বাস্তবায়ন হোক নদী রক্ষায় হাইকোটের্র ঐতিহাসিক রায়

হাইকোটের্র রায় বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের নদ-নদীগুলো দখল ও দূষণমুক্ত হোক। জলজ জ্যোৎ¯œায় আবার হেসে উঠুক দেশ- এ প্রত্যাশা সচেতন নদী প্রেমিক মানুষের।

প্রকাশ | ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

নিতাই চন্দ্র রায়
নদীর সঙ্গে আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিল্প-সাহিত্য, পরিবেশ-জীববৈচিত্র্য এবং কোটি কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কৃষি, মৎস্য চাষ, যোগাযোগ, পণ্য পরিবহন ও সুপেয় পানি সবরাহে নদীর ভ‚মিকা অপরিসীম। বষার্য় বৃষ্টিতে বা বন্যায় নদী-নালা ও খাল-বিলে যে বিপুল পানি প্রবাহের সৃষ্টি হয়, সেই পানিরই একটি অংশ চুঁইয়ে ভূগভের্ জমা হয়। অবৈধ দখলে নদী-নালা, খাল-বিলগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ার ফলে ভূগভর্স্থ পানির স্তর ক্রমাগত নিচে চলে যাচ্ছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে গভীর নলক‚পের সাহায্যেও মাটির নিচ থেকে পানি উত্তোলন করা সম্ভব হবে না। অভাব দেখা দেবে সুপেয় পানির। ব্যাহত হবে সেচ কাজ ও কল-কারখানার উৎপাদন। নদীগুলো মারা গেলে এ দেশে সবুজ শস্যক্ষেত্র, গাছপালা ও লতাগুল্ম কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। পরিবেশের মারত্মক অবনতি ঘটবে। মরুভূমিতে পরিণত হবে নদী মাতৃক বাংলাদেশ, যার কিছু কিছু আলামত দেখা যাচ্ছে দেশের উত্তর-পশ্চিাঞ্চলে। এ ধরনের সংকট শুরু হয়েছে পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে। পাকিস্তানের আথির্ক রাজধানী করাচির জনবহুল ও অবহেলিত অঞ্চলের নারী ও শিশুদের প্রতিদিন পানির সন্ধানে মাইলের পর মাইল হঁাটতে হচ্ছে। পাকিস্তানের প্রায় প্রতিটি শহরে এ দৃশ্য দেখা যায়। সরকারি এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশটির সীমান্ত এলাকায় প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষের বাড়িতে খাবার পানির সরবরাহ নেই এবং ৭০ শতাংশ পানিই দূষিত। সম্প্রতি হাইকোটের্র এক রায়ে নদী দখলকারীদের নিবার্চন করার ও ঋণ পাওয়ার অযোগ্য ঘোষণা করেছে। সেই সঙ্গে দেশের নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয় রক্ষায় জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে আইনগত অভিভাবক ঘোষণা করেছে উচ্চ আদালত। নদ-নদী, খাল-বিল, পাহাড়-পবর্ত ও সমুদ্র উপক‚ল সুরক্ষায় সম্প্রতি হাইকোটর্ যে রায় দিয়েছে তা সত্যই সময়োপযোগী ও প্রশংসার দাবিদার। এ রায় বস্তবায়ন ছাড়া নদ-নদী সুরক্ষা, নদী দূষণের হাত হতে পরিত্রাণ ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার আর কোনো উপায় নেই। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন মনে করে, নদী রক্ষা সম্পকের্ মানুষের মনের কথাই বলেছে আদালত। এ ব্যাপারে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যানের বক্তব্য হলোÑ এতদিন নদীর কোনো অভিভাবক ছিল না। এই পরিস্থিতির অবসান হয়েছে। হাইকোটের্র ঐতিহাসিক রায়ের পর কমিশনকে এখন থেকে দেশের সব নদ-নদীর অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করতে হবে। এ দায়িত্ব যেমন মহৎ, তেমনি অনেক বড়। কমিশনের এক সদস্য শারমিন মুরশিদের মতে, তাদের প্রত্যাশার চেয়েও আদালত বেশি দিয়েছেন। এতে তাদের দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে। নদী রক্ষায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাজে সমন্বয়ের সমস্যা হতো। সেই সমস্যা আর হবে না। জনবল ও অথার্য়নের সমস্যাও দূর হবে। রায় সম্পকের্ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, হাইকোটের্র এই রায়ে নদী রক্ষার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো। প্রভাবশালীদের মধ্যে যারা নিবার্চনে অংশ নিতে ইচ্ছুক, তাদের কেউ নদী দখলে যুক্ত থাকলে নিবার্চনে অযোগ্য হওয়ার আশঙ্কায় এই অপরাধ থেকে বিরত থাকবেন। গত ৩ জানুয়ারি, তুরাগ নদী রক্ষা নিয়ে এক রিট মামলার রায়ে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের হাইকোটর্ বেঞ্চ এ ঐতিহাসিক নিদের্শনা দেন। হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে এ মামলার শুনানি করেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। তুরাগ নদকে ‘ লিগ্যাল পারসন, জুরিসটিক পারসন ও জীবন্ত সত্তা’ হিসেবে ঘোষণা করে হাইকোটের্র দেয়া রায়ে দেশের নদ-নদী রক্ষায় প্রতিরোধমূলক বেশ কয়েক দফা নিদের্শনা দেয়া হয়েছে। নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করে দেয়া রায় দেশের ইতিহাসে এই প্রথম। এতে একজন মানুষের মতো নদীও আইনগত অধিকার পাওয়ার সুযোগ পেল। সংবিধানের ১৮(ক), ১৯ ও ৩২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জনগণের জানমাল, সম্পদ, স্বাস্থ্য, পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। তাই রায়ে ডকট্রিন অব পাবলিক ট্রাস্টকে ল অব দ্য ল্যান্ড ঘোষণা কওে বেশ কটি সিদ্ধান্ত দিয়েছে আদালত। এতে বলা হয়েছে, দেশের সব নদ-নদী, পাহাড়-পবর্ত, সমুদ্রসৈকত, বন, খাল-বিল, জলাশয়-জলাধারের মালিক হিসেবে ট্রাস্টির দায়িত্ব পালন করবে রাষ্ট্র। নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয় রক্ষার আইনগত অভিভাবক হবে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয়ের সুরক্ষা, সংরক্ষণ, অবৈধ দখল উচ্ছেদ, শ্রীবৃদ্ধিসহ সব দায়িত্ব পালন করবে নদী রক্ষা কমিশন। স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে নদী রক্ষা কমিশন যাতে কাযর্কর ভূমিকা রাখতে পারে, তা নিশ্চিত করতে রায়ে সরকারকে চার দফা নিদের্শনা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয় দখলকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে এর কঠিন সাজা ও জরিমানা নিধার্রণ করতে হবে। এসব বিষয় যুক্ত করে ২০১৩ সালের নদী রক্ষা কমিশন আইন সংশোধন করে ছয় মাসের মধ্যে তা হলফনামা আকারে আদালতে দাখিল করতে হবে। নদ-নদীর পাশে প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের অনাপত্তিপত্র নিতে হবে। বিষয়টি সরকারের সব বিভাগকে চিঠি দিয়ে জানাতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে নিদের্শ দিয়েছে আদালত। আদালত বলছে, স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দেশের সব নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয়ের অবস্থান চিহ্নিত ও নিণর্য় করে একটি ডিজিটাল ডাটাবেজ তৈরি করতে হবে। সেই ডাটাবেজ দেশের সব ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা, জেলা ও বিভাগে নাগরিকের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে। যে কোনো নাগরিক যেন নিদির্ষ্ট ফি দিয়ে নদ-নদীর ম্যাপ, তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন, সে ব্যবস্থা করতে হবে। নদী ও জলাশয়ের দখল বন্ধ করতে কিছু প্রতিরোধমূলক নিদের্শনাও দিয়েছে আদালত। এসব নিদের্শনার মধ্যে রয়েছে প্রতিটি জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদকে নিজের এলাকার নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয়ের অবৈধ দখলদারদের চিহ্নিত করে তাদের নামের তালিকা জনসম্মুখে ও পত্রিকায় প্রকাশ করতে হবে। নদী বা জলাশয় দখলকারী বা অবৈধ স্থাপনা নিমার্ণকারীরা ব্যাংক ঋণ পাওয়ার অযোগ্য বিবেচিত হবেন। ঋণ আবেদনকারীর বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখার ব্যবস্থা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। যে কোনো নিবার্চনে প্রাথীর্র বিরুদ্ধে নদী দখলের অভিযোগ থাকলে তাকে নিবার্চনের অযোগ্য ঘোষণা করবে নিবার্চন কমিশন। সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতি দুই মাসে কমপক্ষে ১ ঘণ্টা নদী রক্ষা, সুরক্ষা, দূষণ প্রতিরোধ, নদ-নদীর প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে সচেতনতামূলক পাঠদানের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ নিদের্শনা বাস্তবায়ন করবে। দেশের সব শিল্প-কারখানার শ্রমিক-কমর্চারীর অংশগ্রহণে প্রতি দুই মাস একদিন ১ ঘণ্টা সচেতনতামূলক সভা বা বৈঠক করতে হবে। শিল্পমন্ত্রণালয় এ নিদের্শনা বাস্তবায়ন করবে। প্রতিটি ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা, জেলা ও বিভাগে তিন মাসে একবার নদী বিষয়ে দিনব্যাপী সভা-সমাবেশ, সেমিনার করতে নিদের্শ দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কতৃর্পক্ষ এ নিদের্শনা বাস্তবায়ন করবে। আদালতের আরেক রায়ে বলা হয়েছে, নদীর সীমানার জায়গায় ক্রয়সূত্রে অন্যের মালিকানস্বত্ব সৃষ্টি হয় না। ঢাকার চার নদ-নদীর রিট মামলার রায়, সংবিধানর ১৮(ক) অনুচ্ছেদ, পরিবেশ আইন, ১৯৯৫ ও জলধার আইন, ২০০০-এর বিধান অনুযায়ী নদ-নদীর সীমানা দখল সম্পূণর্ বেআইনি ও পরিবেশ বিরোধী। রায়ে আদালত পক্ষভুক্ত হওয়া তুরাগ তীরে থাকা ১৪ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে তাদের স্থাপনা ৩০ দিরে মধ্যে নিজ খরচে সরিয়ে নিতে নিদের্শ দিয়েছেন। অন্যথায়, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ওই সব ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের খরচায় উচ্ছেদের ব্যবস্থা করবে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, নদী দখল ও দূষণ প্রতিরোধে ঢাকার চার পাশের নদীসহ সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে নদীর তীরে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেছে সরাকারের বিভিন্ন সংস্থা। গত কয়েক দিনে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনাসহ বিভিন্ন নদী তীরে প্রায় দেড় হাজার অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার চারপাশে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীতে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেছে অভ্যন্তরিক নৌপরিবহন কতৃর্পক্ষ। এ ছাড়া স্থানীয় জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম ও খুলনায়সহ বিভিন্ন নদী তীরে উচ্ছেদ অভিযান চলছে। গত ২৯ জানুয়ারি থেকে শুরু করে পঁাচদিনে ঢাকার চারপাশের নদীর তীরে ছোট-বড় ভবনসহ ৮৯৫টি অবৈধ স্থাপনা গঁুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে কণর্ফুলী তীর থেকে মোট ১৭০টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। খুলনার ময়ূর নদীসহ মহানগরের অভ্যন্তরীণ ২২ খালের অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ অভিয়ান পরিচালনা করছে খুলনা জেলা প্রশাসন। নদীর জমি উদ্ধারের পর, যাতে কেউ পুনরায় দখল করতে পারে, সে জন্য সীমানা চিহ্নিত করে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে করা হবে পরিকল্পিত বনায়ন। পাশাপাশি তৈরি করা হবে ওয়াকওয়ে ও ইকোপাকর্। ইতোমধ্যে ৮৫০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন করেছে পরিকল্পনা কমিশন। এ প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে দুই বছর।এ ধরনের প্রকল্প অন্যান্য নদীতীরেও গ্রহণ করা উচিত। শুধু ঢাকা চট্টগ্রাম ও খুলনা শহরের নদী তীরের অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ নয়; সারাদেশের সব নদী তীরের অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নদীতে শিল্প কারখানার তরল বজর্্য ও পয়ঃবজর্্য ফেলা বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। নিয়মিত নদী খননের ব্যবস্থা নিতে হবে। উজানের কোনো দেশ যাতে আন্তজাির্তক নদীগুলোর পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করতে না পারে সে ব্যাপারেও ক‚টনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে। গ্রামাঞ্চলের যেসব নদীতে মানুষ পাড় কেটে বোরো ধানের চাষ করছে, তাও বন্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে হাইকোটের্র রায়ের আলোকে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। হাইকোটের্র রায় বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের নদ-নদীগুলো দখল ও দূষণমুক্ত হোক। জলজ জ্যোৎ¯œায় আবার হেসে উঠুক দেশ- এ প্রত্যাশা সচেতন নদী প্রেমিক মানুষের। নিতাই চন্দ্র রায়: কলাম লেখক