূর্ণ স্বাধীনতার স্বাদ সবার জন্য সমান হয়ে ওঠেনি। স্বাধীনতা মানে বেকার তরুণদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। স্বাধীনতা মানে দলীয়করণ নয়, পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে জনগণকে বোকা বানানো নয়। স্বাধীনতা মানে নিরপেক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করা। স্বাধীনতা মানে জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটানো। স্বাধীনতা মানে শিক্ষার সঙ্গে বাস্তবের সম্মিলন ঘটানো। স্বাধীনতা মানে একই রাষ্ট্রে একই ধরনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার ভোগ করা। স্বাধীনতা মানে সুশাসন। স্বাধীনতা মানে দেশের ঊর্ধ্বে রাজনীতি নয়, রাজনীতির ঊর্ধ্বে দেশ।

বাঙালির জাতীয় জীবনে মার্চ মাসের বিশেষ তাৎপর্য ব্যাপক। ৭ মার্চের ভাষণে এসেছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বপ্রস্তুতির ডাক। ২৫ মার্চ রাতে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা চালিয়েও পাকিস্তানিরা বাঙালি জাতিকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। ২৩ বছরের শোষণ ও বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে বাঙালিরা বদলা ও বদল দুটোই চেয়েছিল। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে মধ্যদিয়ে এসেছিল সেই কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। স্বাধীনতার চেতনা আমাদের কাছে অনন্ত প্রেরণা। যে প্রেরণা তরুণ প্রজন্মকে নিষ্ঠার পথে নিয়ে যায়। যে প্রেরণা তরুণ সমাজকে সকল প্রকার অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা থেকে দূরে রাখে। যে প্রেরণায় ঋদ্ধ হয়ে তরুণসমাজ মন্দকে মন্দ আর ভালোকে ভালো বলার দীক্ষা নেয়। বর্তমান তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি কিন্তু তাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কোনো ঘাটতি নেই। দেশপ্রেমের মশাল জ্বেলে তরুণরাই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এই তরুণরাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শাহবাগে গর্জে উঠেছিল। এই তরুণরাই নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজপথে ফুঁসে উঠেছিল।

স্বাধীনতা যুদ্ধ আর মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে অর্থগত কিছুটা পার্থক্য বিদ্যমান। স্বাধীন হওয়ার জন্য যুদ্ধ শেষ হলেও মুক্তির সংগ্রাম এখনো চলছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ৫৩ বছর পার হতে চলেছে। দেশের জনগণই দেশটাকে একটু একটু করে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বোধ করি তবে দেশটা আরও এগিয়ে যেতে পারত! ঘুষ-দুর্নীতির প্রসার, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব দেশটাকে পেছনে ঠেলে দিচ্ছে! সার্বিকভাবে তরুণরাই দেশের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। অন্যথায় এত স্বল্প সময়ে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হতে পারত না। আবার বর্তমান তরুণ প্রজন্মের একাংশ ক্ষমতার দম্ভে নিজেদের স্বার্থ কায়েমে ব্যস্ত। সমাজের এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে যেন দেশপ্রেমের ছিটেফোঁটাও নেই! নদী ও বন দখলকারীদের তালিকা প্রকাশ হলেও নদী ও বনখেকোরা এখনো বীরদর্পে প্রকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আইন থাকা সত্ত্বেও আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ায় দেশের টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে। এখনো গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে হচ্ছে। ভিন্ন মতপ্রকাশের দরুণ জনৈক ব্যক্তির ওপর কখনো কখনো নেমে আসছে অজানা দুঃসংবাদ। মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পথে এগিয়ে চলেছে দেশ। কিন্তু স্বাধীনতার স্বাদ পেলেও সর্বক্ষেত্রে মুক্তি মেলেনি। উন্নয়নের পাশাপাশি বেড়ে চলেছে বৈষম্য। ধনীরা আরও ধনী আর গরিবরা আরও বেশি গরিব হচ্ছে! হাড়ভাঙা খাটুনি করে পোশাকশ্রমিক ও প্রবাসীশ্রমিকরাই এই দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এ দেশটা সবার। দেশে সর্বক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা যত বজায় থাকবে দেশটা তত এগিয়ে যাবে। মুক্তিযুদ্ধের চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র পুরোপুরি বাস্তবায়ন যখন হবে তখনই কেবল প্রকৃতপক্ষে মুক্তি মিলবে। উন্নত সোনার বাংলা গড়তে হলে স্বাধীনতার চেতনায় তরুণসমাজের পাশাপাশি সবাইকে ঋদ্ধ হতে হবে। হে স্বাধীনতা তোমার চেতনায় ঋদ্ধ করো।

সাধন সরকার

শিক্ষক, লৌহজং বালিকা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মুন্সীগঞ্জ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে