কমিউনিটি ক্লিনিকের জাতিসংঘের স্বীকৃতি এক অনন্য অর্জন

গ্রামীণ দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বর্তমান সরকার সারাদেশে ১৮ হাজার ৫০০টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করেছে- যার মাধ্যমে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ঘরের দোরগোড়ায় বসে প্রাথমিক বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন।

প্রকাশ | ২৩ মে ২০২৩, ০০:০০

মো. খসরু চৌধুরী
বাংলাদেশের কমিউনিটি ক্লিনিকভিত্তিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেয়েছে। দেশের তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে কমিউনিটি ক্লিনিককে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনন্য উদ্ভাবন বলে ভাবা হয়। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর ২০০০ সালে চালু হয় স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করার ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত জোটের আমলে প্রতিহিংসার শিকার হয় কমিউনিটি ক্লিনিক কর্মসূচি। বন্ধ করে দেওয়া হয় কয়েক কোটি মানুষকে সেবাদানের বৈপস্নবিক এ ব্যবস্থা। ২০০৯ সালে পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর দেশজুড়ে চালু হয় কমিউনিটি ক্লিনিক। গত ১৬ মে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে কমিউনিটিভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবাবিষয়ক একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে। 'কমিউনিটিভিত্তিক প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা : সর্বজনীন স্বাস্থ্যপরিষেবা অর্জনের লক্ষ্যে একটি অংশগ্রহণমূলক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতি' শিরোনামে গৃহীত এ প্রস্তাবটি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিতে বাংলাদেশে কমিউনিটি ক্লিনিকভিত্তিক মডেল প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অসামান্য উদ্ভাবনী নেতৃত্বের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হিসেবে দেখা হচ্ছে। বাংলাদেশ কর্তৃক উত্থাপিত প্রস্তাবে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফল উদ্ভাবনী উদ্যোগের স্বীকৃতি দিয়ে এ উদ্যোগকে 'দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ' হিসেবে উলেস্নখ করেছে। প্রস্তাবটি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে উত্থাপন করেন বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি। কমিউনিটি ক্লিনিকভিত্তিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থনস্বরূপ জাতিসংঘের ৭০টি সদস্য রাষ্ট্র এ প্রস্তাবে কো-স্পন্সর ছিল। জাতিসংঘ সদস্য রাষ্ট্রগুলো কর্তৃক এ প্রস্তাব অনুমোদনকে ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনের বৈশ্বিক প্রচেষ্টায় এক অবিস্মরণীয় মাইলফলক হিসেবে দেখা হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, জাতিসংঘে কমিউনিটি ক্লিনিককে স্বাস্থ্যসেবার বৈশ্বিক মডেল হিসেবে স্বীকৃতিদানের ঘটনায় আরও অনেক দেশ এ সৃজনশীল পদ্ধতি প্রবর্তনে ভূমিকা রাখবে। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের স্বাস্থ্যবিষয়ক মৌলিক অধিকার পূরণে তা হবে এক বিরাট অর্জন। গত ১৪ বছরে স্বাস্থ্য খাতে উলেস্নখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। এ পর্যন্ত ১১টি স্নাতকোত্তর 'সুপার বিশেষায়িত হাসপাতাল', কার্ডিওভাসকুলার হাসপাতাল, বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, ক্যানসার হাসপাতাল, নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল এবং অন্যান্য হাসপাতাল স্থাপনের পাশাপাশি সারাদেশে ৬০০টির বেশি হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছে। গ্রামের মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ১৮ হাজার ৫০০ কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। হাসপাতাল থেকে ৩০ প্রকার ওষুধ বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে। সারাদেশে ৪৩টি হাসপাতালে টেলি-মেডিসিন সেবা চালু করা হয়েছে। যেখানে মা ও শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে রয়েছে ৩০ হাজার স্যাটেলাইট ক্লিনিক। ৫ লাখ অটিস্টিক শিশুকে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য ১০৩টি সেবাকেন্দ্র চালু রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশকে পোলিও ও ধনুষ্টংকারমুক্ত দেশ ঘোষণা করেছে। প্রতিটি জেলায় একটি করে মেডিকেল কলেজ নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার। স্বাধীনতার ৫২ বছরে দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাত বিশ্বব্যাপী প্রশংসনীয় সফলতা অর্জন করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম খরচে মৌলিক চিকিৎসা চাহিদা পূরণ, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল, অসংক্রামক রোগসমূহের ব্যবস্থাপনা ও প্রতিরোধে ব্যাপক উদ্যোগ, পুষ্টি উন্নয়ন, স্বাস্থ্য সূচকসমূহের ব্যাপক অগ্রগতিতে স্বাস্থ্য অবকাঠামো খাতে অভূতপূর্ব অর্জন বাংলাদেশকে এগিয়েছে বহুদূর। শিশুদের টিকাদান কর্মসূচি, মাতৃ ও শিশু মৃতু্য হ্রাস, তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে চলমান কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রম বিশ্বের অনেক দেশের কাছে মডেল হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। করোনাভাইরাসের প্রভাবে যেখানে বিশ্বের অনেক বড় বড় দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। সেখানে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত বিশ্বব্যাপী প্রশংসনীয় সফলতা অর্জন করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম খরচে মৌলিক চিকিৎসাসেবা পূরণ, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল, অসংক্রামক রোগসমূহের ব্যবস্থাপনা ও প্রতিরোধে ব্যাপক উদ্যোগ, পুষ্টি উন্নয়ন, স্বাস্থ্য সূচকসমূহের ব্যাপক অগ্রগতিতে স্বাস্থ্য অবকাঠামো খাতে অভূতপূর্ব অর্জন বর্তমানে দেশকে এগিয়ে নিয়েছে অনেক দূর। বৈশ্বিক প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে ও মৃতু্যরোধে সফলতার পরিচয় দিয়ে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। গ্রামীণ দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বর্তমান সরকার সারাদেশে ১৮ হাজার ৫০০টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করেছে- যার মাধ্যমে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ঘরের দোরগোড়ায় বসে প্রাথমিক বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন। দেশে যক্ষ্ণা, ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, মা ও নবজাতকের ধনুষ্টঙ্কার, হেপাটাইটিস-বি, হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা-বি, নিউমোকক্কাল নিউমোনিয়া, পোলিও মাইলাইটিস, হাম ও রুবেলা্ত এই ১০টি রোগের বিরুদ্ধে নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে। ইপিআই কর্মসূচির মাধ্যমে সারাদেশে বিনামূল্যে এ টিকাগুলো দেয়া হয়। ১৯৮৫ সালে টিকাদানের হার মাত্র দুই শতাংশ হলেও বর্তমানে তা ৯৮ শতাংশেরও বেশি। এ কর্মসূচির ফলেই দেশে মা ও শিশু মৃতু্যর হার কমানোর পাশাপাশি পঙ্গুত্ব রোধ করা সম্ভব হচ্ছে। টিকাদান কর্মসূচিতে বাংলাদেশের সফলতার জন্য গত ২৩ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে 'ভ্যাকসিন হিরো' পুরস্কার দিয়েছে গেস্নাবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনেশন এবং ইমিউনাইজেশন (জিএভিআই)। বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রতিজ্ঞার বাস্তবায়ন হিসেবে স্বাস্থ্য খাতেও ডিজিটালাইজেশন শুরু হয়েছে। মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা সব পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন স্বাস্থ্যসেবাবিষয়ক তথ্য জাতীয় স্বাস্থ্য তথ্যভান্ডারে জমা করছেন উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যবহার করে। দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে টেলিমেডিসিন সেবার মাধ্যমে রোগীদের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা পাওয়ার সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া 'স্বাস্থ্য বাতায়ন' ১৬২৬৩ সার্বক্ষণিক কল সেন্টারের মাধ্যমে সারাদেশ থেকে যে কোনো মানুষ যে কোনো সময় স্বাস্থ্যসেবাসংক্রান্ত যে কোনো তথ্য জানতে পারছে। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারছে। আবার জাতীয় তথ্য বাতায়ন ৩৩৩, সুখী পরিবার ১৬৭৬৭ এবং আইইডিসিআরের ১০৬৫৫ নাম্বারে ফোন করে টেলিমেডিসিন সেবা গ্রহণ করতে পারেন। অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতোই স্বাস্থ্য খাতে ই-ফাইলিং সেবা চালু করা হয়েছে- যা ক্রমে 'পেপারলেস' অফিস তৈরির পথে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে- যার ফলে ২০১১ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘ কর্তৃক 'ডিজিটাল হেলথ ফর ডিজিটাল ডেভেলপমেন্ট' পুরস্কারে ভূষিত হয়। স্বাস্থ্য খাতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শিশু ও মাতৃ মৃতু্যর হার কমানো এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিশেষ অবদান রাখার জন্য তাকে ওই সম্মাননা দেয়া হয়। জাতিসংঘ ঘোষিত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাংলাদেশ ২০১৫ সালের আগেই অর্থাৎ নির্ধারিত সময়ের দুই বছর আগেই অর্জনে সফল হয়েছে। যার স্বীকৃতি স্বরূপ প্রধানমন্ত্রী এমডিজি অ্যাওয়ার্ড ২০১০, স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় তথ্যপ্রযুক্তির সফল প্রয়োগের জন্য সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ড ২০১১-সহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। মহামারি করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) কারণে যখন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, জীবন-জীবিকার অনিশ্চিত যাত্রায় বিশ্বজুড়ে সংকটময় পরিস্থিতি তখন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সামনে থেকে প্রশংসনীয় সফল ও দৃঢ়চেতা নেতৃত্ব দিয়েছেন। করোনা পরিস্থিতিতে মানুষের জীবনজীবিকার চাকা সচল রাখতে একের পর এক সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছেন। লকডাউন পরিস্থিতির মধ্যে সরকারের পাশাপাশি আওয়ামী লীগসহ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের সহায়তায় জনগণের জীবনজীবিকার চাকা সচল রাখতে প্রণোদনা প্যাকেজসহ উদ্দীপনা ও সাহস জুগিয়েছেন। জনগণের মাঝে ত্রাণ সহায়তা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে নেতাকর্মীদের উদ্দীপ্ত করেছেন। তাই করোনাকালে দেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বিভিন্ন সংস্থা ও গণমাধ্যম তার নেতৃত্ব প্রশংসিত হয়েছে। আর এ কারণেই নেতৃত্ব ও মানবিকতার সফল সাহসী আস্থার প্রতীক 'হিরো অব দ্য ইয়ার' শেখ হাসিনা। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আর এই এগিয়ে যাওয়ার সামনে থেকে সরকার ও দলের প্রধান হিসেবে সাহসী নেতৃত্ব দেন শেখ হাসিনা। মো. খসরু চৌধুরী : কলাম লেখক