নতুন প্রজন্মকে জানতে দিন বীরাঙ্গনার ইতিহাস

প্রকাশ | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে পকিস্তানি হানাদাররা বাঙালি নারীদের ওপর চালিয়েছিল শারীরিক ও মানসিক নিযার্তন। সেই নিযার্তনের ক্ষত শুকায়নি এখনো। এখনো অনেক নারী এই ক্ষত বহন করে বেড়ান। হানাদাররা যে অমানবিক পাশবিক নিযার্তন করছে সেটি পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম নিমর্ম অত্যাচারের চিত্র পাওয়া দুষ্কর। এমনই নিযার্তন করা হয়েছিল আমার মা, বোনদের ওপর। বাংলাদেশের এমন কোনো এলাকা নেই, যে এলাকায় মেয়েদের সম্ভ্রম লুণ্ঠনের চিত্র পাওয়া যাবে না। হিন্দু, মুসলিম, বিবাহিত অথবা অবিবাহিত, বাঙালি আদিবাসী সব ধরনের বাঙালি নারীরাই মানবরূপী এই দানবদের লালসার শিকার হয়েছিলেন। তাদের এই লালসার ফল হিসেবে আমার মা-বোনরা অনেকেই গভর্সঞ্চারিত হয়েছিল। তারা সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন। এই সন্তানদের আমরা বলে থাকি যুদ্ধশিশু। আর নিযাির্তত নারীদের বলে থাকি ‘বীরাঙ্গনা’। বীরাঙ্গনা কোনো নেতিবাচক শব্দ নয়। এর অথর্ বীর নারী। যে নারী বীরত্বের কাজ করে তাদের এই নাম দেয়া হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজে মুক্তিযুদ্ধে নিযার্তনের শিকার এই নারীদের বীরাঙ্গনা উপাধী দিয়েছেন। তাদের গবির্ত করেছেন, করেছেন সম্মানিত। তাদের পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু বীরঙ্গনাদের জীবনের গল্প আমরা ইতিহাসে কতটুকু স্থান দিতে পেরেছি। যদি ইতিহাসে তাদের সঙ্গে সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার স্থান যথাথর্ভাবে না দেয়া হয় তাহলে নতুন প্রন্মের যারা তারা জানবে কী করে সত্যিকার কাহিনী। কী ঘটেছিল তাদের সঙ্গে? এটা লজ্জার কোনো বিষয় নয়। একটি দেশ অন্যায় আর শোষণ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য লড়াই করেছিল। সেই লড়াইটা বীরাঙ্গনারাও করেছিলেন। তারাও যোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধারা যেমন রণাঙ্গনে লড়াই করেছেন। তারা করেছেন শারীরিকভাবে। নিমর্মভাবে তাদের ওপর চড়াও হয়েছিল হায়নারা। তারা যে কী ধরনের অত্যাচার করেছিল সেটাই জানানো দরকার তরুণ প্রজন্মকে। যদি সত্যিই প্রগতিশীলতার চিন্তা-চেতনার অধিকারী করে নতুন প্রজন্মকে তৈরি করতে চান। যদি দেশের প্রতি ভালোবাসা, মমত্ববোধ জাগাতে চান তাহলে সত্যিকার ঘটনাটাই উপস্থাপন করতে হবে তাদের কাছে। গত সত্তর বছরে জামাির্নতে নাৎসিদের অত্যাচারের সুশৃঙ্খল প্রামাণ্য তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে সে দেশে। তার ওপর নিভর্র করে সাহিত্য ও চলচ্চিত্র নিমার্ণ করা হয়েছে। ইতিহাস লেখা হয়েছে। কোনো প্রজন্মকে ভুলতে দেয়া হয়নি নাজি বা ফ্যাসিস্টদের অত্যাচারের কথা। যে কারণে পাশ্চাত্যে নাজি বা ফ্যাসিবাদের উত্থান হয়নি। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে নারীদের ওপর নিযার্তনের ইতিহাস অনেকটাই অজানা। নারীরা অত্মসম্মানের ভয়ে এটা বলতে চাননি। অথবা ইতিহাসবিদরা ও গবেষকরা এই বিষয়ে বেশি একটা কাজ করেননি। তবে এটার ওপর সরকারিভাবে প্রচুর কাজ করা উচিত। বেশিদিন হয়নি আমাদের মধ্য থেকে গত হয়েছে বীরাঙ্গনা ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। একজন সাহসী বীরাঙ্গনা। যিনি নিজে বুক ফুলিয়ে এসব বলেছেন। অন্য নারীদেরও তা প্রকাশ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি সাহস জুগিয়েছিলেন নিযার্তনের শিকার নারীদের। অগ্রপ্রতীক ছিলেন তাদের। আমাদের বীরাঙ্গনাদের। তিনি নিজে রক্ষণশীলতাকে ভেঙে প্রাপ্য সম্মান অজের্ন সোচ্চার ছিলেন। স্বাধীনতা-পরবতীর্ ইতিহাস পড়লে বুঝা যায়, আমাদের সমাজকে বীরাঙ্গনারা কত অবহেলিত ছিলেন। যদিও ইতিহাস বেশি একটা নাই। হয়তো বীরাঙ্গনাদের কোনো পরিবার মেনে নিয়েছে। কিন্তু তখনই সমাজ মেনে নেয়নি। আবার সমাজ মেনে নিলে পরিবার মেনে নেয়নি। ফলে পরিবার এবং সমাজ থেকে আমাদের বীরাঙ্গনাদের রাস্তায় রাস্তা ঘুরেছেন। তার খবর কি আমরা রেখেছি! তাদের বীরাঙ্গনা হওয়ার পেছনে যে কত নিমর্ম গল্প রয়েছে। সেটা কি একবার চিন্তা করে দেখেছি! এই বিরাঙ্গনারাই পরিবার অথবা সমাজে নিহত হয়েছেন এবং হচ্ছেন। আমরা চাই দেশবাসী সত্য ঘটনাটাই জানুক। আমাদের মা বোনরা নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন শুধু একটি স্বাধীন দেশের জন্য। বাংলা ভাষার জন্য। বীরাঙ্গনাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্মান দিয়েছিলেন। আমরাও জাতির জনককে অনুসরণ করে বীরাঙ্গনাদেরকে এখন মা বলে ডাকি। তবে একটি কথা বলব বীরাঙ্গনাদের তখনই সত্যিকার সম্মান করা হবে যদি তাদের নিয়ে গবেষণা করা হয়। তাদের সত্যিকার ইতিহাসটা তরুণ প্রজন্মকে জানানো হয়। শতাব্দী জুবায়ের বাংলা বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়