আমার দুঃখিনী বাংলা ভাষা

ফব্রæয়ারি এলেই শরীর, কাপড়, দেয়াল, বাড়ির ছাদে সবর্ত্র ভালোবাসা আর চেতনার ছড়াছড়ি চলে। আমরা যদি আমাদের ভাষাকে সত্যিই মযার্দা দিতে চাই, ভালোবাসায় রাঙাতে চাই, শহীদদের সম্মান জানাতে চাই তাহলে আমাদের অবশ্যই যে বিষয়গুলো মানতে হবে তা হলোÑ সত্য কথা বলতে হবে, সত্য প্রকাশ করতে দিতে হবে। অশ্লীল শব্দের ব্যবহার রোধ করতে হবে। খিচুড়ি ভাষা পরিহার করতে হবে।

প্রকাশ | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

শাকিলা নাছরিন পাপিয়া
ফেব্রæয়ারির এক তারিখ থেকেই শুরু হয়ে গেছে শুভেচ্ছা আর শ্রদ্ধা জানানোর পালা। দেয়াল, গাছপালা যেদিকেই তাকাই একুশের বন্দনা। আহা, কোন জাতি এত আবেগ নিয়ে ঘোরে। যে ছেলেগুলো সারা বছর রাস্তার মোড়ে দঁাড়িয়ে মেয়েদের অশ্লীল কথা বলে আনন্দ পেত একুশের সকালে তাদের গায়ে পাঞ্জাবি, হাতে ফুল। মেয়েদের কপালে, গালে অক্ষর, শহীদ মিনারের ছবি। সুন্দর সাজ-গোজ করা নারীদের আনন্দে, উৎসবে আসে ফাগুন। এত উৎসবের মধ্যে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রæয়ারি’ সত্যিই অশ্রæ সজল চোখে বিষণœ বদনে, একরাশ অভিমানে দঁাড়িয়ে। আমাদের হাজার চেতনা, শত উৎসবের মধ্যে দেয়ালে দেয়ালে কত বাণী। যেমনÑ ‘একুশ আমার গভর্।’ ‘শত শত মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অজির্ত আমার ভাষা।’ ‘একুশে ফেব্রæয়ারির শুভেচ্ছা।’ রাত বারোটার পর এলাকায়, স্কুলে শুরু হয়ে যায় গানের উৎসব। হিন্দি গান, নাচ এই চেতনাকে আরও শানিত করে। সকালে ফুল হাতে নানা সাজে জোড়ায় জোড়ায় কপোত-কপোতির রাস্তা আলো করে ঘুরে বেড়ানো। জিপিএ ফাইভ পাওয়া ছাত্রছাত্রীদের মুখে ‘আমি আসলে সঠিক বলতে পারব না এটা কেন।’ আপারেশন সাজর্ লাইট মানে, অপারেশনের সময় ডাক্তার যে লাইট জ্বালায়। জনপ্রতিনিধিদের শুভেচ্ছা পোস্টারে শত শত মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে, শহীদের রক্তের বিনিময়ে অজির্ত ভাষা আন্দোলন আমাদের বিস্মিত করে না। হাজারটা অনিয়ম, হাস্যকর, বিস্ময়কর কমর্কাÐের মধ্যেও ‘আকাশে-বাতাসে চারদিকের সমস্ত কোলাহল বিদীণর্ করে যখন বেজে ওঠে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রæয়ারি’ তখন ক্ষণকালের জন্য হলেও থমকে দঁাড়ায় আমাদের উৎসব উৎসব আনন্দ। মমের্ মমের্ অনুভব করি ভাই হারানের ব্যথা। বুকের কোনো এক গভীর গহŸরে ঝড় ওঠে, বেদনায় অশ্রæ সজল হয় আমাদের নিজেরই অজান্তে দু’চোখ। ভাষা শুধুই কি বলার জন্য? কিছু শব্দের সমাহার? না। ভাষা ব্যক্তিত্ব প্রকাশের বাহন। ভাষা বুকের গভীর বোধ থেকে উঠে আসা সেই সব শব্দ সমষ্টি যা আমার স্বপ্নের কথা বলে, ভালোবাসার কথা বলে, প্রতিবাদের কথা বলে ভাষা আমায় আলাদা করে, অন্য ভাষাভাষীর থেকে। মানুষ তার জিহŸায় অমৃত এবং গরল দুই-ই ধারণ করে। কোনটা সে উগড়ে দেবে তা নিভর্র করে সে জীবনকে কীভাবে, কীরূপে পেয়েছে তার ওপর। যে সমাজে বঞ্চনা, বিচারহীনতা, দুঃশাসন বেশি সে সমাজের মানুষের ক্ষোভ ঝরে পড়ে তার ভাষায়। আমাদের ভাষার এক অশ্লীল ব্যবহার আর কোনো কালে ছিল না। ভাষার অশ্লীল ব্যবহার দরিদ্র, অশিক্ষিতজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু কালক্রমে তা ছড়িয়ে যেতে যেতে এখন উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত সবর্ত্র ভাষার অশ্লীলতা বিস্তার লাভ করেছে। আমাদের পূবর্পুরুষ বুঝেছিলেন হৃদয়ের একান্ত গভীর থেকে উঠে আসা বোধ, সত্য প্রকাশের দুরন্ত সাহস, ভালোবাসার আবিরে রাঙানো আবেগ, নিজেকে অনন্যভাবে তুলে ধরা বাহন ভাষা। সব অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সততা আর সাহস নিয়ে রুখে দঁাড়ানোর অস্ত্র ভাষা একটি সময়কে অক্ষরে অনন্তকালের জন্য এঁকে রাখা পদ্ধতি ভাষা। তাই তো এ ভাষাকে অজের্নর জন্য এ ভাষাকে মলিনতার বিলুপ্ত হওয়ার ষড়যন্ত্র থেকে রোখার জন্য প্রাণ উৎসগর্ করেছিল বাংলার দামাল ছেলেরা ১৯৫২ সালের ২৯ ফেব্রæয়ারি। বাংলা ভাষাই একমাত্র ভাষা যে ভাষার জন্য বাংলাদেশে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রæয়ারি এবং আসামে ১৯৬১ সালের ১৯ মে প্রাণ দিতে হয়েছে এই ভাষার মানুষকে। আসামে ১৯ মে ১১ জন শহীদের মধ্যে কমলা ভট্টাচাযর্ নামে একজন নারী ছিলেন। যিনি ভাষার জন্য প্রাণ উৎসগর্কারী একমাত্র নারী, দুই দেশের ভাষা আন্দোলন, বুকের রক্ত বৃথা যায়নি। শাসক শ্রেণি অবশেষে পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। আমরা সভ্য হয়েছি আরও। কালে কালে সময় অতিক্রম করে আমরা জ্ঞান, প্রযুক্তি এবং সভ্যতায় অতিক্রম করেছি বহু পথ। কিন্তু যে আবেগ, যে বোধ আমাদের পূবর্পুরুষকে বাংলা ভাষার মযার্দা সমুন্নত রাখতে সেদিন প্রাণদানে প্রেরণা জুগিয়েছিল, আজ আমরা বছরের নিধাির্রত সময় ছাড়া সে বোধ, সে আবেগ কি সত্যিই ধারণ করি? দরিদ্র শ্রমিক জাহালম চিৎকার করে বলেছিল, স্যার আমি জাহালম। আমি সালেক না। কিন্তু তার কথা কি কেউ শুনেছিল? তার এই একটি কথা শুনতে রাষ্ট্রের সময় লেগেছে তিন বছর। পত্রিকার পাতায় এ বছরের শুরু থেকে ২টি খবর প্রতিদিন নিশ্চিতভাবে থাকছে। একটি সড়ক দুঘর্টনায় মৃত্যু, অন্যটি ধষর্ণ। নানাভাবে দেড় বছরের শিশু থেকে ৫০ বছরের নারী কেউ বাদ যাচ্ছে না ধষের্ণর নৃশংসতা থেকে। ধষির্ত নারী তার ধষের্ণর বণর্না দিচ্ছে, অমানবিকভাবে তাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে তারপরও মানবাধিকারের নামে তার কথাকে তার অভিযোগকে উপেক্ষা করে নিজেদের মতো করে তদন্ত রিপোটর্ তৈরি হচ্ছে। মায়ের কাছে মানুষ প্রথম মাতৃভাষা শেখে। মায়ের বুকের ভালোবাসার উত্তাপে, মায়ের চোখের স্বপ্নের আলোয় প্রথম তিন মাসের মুখের ভাষাকে একটি শিশু তার মধ্যে ধারণ করে, আধো আধো বোলে সে বলতে শিখে আপনজনকে কাছে টানে, তার প্রয়োজন, তার ভালোবাসার প্রকাশ ঘটায়। সেই নিজের ভাষায় আমরা কি বলতে পারছি আমরা যা বলতে চাই? আমাদের অধিকারের কথা, বঞ্চনার কথা, চাওয়া-পাওয়ার কথা সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলার ক্ষমতা কি আমাদের আছে? ‘কেন’ এই ছোট, শব্দটি আমরা কি বলতে পারছি? খঁাচার পাখির মতো আমাদের চারদিকে বস্তুগত উন্নয়নের ঝলক। আমরা খাচ্ছি, আনন্দ করছি, আরামে আনন্দে উপভোগ করছি কিন্তু মানুষের জীবনযাপনের জন্য যে সত্য, যে বোধের প্রকাশ তা কি আমাদের আছে? ২০১৬ সালে থাইল্যান্ডে শুনে এসেছিলাম, তাদের ভাষায় অল্প কয়েকটি অশ্লীল শব্দ আছে। তারা চেষ্টা করছে এই অশ্লীল শব্দগুলো তাদের ভাষা থেকে বাদ দিতে। অথচ আমাদের রক্ত দিয়ে কেনা এই ভাষায় প্রতিনিয়ত ঢুকছে অশ্লীল শব্দ বিদেশি শব্দ। আমরা ভাষা সংস্কৃতি সবর্ত্র আমাদের নিজস্বতা হারিয়েই দীনহীন হচ্ছি। ‘মাকে নিয়ে যে অশ্লীল বাক্যটি’ তা এক সময় ঢাকার স্থানীয়দের মধ্যে ছিল। বতর্মানে দুই বছরের বাচ্চা থেকে ৮০ বছরের বৃদ্ধ সবার মুখে সহজ এবং স্বাভাবিকভাবে রাস্তাঘাটে এ বাক্যটি শোনা যায়। এটা এখন সহজ একটি বাক্য। সুতরাং ধষর্ণ এক সময় পত্রিকার পাতায় শোভা পাবে না। এটাও স্বাভাবিক হয়ে যাবে। ফেব্রæয়ারি এলেই শরীর, কাপড়, দেয়াল, বাড়ির ছাদে সবর্ত্র ভালোবাসা আর চেতনার ছড়াছড়ি চলে। আমরা যদি আমাদের ভাষাকে সত্যিই মযার্দা দিতে চাই, ভালোবাসায় রাঙাতে চাই, শহীদদের সম্মান জানাতে চাই তাহলে আমাদের অবশ্যই যে বিষয়গুলো মানতে হবে তা হলোÑ ১. সত্য কথা বলতে হবে, সত্য প্রকাশ করতে দিতে হবে। ২. অশ্লীল শব্দের ব্যবহার রোধ করতে হবে। ৩. খিচুড়ি ভাষা পরিহার করতে হবে। ৪. ভাষা ধনী, দরিদ্র সবার জন্য সমান হতে হবে। ৫. ‘বিচার চাই’ এই ছোট্ট বাক্যটির গভীরতা রাষ্ট্রকে উপলব্ধি করতে হবে। ৬. ভাষা কী, ভাষা কেন প্রয়োজন, ভাষার ব্যাপকতা রাষ্ট্রকে উপলব্ধি করতে হবে। ৭. শরীর এবং পোশাকে নয় বুকের একান্ত গভীরে, জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে, বোধের জগতে ভাষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে হবে। আমার আমিকে প্রকাশের বাহন ভাষা সুতরাং এ আন্দোলন প্রবাহমান। শেষ হওয়ার নয়। আমার দুঃখিনী বাংলা ভাষা আইসিটি আইনের শৃঙ্খলে বন্দি। লক্ষণরেখা তার চারপাশে। অশ্লীলতা আর মিথ্যার ভ‚ষণে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে তার সৌন্দযর্। এ ভাষাকে মুক্ত করার দায়িত্ব নতুন করে আবার আমাদেরই তুলে নিতে হবে। শাকিলা নাছরিন পাপিয়া: কবি, কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক ও শিক্ষক