প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা

প্রকাশ | ২১ মে ২০২৩, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
পরিবেশ বিপর্যয় ও দুর্যোগগত সমস্যা সামগ্রিকভাবে একটি দেশের জাতীয় সমস্যা। কাজেই ওই সমস্যা থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করার জন্য কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা বিশেষ আইনই যথেষ্ট নয়। এ ক্ষেত্রে যা দরকার তা হলো দেশের প্রতিটি মানুষের সঠিক চেতনাবোধ ও সচেতনতা। দেশের প্রতিটি মানুষ যদি পরিবেশ বিপর্যয়ের সমস্যা সম্পর্কে সচেতন হন, তা হলে পরিবেশ বিপর্যয় ও যে কোনো রকমের দুর্যোগের কবল থেকে অতি সহজেই নিজেদের অস্তিত্বকে রক্ষা করা সম্ভব, যা অধিক জরুরি। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মতো এমন নিঃশব্দ শত্রম্নর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে আমাদের এখনই উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি উপকূলীয় জনপদ রক্ষায় স্থানীয় প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসতে হবে। প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড়ের সময় সাইক্লোন শেল্টার বৃদ্ধি করা হবে বা মানসম্মত করে তৈরি করা হবে- এমন আশ্বাস দেওয়া হলেও বেশির ভাগ জায়গায় তা কার্যকর হয় না। দেখা যায়, দুর্যোগকালীন নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে সব খাবার পানির পুকুর বা টিউবওয়েল ডুবে যায়। এতে ওই সময়কালে তীব্র খাবার পানির সংকট দেখা যায়। প্রতিবছর এ উপকূল বিধ্বস্ত হয় কিন্তু আজও তার কোনো স্থায়ী সমাধান মেলেনি, যা দুঃখজনক। সরকারি কর্মপরিকল্পনার কৌশল পরিবর্তন ছাড়া কোনোভাবেই এসব কাজের অগ্রগতি সম্ভব নয়। বরং এভাবে কাজের গতি হেলায় হারাতে বসলে একটি সময় এ দেশের মানচিত্র থেকে এসব অঞ্চল বিলীন হয়ে যাবে; যা আমাদের দেশ ও দশের উন্নয়নে বড় সংকট তৈরি করবে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে উপকূলজুড়ে পরিবেশবিরোধী উন্নয়ন পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন কল-কারখানা গড়ে তোলার জন্য শিল্পপতিরাও এখন উপকূলকে বেঁচে নিচ্ছেন; যা আমাদের পরিবেশকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এদিকে প্রতিবছর জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের যে টাকা উপকূলে বরাদ্দ হচ্ছে তা অপ্রতুল। আর যা আসছে তাতেও নামমাত্র কাজ হচ্ছে; এর সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না। এর ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় ১৯টি জেলায় বসবাসরত মানুষ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রতিকারে দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহণ করা অধিক জরুরি। যদিও ভাবতে কষ্ট লাগে, যখন দেখি আমাদের পাশের দেশগুলো নিজেদের ও তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য উপযোগী বাসযোগ্য পরিবেশ নিশ্চিত করতে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় তারা তাদের জনগণকে অধিক সচেতন করে তুলতে নানা ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে, সেখানে আমরা নিজেদের অধিক উদাসীনতা ও কর্তৃপক্ষের চরম অব্যবস্থাপনার কারণে পৃথিবীর অন্যান্য দুর্যোগপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করছি। যা নিজেদের জন্য তো বটেই, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও ভয়াবহ হুমকির কারণ বলে মনে করছি। বর্তমানে দেশের ভৌগোলিক অবস্থা, নিকটবর্তী দেশগুলোর দ্বারা অধিক হারে পরিবেশ দূষণ ও আগ্রাসন, দুর্যোগ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় আধুনিক উপকরণের স্বল্পতা, অভিজ্ঞ ও দক্ষ জনবলের ঘাটতি, পরিবেশ রক্ষায় নিজেদের অধিক অবহেলা ও অসচেতনতা, সংশ্লিষ্টদের চরম অব্যবস্থাপনা ও ব্যর্থতা, দুর্যোগ মোকাবিলায় জনগণকে অধিক সচেতন ও দক্ষ করে তৈরি করার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পরিবেশগত জ্ঞান, প্রশিক্ষণ ও কর্মসূচির স্বল্পতা, পরিবেশবিষয়ক গবেষণা ও উচ্চশিক্ষা গ্রহণে শিক্ষার্থীদের অধিক আগ্রহহীনতা, মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যসূচিতে ওই বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব কম দেওয়া, শিক্ষার্থীদের পরিবেশবান্ধব শিক্ষাদানে এ দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিক অনীহা, অতীতের দুর্যোগের তান্ডবলীলা থেকে শিক্ষা নিয়ে তা প্রতিরোধে নিজেদের পূর্বপ্রস্তুতি রাখার ক্ষেত্রে অধিক উদাসীনতা ও ব্যর্থতা, দুর্যোগ মোকাবিলায় অন্যের সাহায্যের ওপর অধিক নির্ভরশীলতা, দুর্যোগের ক্ষতিকে নিয়তি ও ভাগ্যের দোহাই দিয়ে নিজেদের অক্ষমতাকে ঢাকার হীনপ্রবণতা, দরিদ্রতা, সময়ের কাজ সময়মতো না করার অধিক প্রবণতা, অধিকাংশ কাজ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অধিক সমন্বয়হীনতা, এক সরকারের গৃহীত উন্নয়ন প্রকল্প অন্য সরকার কর্তৃক বন্ধ করা, নদ-নদী ভরাট করে অধিক লোভে ইমারত নির্মাণ করা হচ্ছে। কারণে অকারণে বৃক্ষ নিধন করে একের পর এক বন উজাড় করা হচ্ছে। এরই সঙ্গে আবার যুক্ত হয়েছে দেশে অপরিকল্পিত অধিক জনসংখ্যা, ব্যাপক দরিদ্রতা, অজ্ঞতা, অশিক্ষা, অর্থনৈতিক দুরবস্থা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, কৃষি জমিতে অত্যাধিক রাসায়নিক ও কীটনাশক সার ব্যবহারের প্রবণতা, অপরিকল্পিতভাবে শিল্প-কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য নির্গমন, অপরিকল্পিত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, ভূগর্ভস্থ পানির অধিক ব্যবহার, সামাজিক অনগ্রসরতাসহ পরিবেশ বিষয়ে অধিক জনসচেতনতার অভাব যা কিনা এখানকার পরিবেশকে ক্রমাগত আরও অবনতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়। কিন্তু নিজেদের একটু সচেতনতা, সজাগ দৃষ্টি ও সদিচ্ছাই পারে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে। কেননা আমরা চাইলেই অহেতুক বৃক্ষ নিধন বন্ধ করে ষোলো কোটি মানুষ ষোলো কোটি গাছ লাগিয়ে গ্রিন হাউস অ্যাফেক্টের সর্বনাশা থাবা থেকে কিছুটা হলেও পারি নিজের ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে। এ ক্ষেত্রে শুধু প্রয়োজন নিজেদের অধিক সদিচ্ছা, যা পরিবেশের ভারসাম্য ও বিপর্যয় রোধে অধিক জরুরি বলে মনে করি। যদিও বলা বাহুল্য, বিভিন্ন সরকারের আমলে আমরা দেখেছি সংশ্লিষ্টদের ওই কাজে অধিক ব্যর্থতা এবং সময়ের কাজ সময়মতো না করার অধিক প্রবণতা যা এ দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা ও ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ আরও ভয়াবহ ও তীব্রতর করেছে, যা অধিক বেদনাদায়ক। এখনো যদি আমরা দ্রম্নত প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারি, তবে এর পরিণতি হবে সবার জন্যই অধিক ভয়াবহ। যা বহন করার শক্তি ও সমর্থন তখন হয়তো কারও নাও থাকতে পারে। তাই যত দ্রম্নত সম্ভব প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় পরিবেশের ভারসাম্য ও দূষণ রোধে সম্ভাব্য সব ধরনের উপায় চিহ্নিতকরণ এবং ওই বিষয় সম্পর্কে দেশের প্রতিটি জনগণকে সমানভাবে সচেতন ও দায়িত্বশীলকরণ অধিক জরুরি বলে মনে করি। ঠিক অনুরূপভাবে সরকারকে দেশে পরিকল্পিত ও শক্তিশালী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাঠামো গড়ে তোলার ব্যাপারে অধিক গুরুত্বারোপ করাটাকেও অধিক জরুরি বলে মনে করি। প্রায় প্রতি বছরই বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ সাইক্লোন, টর্নেডো ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, খরা, ভূমিকম্প, ভূমি ও পাহাড় ধস, অগ্নিকান্ড, নদীভাঙন ইত্যাদি এ দেশের জনগণের জীবন-জীবিকা, সহায়-সম্পদ, রাষ্ট্রীয় সম্পদসহ পরিবেশের বিপুল ক্ষতিসাধন করছে। এতে রাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণ অর্থ কেবল ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে খরচ হিসেবে ব্যয় করা হচ্ছে যা দেশের অন্যান্য উন্নয়ন কর্মকান্ডকে বাধাগ্রস্ত করছে। এ ক্ষেত্রে সরকার যদি এ ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় দুর্যোগ ঘটার আগেই তা প্রতিরোধে গুরুত্ব বুঝে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন তাহলে অধিক সুফল পাওয়া যাবে। এতে একদিকে সরকারের অর্থের অপচয় যেমন রোধ করা সম্ভব হবে, ঠিক তেমনি স্থায়ীভাবে দুর্যোগ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হবে। যদিও এ কথাটি সত্য, এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করা সরকার তথা কারও একার পক্ষে কখনই সম্ভব নয়, যদি না জনগণ ওই কাজে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ না করে। এ ক্ষেত্রে সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রাণালয়কে যেমন দুর্যোগ প্রতিরোধে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে, ঠিক তেমনি যে কোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রতিটি জনগণকে সময়মতো পূর্বপ্রস্তুতি ও সচেতন করে গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। যদিও এ কথাটি চরম সত্য, পরিবেশ বিপর্যয় ও দুর্যোগগত সমস্যা সামগ্রিকভাবে একটি দেশের জাতীয় সমস্যা। কাজেই ওই সমস্যা থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করার জন্য কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা বিশেষ আইনই যথেষ্ট নয়। এ ক্ষেত্রে যা দরকার তা হলো দেশের প্রতিটি মানুষের সঠিক চেতনাবোধ। দেশের প্রতিটি মানুষ যদি পরিবেশ বিপর্যয়ের সমস্যা সম্পর্কে সচেতন হন, তা হলে পরিবেশ বিপর্যয় ও যে কোনো রকমের দুর্যোগের কবল থেকে আমরা অতি সহজেই নিজেদের অস্তিত্বকে রক্ষা করতে পারব, যা অধিক জরুরি। বর্তমান বাস্তবতায় উপকূলজুড়ে যে সংকট রয়েছে তা নিরসনে দ্রম্নত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এসব সমস্যার স্থায়ী সমাধানে সরকারকে আরও বেশি উদ্যোগী এবং আন্তরিক হতে হবে। বিশেষ করে বহু দিনের দাবি টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ এবং সুপেয় পানি নিশ্চিত করে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি উপকূলীয় অঞ্চলের সঙ্গে অন্যান্য অঞ্চলের চিকিৎসা ব্যবস্থা এক না রেখে ঘূর্ণিঝড় বা বন্যার কথা চিন্তা করে চিকিৎসাব্যবস্থায় ভিন্নতা আনতে হবে। সর্বোপরি শুধু দুর্যোগকালীন তাদের বাঁচাতে কাজ না করে পূর্ব-প্রস্তুতিমূলক তাদের বসত-ভিটা, ঘর-বাড়ি, জমি-জমা রক্ষার বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মতো এমন নিঃশব্দ শত্রম্নর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে আমাদের এখনই উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। তাই যত দ্রম্নত সম্ভব সরকারের উচিত হবে নিজেদের দক্ষতা, সততা ও বিশেষজ্ঞদের ধ্যান-ধারণাকে নিয়ে সমন্বিত প্রশাসনিক পদক্ষেপকে যথাযথ কাজে লাগিয়ে আমাদের এ বিপন্ন পরিবেশের মরণ ছোবল থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করা এবং নিজেদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য নিরাপদ ও সুন্দর স্বদেশ ভূমি নিশ্চিত করা। যা আমাদের সবার জন্যই অধিক জরুরি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকার তথা এ দেশের প্রতিটি জনগণের ভেতর সেই চেতনাবোধ ও অধিক সদিচ্ছা জাগ্রত হোক এমনটিই প্রত্যাশা করি। মো. আতিকুর রহমান ঢাকা