আতাতুর্কবাদ বনাম এরদোয়ান

এরদোয়ান তার ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব দ্বারা দীর্ঘ ২০ বছর তুরস্ক শাসন করছেন। ভঙ্গুর অর্থনীতি এবং বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ সমস্যা থেকে তুরস্কের জনগণকে মুক্ত করেছেন। এক আধুনিক তুরস্ক জাতিকে উপহার দিয়েছেন। অর্থনৈতিক, শিক্ষা ও সামরিক খাতে ব্যাপক উন্নতি সাধন করেছেন।

প্রকাশ | ১০ জুন ২০২৩, ০০:০০

আতিকুর রহমান
টানা তৃতীয় মেয়াদে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। গত ২৮ মে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপে ৫২ দশমিক ১২ শতাংশ ভোট পেয়ে তার দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি) জয়ী হয়। অপরদিকে প্রধান বিরোধীদল রিপাবলিকান পিপলস পার্টি (সিএইচপি) কেমাল কিলিচদারগস্নু পেয়েছেন ৪৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ। উলেস্নখ্য, গত ১৪ মে তুরস্কে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরদোয়ান প্রথম দফায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে না পারলেও তার জোট সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ৬০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে ক্ষমতাসীন জোট ৩২১টি আসন লাভ করে। এর মধ্যে এককভাবে একেপি পার্টি ২৬৬টি আসনে জয়লাভ করে। অপরদিকে বিরোধী জোট ২১৩টি আসনে জয়ী হয়। এর মধ্যে এককভাবে কেমাল কিলিচদারগস্নু সিএইচপি জয় পেয়েছে ১৬৯টি আসনে। গত ২৮ মে'র নির্বাচন প্রমাণ করেছে, তুরস্ক এখন দু'ভাগে বিভক্ত। সিএইচপি এবং একেপি নিজ নিজ স্থান থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়ে নিজেদের চিন্তা ও মতাদর্শ তুরস্কে প্রতিষ্ঠিত করতে। সেখানে একেপি নির্বাচনী খেলায় গুটির চালে জয়ী হয়ে আগামী ২০২৮ সাল পর্যন্ত নিজেদের চিন্তা ও মতাদর্শ তুরস্কে প্রতিষ্ঠিত করতে তৎপর ভূমিকা পালন করবে। একেপির রাজনৈতিক ভাবাদর্শ মধ্যম-ডানপন্থি কিন্তু বহির্বিশ্বে, বিশেষ করে মুসলিম অধু্যষিত রাষ্ট্রগুলোর কাছে একেপি মধ্যম-ডানপন্থির পাশাপাশি ইসলামপন্থি দল হিসেবে সমধিক পরিচিত। দল প্রধান এরদোয়ানের মুসলিম বিশ্বে তুমুল জনপ্রিয়তা রয়েছে। যার মূল কারণ মুসলিম বিশ্বের প্রতি তার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। অপরদিকে, সিএইচপির রাজনৈতিক মতাদর্শ হলো মধ্যম-বামপন্থি, ধর্মনিরপেক্ষতা, সংস্কারবাদ ইত্যাদি। আতাতুর্কবাদ বলতে মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের রাজনৈতিক তত্ত্বকে বুঝাই। তিনি ছিলেন তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি। আদর্শগতভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা, সংস্কারবাদী ও জাতীয়তাবাদিতা লালন করতেন এবং নিজের দর্শন তুরস্কে প্রতিষ্ঠা করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন এবং বলা যায় তিনি শতভাগ সফলও হয়েছেন। মোস্তফা কামাল পাশা প্রথম পর্যায়ে তুর্কি ফিল্ড মার্শাল ছিলেন এবং সেনাবাহিনীতে থাকা অবস্থায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় গ্যালিপলির যুদ্ধে তুর্কীদের বিজয় নিশ্চিত করায় তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। পরবর্তী সময়ে, তিনি তুর্কী জাতীয় আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ১৯২৩ সালের ২৯ অক্টোবর তুরস্ককে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেন। নিজেই রাষ্ট্রপতির পদে আসীন হন পাশাপাশি একই সঙ্গে তিনি প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধানের দায়িত্ব কাঁধে নেন। তিনি ১৯২৪ সালের ৩ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে উসমানি খেলাফতের বিলুপ্ত ঘটান এবং ধর্মনিরপেক্ষতা ও পশ্চিমা সংস্কৃতির আদর্শ ধারণ করে তুরস্কের ব্যাপক সংস্কার পরিকল্পনা হাতে নেন। ইসলামের ওপর চড়াও হয়ে তিনি শতাব্দীর পর শতাব্দীতে পালিত হয়ে আসা উসমানি খেলাফতে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন ইসলামি আইন-কানুন বাতিল করেন। প্রকাশ্যে তিনি ঘোষণা দেন' ইসলামি চেতনা উন্নতির পথে অন্তরায় এবং ধর্ম ও রাষ্ট্র আলাদা বিষয়'। তিনি তুরস্কে ইসলামি আইন-কানুন সংস্কারে এমন স্পর্শকাতর পরিকল্পনা হাতে নেন যা ভিন্ন ধর্মীয় ব্যক্তির কাছেই ছিল অবাস্তব কল্পনা। তিনি শরয়ি বিচার বিভাগ বন্ধ করার আদেশ দেন, ওয়াকফ মন্ত্রণালয়ের বন্ধ করে দেন, কোরআননুল কারিম ও আজান তুর্কি ভাষায় দেওয়ার আদেশ জারি করেন, হিজাব পরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন, ইসলামি ক্যালেন্ডারে পরিবর্তে পশ্চিমা ক্যালেন্ডার গ্রহণ করেন, শুক্রবারের পরিবর্তে সাপ্তাহিক ছুটি শনিবারে ঘোষণা করেন, উসমানি খেলাফতের সময় স্থাপিত শত শত মসজিদ তালাবদ্ধ করেন এবং নতুন করে মসজিদ নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন; এমনকি আয়া সুফিয়া মসজিদকে মিউজিয়াম এবং মসজিদে ফাতিহকে গুদামঘরে পরিণত করেন। এককথায়, তিনি তুরস্ক থেকে ইসলামি চিহ্ন, চেতনা, আদর্শ সমূলে উৎপাটিত করতে তৎপর হন। ১৯৩৭ সালের ৩ ফেব্রম্নয়ারি তুরস্কের রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ঘোষণা করেন এবং জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সামাজিক প্রথা, ধর্মনিরপেক্ষতা, বিপস্নব ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব; এ ছয় মৌলনীতিতে আতাতুর্ক রাষ্ট্র পরিচালনা শুরু করেন। মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক ৫২ বছর বয়সে ১৫ বছর তুরস্ক শাসন করে ১৯৩৮ সালে মৃতু্যবরণ করেন। মৃতু্যর পর আতাতুর্কের বিশ্বস্ত বন্ধু ইসমত ইনোনকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করা হয় এবং তিনি আতাতুর্কের উত্তরসূরি হিসেবে তার আদর্শ বাস্তবায়নে সচেষ্ট হন। এরদোয়ান, এরদোয়ানের রাজনীতির হাতেখড়ি শুরু হয়েছিল ছাত্রজীবন থেকেই। ছাত্র বয়সে তিনি ইসলামিস্ট ন্যাশনাল স্যালভেশন পার্টির একটি অঞ্চলের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তী সময়ে ইস্তাম্বুলেরও যুব শাখার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৪ সালে ৪০ বছর বয়সে তিনি ইস্তাম্বুলের মেয়র নির্বাচনে ডার্ক হর্স মার্কায় নির্বাচন করেন এবং ২৫.১৯ % ভোটে জয়ী হয়ে ইস্তাম্বুলের মেয়র নির্বাচিত হন। এরদোয়ান যখন ইস্তাম্বুলের মেয়র নির্বাচিত হন তখন ইস্তাম্বুলের জনগণ বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত ছিল। বিশুদ্ধ পানির ঘাটতি, বিদু্যৎ, ট্রাফিক বিশৃঙ্খলা, বায়ুদূষণ ইত্যাদি। এরদোয়ান সব সমস্যা অত্যন্ত দক্ষতা ও দূরদর্শিতার সঙ্গে সমাধান করেন পাশাপাশি মিউনিসিপালিটির ২ বিলিয়ন ডলারের ঋণ পরিশোধ করেন এবং নগরের উন্নয়নে ৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এককথায়, এরদোয়ান উত্থান হয় মূলত ইস্তাম্বুলের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করার মাধ্যমে হয়। এ জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে এরদোয়ান ২০০২ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে বাজিমাত করেন। তার দল একেপি ২০০২ সালের ৩০ নভেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে ৩৪ দশমিক ৪ শতাংশ ভোট পেয়ে সংসদের ৫৫০ টি আসনের মধ্যে ৩৬৩ আসন লাভ করে এককভাবে সরকার গঠন করেন। নির্বাচনের আগে তুরস্ক বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ সমস্যায় নিমজ্জিত ছিল, অর্থনৈতিক সমস্যা, ঋণ বৃদ্ধি, অপব্যয়, সরকারের দুর্নীতি, সামরিক বাহিনীর অতিরিক্ত ব্যয়ভার, হিজাব ইসু্য, কুর্দি সমস্যা অন্যতম। এরদোয়ান নিজের প্রথম মেয়াদে দেশের সব অভ্যন্তরীণ সমস্যা দূরীকরণে মনোযোগী হন এবং অনেকাংশেই তিনি সফল হয়েছেন। দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসেছে তিনি ইসলামি আইন-কানুনের ওপর আরোপিত বিধিনিষেধ ধীরে ধীরে প্রত্যহার করেন এবং সেকুলারপন্থি সেনাবাহিনীর ক্ষমতা হ্রাস করেন পাশাপাশি এরদোয়ান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ধীরে ধীরে প্রভাব বিস্তারে নজর দেন এবং মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইসু্যতে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেন। এভাবে এরদোয়ান দীর্ঘ ২০ বছর নিজের দর্শন তুরস্ক প্রতিষ্ঠা করে চলেছেন। এরদোয়ান তার ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব দ্বারা দীর্ঘ ২০ বছর তুরস্ক শাসন করছেন। ভঙ্গুর অর্থনীতি এবং বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ সমস্যা থেকে তুরস্কের জনগণকে মুক্ত করেছেন। এক আধুনিক তুরস্ক জাতিকে উপহার দিয়েছেন। অর্থনৈতিক, শিক্ষা ও সামরিক খাতে ব্যাপক উন্নতি সাধন করেছেন। তুরস্কের জনগণকে হারানো উসমানি খেলাফতের আদর্শ লালন এবং পুনরায় খেলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখার জন্য উদ্বুদ্ধ করে চলেছেন। আতাতুর্ক কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সেকুলার নিয়মকানুন বাতিল করে তদস্থলে মধ্যেমপন্থি নিয়মকানুন চালু করেন। এরদোয়ান আজীবন সেকুলার রাষ্ট্র থেকে বেরিয়ে তুরস্ককে মধ্যমপন্থি রাষ্ট্র গঠনে সংগ্রাম করেছেন। এখনো তিনি সংগ্রাম করছেন, ভবিষ্যতে সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন। আতিকুর রহমান : নবীন কলাম লেখক