অনন্য উচ্চতায় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

প্রকাশ | ২৮ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

দিলীপ কুমার আগরওয়ালা
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সহযোগিতার ক্ষেত্র ক্রমেই সম্প্রসারিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আরেকটি মাইলফলক অগ্রগতি সূচিত হয়েছে গত শনিবার। এদিন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে 'ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইন' উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের পরপরই আসামের নুমালিগড় থেকে বাংলাদেশের দিনাজপুরের পার্বতীপুরের ডিপোতে ডিজেল আসা শুরু হয়েছে। এই পাইপলাইনের মাধ্যমে ভারত থেকে বাংলাদেশ বছরে প্রায় ১০ লাখ টন তেল আমদানি করতে পারবে। এতে সড়ক বা রেলপথে তেল পরিবহণে যে বিপুল ব্যয় ও সময়ের প্রয়োজন হয়, তা সাশ্রয় হবে। ফলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলায় ডিজেলের স্থিতিশীল সরবরাহ নিশ্চিত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে দুই দেশই কীভাবে উপকৃত হতে পারে, একের পর এক তারই নজির সৃষ্টি হচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং রাশিয়ার ওপর পাশ্চাত্যের নিষেধাজ্ঞার কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। অনেক দেশই প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেল সংগ্রহ করতে পারছে না। বাংলাদেশে প্রতিবছর ৭০ থেকে ৭২ লাখ মেট্রিক টন জ্বালানি তেলের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে শুধু ডিজেলেরই চাহিদা রয়েছে ৪৮ থেকে ৪৯ লাখ মেট্রিক টন, যার ৮০ শতাংশই সরকারকে বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই পরিমাণ জ্বালানি তেল আমদানি করা রীতিমতো দুরূহ হয়ে উঠেছে। তদুপরি আমদানি করা তেল পরিবহণে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। সময়ও লাগছে অনেক বেশি। এমন পরিস্থিতিতে কম খরচে নতুন উৎস থেকে ডিজেল আমদানির পথ খুঁজছিল সরকার। ভারত থেকে পাইপলাইনে ডিজেল আমদানি সেই বিকল্প উৎস হিসেবেই কাজ করবে। আগে ভারত থেকে জ্বালানি তেল আসত মূলত রেলপথে। বছরে আমদানি করা তেলের পরিমাণ ছিল ৬০ থেকে ৮০ হাজার টন, যা আমাদের জ্বালানি চাহিদায় বিশেষ কোনো ভূমিকাই রাখত না। আবার জাহাজে আসা তেল চট্টগ্রাম বা মোংলা থেকে সড়ক বা নদীপথে উত্তরবঙ্গ পর্যন্ত নিয়ে যেতেও অনেক সময় ও অর্থের প্রয়োজন হতো। এখন তা অনেক সাশ্রয়ী হবে। উভয় দেশ শুধু নয়, নেপাল, ভুটানসহ উপ-আঞ্চলিক সমৃদ্ধির জন্যও পারস্পরিক সহযোগিতা একান্তভাবে প্রয়োজন। বাংলাদেশ ভারত থেকে বর্তমানে এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদু্যৎ আমদানি করছে। ভারতের ভূখন্ডের ওপর দিয়ে নেপাল ও ভুটান থেকে বিদু্যৎ আমদানির প্রক্রিয়া চলছে। অন্যদিকে সমুদ্রসংযোগহীন দেশ দুটি ভারতীয় ভূখন্ডের ওপর দিয়ে বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর ব্যবহারে আগ্রহী। ভারত বাংলাদেশে ট্রানজিট সুবিধা পাচ্ছে। উপ-আঞ্চলিক জোট বিবিআইএনভুক্ত চারটি দেশই অদূর ভবিষ্যতে উন্নততর কানেক্টিভিটির আওতায় আসবে, এমনটিই আশা করা হচ্ছে। এতে সব ক'টি দেশই ব্যাপকভাবে উপকৃত হবে। বর্তমান যুগে একা চলার কিংবা দ্বার রুদ্ধ করে বসে থাকার কোনো সুযোগ নেই। আমরা আশা করি মৈত্রী পাইপলাইনের মতো অদূর ভবিষ্যতে আরও অনেক দৃষ্টান্ত স্থাপিত হবে। কানেক্টিভিটির প্রতিটি স্তম্ভ ক্রমান্বয়ে আরও শক্তিশালী হবে। উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা আরও বাড়াতে দেশগুলোর মধ্যে থাকা সমস্যাগুলো আলোচনার মাধ্যমে দ্রম্নত সমাধান করতে হবে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক এখন অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে ভালো। আর সে কারণেই দুই দেশের মধ্যকার সহযোগিতামূলক সম্পর্ক দ্রম্নত এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের মধ্যদিয়ে সহযোগিতার সেই সম্পর্ক নতুন গতি পেয়েছে। বাংলাদেশের নিকটতম ও বৃহত্তম প্রতিবেশী ভারত। রয়েছে বৃহত্তম স্থল ও জল সীমান্ত। নিকট অতীতে ছিটমহলসহ স্থল ও জল সীমান্তের অনেক বিরোধ আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে সমাধান হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে অর্ধশতাধিক অভিন্ন নদী রয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারত দক্ষিণ এশিয়ার দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র। দুটি দেশ একই সঙ্গে সার্ক, বিমসটেক, আইওয়া এবং কমনওয়েলথের সাধারণ সদস্য। বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যে বাংলা ভাষা ব্যবহার হয়ে থাকে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় দুই দেশের মধ্যে শক্তিশালী জোটের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশেষ করে যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের এক কোটি উদ্বাস্তুকে আশ্রয়দান ও স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ ২৫ বছরমেয়াদি বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি, ১৯৭৪ সালের ১৬ মে মুজিব-ইন্দিরা সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক উদারীকরণের সূত্রপাতের সঙ্গে তা বৃহত্তর প্রবৃদ্ধি ও বাণিজ্যের উদ্ভব ঘটায়। বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশই সন্ত্রাসবাদবিরোধী কৌশলগত অংশীদার হিসেবে ভূমিকা রাখছে। তারা দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় এলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে নবদিগন্তের সূচনা হয়। বন্ধুদেশ হিসেবে ব্যবসায়িক সুযোগ সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিক যোগাযোগ বাড়াতে সক্ষম হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর নয়াদিলিস্নর হায়দরাবাদ হাউসে দেশ দুটির মধ্যে ৩০ বছরমেয়াদি গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশ ও ভারতের বর্তমান সম্পর্ককে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার রোল মডেল হিসেবে আখ্যায়িত করা চলে। বাংলাদেশে ভারতের সম্পর্ক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। বন্ধুপ্রতিম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বিদ্যমান। মাঝেমধ্যে দুই দেশের সম্পর্কে স্থবিরতা বিরাজ করলেও উভয় দেশের সহযোগিতায় তা আবারও বেগবান হয়েছে। অস্বীকার করা যাবে না, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ঐতিহাসিক ভিত্তি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ যা অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রীয় চেতনাকে বেগবান করা। ফলে দুই দেশের নীতি-নির্ধারকদের কাছে সম্পর্কের আস্থা সুসংহত করে বিদ্যমান বিরোধগুলোকে সহনশীল মাত্রায় নামিয়ে আনা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এর পরিপ্রেক্ষিতে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বেশকিছু অমীমাংসিত ইসু্যতে উভয় দেশ একমত হয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক স্মরণকালের মধ্যে এখন উষ্ণতম। দীর্ঘদিন অমীমাংসিত থাকা প্রধান প্রধান দ্বিপক্ষীয় সমস্যার সমাধান হয়েছে। দুই দেশ সহযোগিতার নতুন এক কাল অতিক্রম করছে। সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ঢাকা-নয়াদিলিস্ন-ঢাকা মডেল স্থাপন করেছে। নতুন উচ্চতায় উন্নীত এই সম্পর্ক দুই দেশের মানুষের জন্যই বড় আশাব্যঞ্জক। দিলীপ কুমার আগরওয়ালা পরিচালক, এফবিসিসিআই