বাংলা ভাষার উন্নয়ন এবং মযার্দার জন্য প্রয়োজন বাস্তব পদক্ষেপ

বাংলা একাডেমি বাংলা ভাষাকে অনুবাদের মাধ্যমে সমৃদ্ধ করার ব্যাপার খুব তৎপর মনে হয় না। তা ছাড়া একাডেমিটি আমলাতান্ত্রিক সিনড্রমে আক্রান্ত, রাষ্ট্রাচার, পদক প্রদান, নানা অনুষ্ঠান নিয়েই বেশি ব্যস্ত বাংলা একাডেমি। অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক একটি প্রস্তাব এনেছেন। পাকিস্তান আমলে বাংলা উন্নয়ন বোডর্ নামে একটি প্রতিষ্ঠান ছিল সেটাকে পুনঃস্থাপন করা হোক।

প্রকাশ | ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ
প্রতি বৎসর ১ ফেব্রæয়ারি বইমেলা শুরু হয়। মাসব্যাপী ভাষা শহীদদের বন্দনা এবং বইমেলার আনন্দ উল্লাসে কেটে যায় মাসটি। ভাষা আন্দোলন হয়েছিল মাতৃভাষাকে রক্ষা করার জন্য। শহীদরা প্রাণ দিয়েছিলেন মায়ের ভাষার মযার্দা রক্ষা এবং বুদ্ধির জন্য। কিন্তু সাবির্ক অবস্থাটা কি? সবর্স্তরে মাতৃভাষার প্রচলনের কথাটা কোরাসে রূপ নেয় ফেব্রæয়ারিতে, তারপর আর নেই। কতটা চালু হয়েছে সবর্স্তরে তা তো দেখতেই পাচ্ছি। বরঞ্চ রাষ্ট্র এবং প্রতিষ্ঠানের কাযর্কলাপে বাংলা ভাষার মযার্দা ক্ষুণœ হয়েছে বললে অভুক্তি হবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভতির্ পরীক্ষায় ‘ঘ’ ইউনিটের পরীক্ষার ফল অনুযায়ী বিষয় বরাদ্দের মাপকাঠি ইংরেজিতে প্রাপ্ত নম্বর। কিন্তু তা বাংলার বেলায় প্রযোজ্য হবে কেন। বাংলা বিষয়ে অসামান্য সাফল্য যে দেখাবে তাকে আগে সুযোগ দেবে। বাংলা ভাষা, আমার মায়ের ভাষার মাযার্দা অবশ্যই ইংরেজির ওপর হতে হবে। এটিও বাংলা ভাষার প্রতি এবং শহীদদের প্রতি অমযার্দা ছাড়া আর কিছুই না। আমাদের সংবিধানের একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। তবে সংবিধানতো আমরা শিকেয় তুলে রেখেছি, চলছি আমাদের মজির্ মতো। বহুমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রয়েছে। ও লেভেল, এ লেভেল পদ্ধতির জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলছে। ব্রিটিশ কাউন্সিল এর পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ করে। একটি বহুল প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক এ লেভেল, ও লেভেল পরীক্ষায় যারা ভালো করে তাদের জমকালো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সংবধর্না জানানো হয়। ভালো কথা, যারা বিদেশে ছেলেদের রাখবেন, তারা এসব লেভেলে পড়াবেন। আর ব্যাংকের মাধ্যমে নানা কৌশলে বিদেশে টাকা পাচার করে সন্তাদের যেন আহার বাসস্থানের অসুবিধা না হয়, সে ব্যবস্থা করবেন। গত ৮ ফেব্রæয়ারি একটি জনপ্রিয় বহুল প্রচারিত দৈনিকে ব্যাংকের ওপর একটি অসাধারণ নিবন্ধন ছাপা হয়েছে। সেখানে যথাথর্ বলা হয়েছে যে, ব্যাংক বাংলাদেশের অথর্নীতির রক্তক্ষরণ। এই রক্তক্ষরণের একটি কুফল হলো অথর্ পাচারের। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হলো যে কোনো দায়িত্ববোধ থেকে বাংলাদেশ সরকার ইংরেজি ভাসর্ন চালু করেছে। বিদেশে জ্ঞান অজের্নর জন্য ভাষাবিদ হয়ে যেতে হয় না। জামাির্ন, রাশিয়া, চীন, জাপান, কোরিয়া এসব দেশেতো বহু ছেলেমেয়ে পড়াশুনা করছে। সরকার কি তাদের সংশ্লিষ্ট দেশের ভাষাবিদ বানিয়ে দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট দেশে তারা গিয়ে অল্প দিনের ভেতর ভাষা শিখে তারপর ডিগ্রি অজর্ন করছে। জাপান এবং কোরিয়া সম্পকের্ আমার একটা ভুল ধারণা ছিল। যেহেতু মাকির্ন যুক্তরাষ্ট্র এদের ঘাড়ে চেপে রয়েছে, অতএব, এরা বোধ হয় ইংরেজি ভাষায় ফটর ফটর করে, গিয়ে ভুল ভাঙল। জাপানে শতকরা ১ ভাগ লোকও ইংরেজি জানে না। একদিন টোকিওর সাবওয়েতে টিকেট ভুল জায়গায় ফেলেছিলাম। লোকটি হতবাক, আমি বেকুব। ভাবের আদান-প্রদানের সম্ভাবনা নেই। আমার গাইড এসে উদ্ধার করলেন। কোরিয়ার রাজধানী সিউলে আমি এবং চাটাডর্ অ্যাকাউন্টেন্ট ড. সাহবুব আলাম পথে বিভ্রাটে পড়েছিলাম। পুলিশের গাড়ি এলো। ইংরেজি জানে না, যা হোক এক রকমভাবে সামলিয়ে উঠলাম। কাদের স্বাথের্ বা চাপে ইংলিশ ভাসর্ন চালু করা হয়েছে জানি না। তবে অবিলম্বে এটি প্রত্যাহার করা হোক। ভাষার মযার্দার জন্য রাষ্ট্রের সম্মানের জন্য। বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্র অন্য দেশ থেকে জ্ঞান সংগ্রহ করে নিজের ভাÐারসমৃদ্ধ করে। যা নাগরিককে আরো সুশিক্ষতি এবং সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে। আমাদেরও তো সেই লক্ষ্যই হওয়া উচিত। ফ্রান্সের নোবেল বিজয়ী অথর্নীতিবিদ টমাস পিকেটি ‘ক্যাপিট্যাল ইন দ্যা টুয়েন্টি ফাস্ট সেঞ্চুরী’ শিরোনামে একটি ঢাউস সাইজের বই লিখেছেন। অথৈর্নতিক বৈষম্য ভয়াবহ রূপ নিয়েছে এবং পুঁজির নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি এর মূল প্রতিপাদ্য। পশ্চিমা বিশ্বের অনেক গুণী ব্যঙ্গ করে পিকেটিকে নাম দিয়েছেন ২১ শতকের কালর্মাক্সর্। যে যাই বলুক, বিষয়টি অত্যন্ত সময়োপযোগী, গুরুত্বপূণর্ এবং অনুসারণীয়। বইটি প্রায় ৭০০ পৃষ্ঠার এবং অনেক চাটর্ গ্রাফ রয়েছে। ২০১৪ সালে বইটি প্রথম বেরিয়েছে। ২০১৭ সালের ভেতর বিশ্বের ৩০টি ভাষায় অনূদিত এবং ২২ লাখ কপি বিক্রি হয়েছে। এ ধরনের নীরস অথৈর্নতিক বই বিক্রি হওয়াটা বিরল। চীন দুধরনের সংস্করণ বের করেছে, একটি হলো জটিল, অথার্ৎ মূল বইয়ের মতো। অপরটি সরল, যাতে সাধারণ পাঠক অনুধাবন করতে পারে। ইউরোপে জামাির্ন, রাশিয়া, ডাচ, নরওয়ে ডেনমাকের্তা রয়েছে এমনকি ¯েøাভেনিয়া, বসনিয়ার মতো দেশেও বইটির অনুবাদ করিয়েছে। অথর্নীতি যেরকম রূপান্তরিত এবং বক্রগতি বিধি সংঘটিত হচ্ছে তা প্রতিটি দেশের প্রতিটি নাগরিকের সব সময় লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। আশির দশকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থ্যাচার এবং মাকির্ন প্রেসিডেন্ট রিগ্যান আমাদের বললেন যে, সরকার অথৈর্নতিক উন্নয়নের অন্তরায়। রাস্তায় নিজেই নিজেকে সামলিয়ে নেয়। ২০০৭-০৮ সালে বিশ্বে যখন অথৈর্নতিক বিপযর্য় এলো, তখন মাকির্ন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারসহ অনেক সরকারকে জনগণের তহবিল থেকে অথর্ নিয়ে সংকট মোকাবেলা করতে হলো। তাহলে সরকারের কোনো ভ‚মিকা নেই বলে থ্যাচার ও রিগ্যান বয়ান দিয়েছিলেন তা ভুল প্রমাণিত হলো। ১৯৯৭-৯৮ সালে দক্ষিণ-পূবর্ এশিয়ার অথের্নতিক ব্যাঘ্ররা কুপকাত হলে আইএমএফ কি খেলা খেলল, সেটা পাওয়া যাবে আরেক নোবেল বিজয়ী মাকির্ন অথর্নীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিজের লেখায়। বিশেষ করে গেøাবালাইজেশন অ্যান্ড ইটস ডিসকনটেন্ট বইটিতে। বহুদিন শুনেছি, বিশালকার বহুজাতিক কোম্পানি রাষ্ট্রের তথা বিশ্বের অথর্নীতির স্তম্ভ এবং চালিকাশক্তি। ২০০১ সালে পৃথিবীর সপ্তম বৃহৎ কোম্পানি এ ধরনের পতন হলো কয়েক দিনের মধ্যে। সেই সঙ্গে আরো কয়েকটিরও সহমরণ হলো। বিশ্বের পঁাচটি বৃহত্তম অডিট ফামের্র একটি অ্যান্ডারসনেরও অপমৃত্যু হলো। বিশ্ব পুঁজিবাদ তার অস্তিত্বের জন্য এক এক সময় এক এক ফমুর্লা চালু করে উন্নয়নশীল বিশ্বকে বিভ্রান্তিতে ফেলে। এখন যেমন চলছে জিডিপি, মাথাপিছু আয় উন্নয়নের মাপকাঠি। বিশ্ব সংস্থা বেশ ফলাও করে দেখায়। ভারত বিশ্বের পঞ্চম বৃহৎ অথর্নীতি। এর ওপরে রয়েছে মাকির্ন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান এবং জামাির্ন। অথচ ভারতের মানুষের জীবন যাত্রার মানের কতটুকু উন্নতি হয়েছে, এখনও বহু অঞ্চলে নারীদের কয়েক কিলোমিটার হেঁটে গিয়ে মাথায় খাবার পানি আনতে হয়। অন্য সব বিষয় বাদ দিলাম, এটা কোনো হিসাব হলো। আমার প্রতিবেশীর আয় বাড়ল, অতএব, আমারও আয় বৃদ্ধি পাবে। এটাতো যুক্তি নয়, ফ্যালাসি, অথচ এই উন্নতির তথ্য নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিবার্চন প্রচারের ডুগডুগি বাজাচ্ছেন। জিডিপি, মাথাপিছু আয় এর সঙ্গে সম্বনয় করতে হবে সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের। বিবেচনায় আনতে হবে সামাজিক ন্যায়বিচার ও অথৈর্নতিক ন্যায়বিচার। আমাদের বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে হবে জোসফ স্টিগলিজ এবং টমাস পিকেটি এদের মতো উদার, মুক্তচিন্তার অথর্নীতিবিদদের অনুদিত গ্রন্থ দ্বারা। সহজ সরল ভাষায় আমাদের সাধারণ পাঠকের হাতে পেঁৗছাতে হবে এ সব বই। তবেই তারা হবেন সমৃদ্ধ, সচেতন, তারা বুঝবেন সাবির্ক উন্নয়ন কাকে বলে বিশ্ব সংস্থাসমূহের উন্নয়ন উন্নয়ন খেলা কি জিনিস তাও অনুধাবন করতে পারবেন। বাংলা একাডেমি বাংলা ভাষাকে অনুবাদের মাধ্যমে সমৃদ্ধ করার ব্যাপার খুব তৎপর মনে হয় না। তা ছাড়া একাডেমিটি আমলাতান্ত্রিক সিনড্রমে আক্রান্ত, রাষ্ট্রাচার, পদক প্রদান, নানা অনুষ্ঠান নিয়েই বেশি ব্যস্ত বাংলা একাডেমি। অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক একটি প্রস্তাব এনেছেন। পাকিস্তান আমলে বাংলা উন্নয়ন বোডর্ নামে একটি প্রতিষ্ঠান ছিল সেটাকে পুনঃস্থাপন করা হোক। স্বাধীনতার পর এটির বিলুপ্তি হয়। অনেকে বলে থাকেন যে বাংলা একাডেমির প্রতি পাকিস্তানি শাসকদের বিরূপ মানসিকতার কারণে এটি প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। যে নামই দেয়া হোক না কেন, একটি পৃথক প্রতিষ্ঠানের বোধহয় প্রয়োজন হয়েছে যেটি বিশ্বের সব প্রান্ত থেকে সময়োপযোগী অথর্নীতিসহ সামাজিক বিজ্ঞানের গ্রন্থ সংগ্রহ করে এনে তার অনুবাদ করে বাংলা ভাষাকে অন্তভুির্ক্তমূলক সমৃদ্ধ করা। সেদিক থেকে অধ্যাপক সাহেবের প্রস্তাবটি বিশ্বের বিবেচনায় দাবি রাখে। বাংলা ভাষার মতো একটি সমৃদ্ধশালী ভাষাকে অপর ভাষার পরগাছা করা মানসিকতাই হলো ইংরেজি ভাসর্ন, একথাটা মনে রাখতে হবে। সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ: গবেষক ও কলাম লেখক