সরকারের শুদ্ধি অভিযান

সরকারের নানামুখী শুদ্ধি অভিযান যদি অব্যাহত থাকে, তা হলে সমাজ থেকে মাদকের ভয়াবহ বিস্তার রোধ করা এবং দুনীির্তমুক্ত বাংলাদেশ গড়া কোনো কঠিন বিষয় নয়। পাশাপাশি নদী দখল ও দূষণ রোধ করাও সম্ভব। সরকার ইতোমধ্যে জঙ্গি দমনে সফল হয়েছে। অন্যান্য সামাজিক অপরাধ দমনের ক্ষেত্রেও সরকার সক্রিয় রয়েছে। সরকারের ইতিবাচক কাজের ধারাবাহিকতা যদি বজায় থাকে তা হলে বাংলাদেশ অচিরেই উন্নত নিরাপদ ও সুখী দেশে পরিণত হবে, এ কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

প্রকাশ | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

সালাম সালেহ উদদীন
নতুন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর নানামুখী শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করেছে। যাত্রা শুরুতেই দুনীির্তমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার করেছে সরকার। দায়িত্ব নেয়ার পর পরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন ‘দুনীির্তকে আমরা প্রশ্রয় দিই না। নিজেদের লোককেই কোনো ছাড় দিই না। এমনকি আমাদের মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠলে যে কোনো সময় ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করি। আদালত থেকেও ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।’ প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি দুনীির্তর বিরুদ্ধে তার সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা পুনবর্্যক্ত করেছেন। দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে এবং এর অজর্নগুলো সমুন্নত রাখতে দুনীির্তবিরোধী লড়াই অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন। এ কথা সত্য, বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে দেশব্যাপী চুরি-দুনীির্ত আর লুটপাটের বিপজ্জনক বিস্তার। এই বিস্তারের প্রধান প্রবণতা হচ্ছে রাতারাতি কোটিপতি হওয়া। অগ্রগতির সূচক আরও ইতিবাচক করতে এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে দুনীির্তর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেই আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। সেই লক্ষ্যেই বতর্মান সরকার এগিয়ে যাচ্ছে। যিনি চোর-দুনীির্তবাজ লুটেরা তার মাত্রা ও ব্যাপকতা কত সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে এটা মারাত্মক অপরাধ। এই অপরাধের সাজা হওয়া উচিত। মানুষ যদি সৎ নীতিবান না হয় তা হলে দুদক দুনীির্তর বিরুদ্ধে লড়াই করে কতটুকু জয়ী হবে? অথর্-বিত্তের মালিক হয়ে ভোগবাদী জীবনযাপনের মাধ্যমে সুখের মুখ কে না দেখতে চায়। পাবলিক বাসে জীবনের ঝঁুকি নিয়ে চলাচলের চেয়ে এসি গাড়িতে চলাচল করতে কে না চায়। কে না চায় দামি পোশাক ও অলঙ্কার পরতে, দামি ও মুখরোচক খাবার খেতে। কে না চায় প্রাসাদোপম বাড়ির মালিক হতে। কোটি কোটি টাকা ব্যাংকে থাকুক এটাও সবাই চায়। এ চাওয়া পূরণ করতে গেলে ধনী হতে হবে। এটা সবাই জানে, এ গরিব দেশে সৎপথে উপাজের্নর মাধ্যমে ধনী হওয়া সম্ভব নয়। ব্যতিক্রম দুয়েকজন যে হয়েছে কঠিন সাধনা আর সংগ্রামের মাধ্যমে। হয়তো ভাগ্যও তাদের সুপ্রসন্ন করেছে। আর যারা উত্তরাধিকার সূত্রে বিত্তশালী তাদের কথা আলাদা। এ দেশে আবার কেউ কেউ চুরির মাধ্যমেও কোটিপতি হওয়ার চেষ্টা করছে। ভদ্রবেশি চোরদের পাশাপাশি সুড়ঙ্গ কাটা চোররাও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। লুটেরা বা চোরদের উদ্দেশ্য একটাই ধনী হওয়া। রাতারাতি বিত্তবৈভবের মালিক হওয়া। স্বাধীনতার পর রিলিফের কম্বল চুরির হিড়িক পড়লে এবং এই অভিযোগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কানে গেলে তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেনÑ ‘সবাই পায় সোনার খনি, আমি পেয়েছি চোরের খনি।’ অবশ্য চুরির-দুনীির্তর প্রতিযোগিতায় জেতা কোনো গৌরবের বিষয় না। বেঁচে থাকার জন্য অথের্র প্রয়োজন, কিন্তু চুরি-দুনীির্ত-লুটপাটের টাকা কতটা প্রয়োজন তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। কাস্টমসের অল্প শিক্ষিত কমর্চারী চুরি-দুনীির্ত ঘুষের টাকা দিয়ে সংসার চালানোসহ ছেলেকে উচ্চশিক্ষিত করেছে। ছেলে চাকরিজীবনে প্রবেশের আগে উপদেশ দিয়েছেন, দেখ বাবাÑ অভাবের কারণে আমি ওই পথ বেছে নিয়েছিলাম। আমি কম লেখাপড়া জানা মানুষ, সবকিছু বুঝতাম না। তুই যদি আমার মতো চুরির পথ ধরিস তবে তোর আর আমার মধ্যে কোনো পাথর্ক্য থাকলো না। যদি কখনো লোভের বশবতীর্ হয়ে ছেলের চুরির ইচ্ছা জাগে তখনই তার বাবার কথা মনে পড়ে। তাই সে সৎপথেই জীবনযাপনের চেষ্টা করছে। এ দেশের বেশির ভাগ ব্যক্তিই চুরি-দুনীির্তর মাধ্যমে অথির্বত্তের মালিক হয়েছে। সুতরাং খানদানি, পেশাদার বা শৌখিন চোর-দুনীির্তবাজদের চেয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের ওইসব চোর-দুনীির্তবাজ বেশি ভয়ঙ্কর ও ক্ষতিকর। সরকারের বিরুদ্ধবাদীরা বলছে, দুনীির্তর বিরুদ্ধে সরকারের যে অভিযান, তাতে কেবল চুনোপঁুটিরা ধরা পড়ছে, রাঘববোয়ালরা নয়। কথাটি সত্য নয়। কারণ হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির হোতারাও ধরা পড়েছে। আমরা আশাবাদী, দেশকে এগিয়ে নেয়ার যে প্রত্যয় সরকার ও দেশের সাধারণ মানুষের বুকে রয়েছে তা-ই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। শত বাধা-অপপ্রচার সত্তে¡ও বাংলাদেশ বিশ্বে টিকে থাকবে সফল ও কাযর্কর এবং দুনীির্তমুক্ত রাষ্ট্র হিসেবে। দুই. মাদকের বিপজ্জনক বিস্তার তরুণসমাজকে গ্রাস করে ফেলেছে। এর ফলে দেখা দিয়েছে সামাজিক নানা অবক্ষয়। তরুণ সমাজের পাশাপাশি কিশোরদেরও একটি বড় অংশ আজ মাদকাসক্ত। মাদকাসক্তরা যেমন নিজেদের ধ্বংস করছে অবলীলায়, তেমনি পরিবারকেও ঠেলে দিচ্ছে ধ্বংসের পথে। অন্যদিকে মাদকের অবশ্যম্ভাবী অনুসগর্ হিসেবে তারা নানা রকম অপরাধকমের্ জড়িয়ে পড়ছে। ফলে সামাজিক স্থিতি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়ে পড়ছে। এই সব দিক সামনে এনে সরকার মাদকবিরোধী অভিযান শুরু করেছে গত বছর থেকে। এই অভিযানে ব্যাপক সফলতা এসেছে। অবাক ব্যাপার যে, শুধু শহরেই নয়, গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে মাদক। তার বিষাক্ত ছোবল শেষ করে দিচ্ছে তারুণ্যের শক্তি ও অমিত সম্ভাবনা। ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনের অবক্ষয়, প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির অসামঞ্জস্যতা, হতাশা এবং মূল্যবোধের অভাবের সুযোগ নিয়ে অবিনাশী মাদক তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তরুণ সমাজের প্রতি। বেকারত্বও মাদকের বিস্তারে সহায়ক-এমন কথাও বলছেন দেশের সচেতন মহল। এই মরণ নেশার বিস্তারে সমাজে একদিকে যেমন অপরাধ বাড়ছে, তেমনিভাবে নষ্ট হচ্ছে সামাজিক শৃঙ্খলা। এই অবস্থা চলতে থাকলে একটি সমাজের অন্ধকারের অতল গহŸরে হারিয়ে যেতে খুব বেশি সময় লাগবে না। সুতরাং সময় থাকতেই তৎপর ও মনোযোগী হওয়া সমীচীন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘মাদকের করাল গ্রাসে আমাদের তরুণ সমাজ আজ বিপদাপন্ন। এই ভয়াল থাবা থেকে তাদের বঁাচাতে হবে।’ বলার অপেক্ষা রাখে না, মাদক ক্রমাগত এক ভয়াবহ সমস্যা হয়ে দঁাড়াচ্ছে। সীমান্ত গলে প্রায়ই বড় বড় মাদকের চালান পেঁৗছে যাচ্ছে দেশের অভ্যন্তরে। ছড়িয়ে পড়ছে দেশের সবর্ত্র। মাদকের সহজলভ্যতার কারণে উঠতি বয়সী তরুণ থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাথীর্ এবং দেশের যুবসমাজের বড় একটি অংশ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। মাদকে আসক্ত ছেলের হাতে পিতা-মাতা-ভাই খুনের ঘটনাও ঘটেছে অতীতে। দেশজুড়ে মাদকের আগ্রাসনের বিষয়টি বহুল আলোচিত হলেও মাদকবিরোধী অভিযানে সংশ্লিষ্ট কতৃর্পক্ষের বড় ধরনের সাফল্য দৃশ্যমান সরকারের পরিকল্পিত উদ্যোগই কেবল পারে এর সমাধান দিতে। মনে রাখতে হবে মাদকমুক্ত সমাজ গড়ার কোনো বিকল্প নেই। যে সব ব্যক্তি সমাজে মাদক বিস্তারে ও সেবনে সহযোগিতা করছে তাদের কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত। বলাই বাহুল্য, নিষিদ্ধ জগতে অস্ত্রের পর মাদকই সবচেয়ে লাভবান ব্যবসা। বিশেষ করে ফেনসিডিল ও ইয়াবা সহজলভ্য ও বহনযোগ্য বলে এর বিস্তার দেশজুড়ে। সত্যি বলতে কি দেশের এমন কোনো এলাকা খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে মাদকের থাবা নেই। দেশজুড়ে এক বিশাল জাল বিস্তার করে আছে এই মরণ নেশার ভয়াবহ সিন্ডিকেট। আন্তজাির্তক অপরাধ চক্র মাফিয়াদের সঙ্গেও রয়েছে এদের শক্ত ও গভীর যোগাযোগ। আশার কথা, কক্সবাজারের সীমান্ত এলাকা টেকনাফের তালিকাভুক্ত ৩৫ গডফাদারসহ শতাধিক ইয়াবা ব্যবসায়ী আত্মসমপর্ণ করেছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে। বিষয়টি স্বস্তিকর। মাদক সেবনকারী, ব্যবসায়ী, উৎপাদক, সরবরাহকারী সবার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারলে আমাদেরও রক্ষা নেই। আশার কথা বতর্মান সরকার এ ব্যাপারে সক্রিয় ও সোচ্চার। তিন. নদীর অবৈধ দখল, পানি ও পরিবেশ দূষণ, শিল্প কারখানা কতৃর্ক সৃষ্ট নদী দূষণ, অবৈধ কাঠামো নিমার্ণ ও নানাবিধ অনিয়ম রোধকল্পে এবং নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ পুনরুদ্ধার, নদীর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ এবং নৌ-পরিবহনযোগ্য হিসাবে গড়ে তোলাসহ আথর্-সামাজিক উন্নয়নে নদীর বহুমাত্রিক ব্যবহার নিশ্চিত করার প্রয়োজনে একটি কমিশন গঠনের মধ্যদিয়ে “জাতীয় নদী কমিশন আইন, ২০১৩” প্রণীত হয়। এ ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে সঙ্গে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও কাজ করছে। নদী দখল ও দূষণ রোধে বতর্মান সরকারের ভ‚মিকা প্রশংসনীয়। নদীর পানিপ্রবাহ কমে পলি জমে ভরাট হওয়ার পাশাপাশি দখলের প্রতিযোগিতা ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করছে। নদীর বুকের ওপরেই নিমার্ণ করা হচ্ছে বিশাল বিশাল দালান। এক কথায় কোথাও নদ-নদী তার আপন গতিতে চলতে পারছে না। ফলে নদী নাব্য হারিয়ে ফেলছে। সরকার নতুন করে নদী খননেরও উদ্যোগ নিয়েছে। এটা সত্য, বাংলাদেশের নদ-নদীর পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন সময়েই নেতিবাচক খবর পত্রপত্রিকায় উঠে এসেছে। দখল, দূষণসহ নানা কারণেই নদীর অস্তিত্ব সংকটের মুখে । পৃথিবীর অনেক সভ্যতা গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করে। যদি নদী দখল-দূষণে জজির্রত হয়, নদীর অস্থিত্ব হুমকির মুখে পড়ে, তা দেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। আশার কথা, অবৈধ দখলদারদের কবল থেকে রক্ষা করতে তুরাগ নদীকে ‘লিগ্যাল পারসন’ ঘোষণা করেছে হাইকোটর্। উল্লেখ্য, এই ঘোষণা দেশের সব নদ-নদীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। জীবন্ত সত্তা হিসেবে মানুষ যেমন সাংবিধানিক অধিকার ভোগ করে, আদালতের এই আদেশের মধ্যদিয়ে নদীর ক্ষেত্রেও তেমন কিছু মৌলিক অধিকার স্বীকৃত হলো। যা অত্যন্ত ইতিবাচক। হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তুরাগ নদীর অবৈধ দখলদারদের নাম ও স্থাপনার তালিকা হাইকোটের্ দাখিল করেছিল বিচার বিভাগীয় একটি তদন্ত কমিটি। নদী সুরক্ষায় উচ্চ আদালত ও সরকার তৎপর, এটা আমাদের আশাবাদী করে তোলে। সরকারের নানামুখী শুদ্ধি অভিযান যদি অব্যাহত থাকে, তা হলে সমাজ থেকে মাদকের ভয়াবহ বিস্তার রোধ করা এবং দুনীির্তমুক্ত বাংলাদেশ গড়া কোনো কঠিন বিষয় নয়। পাশাপাশি নদী দখল ও দূষণ রোধ করাও সম্ভব। সরকার ইতোমধ্যে জঙ্গি দমনে সফল হয়েছে। অন্যান্য সামাজিক অপরাধ দমনের ক্ষেত্রেও সরকার সক্রিয় রয়েছে। সরকারের ইতিবাচক কাজের ধারাবাহিকতা যদি বজায় থাকে তা হলে বাংলাদেশ অচিরেই উন্নত নিরাপদ ও সুখী দেশে পরিণত হবে, এ কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়। সালাম সালেহ উদদীন: কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক