দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির এক্যবদ্ধভাবে গণতান্ত্রিক রাজনীতির অনুশীলনের প্রক্রিয়াটা শুরু করতে হবে।
প্রকাশ | ১৫ জুন ২০২৩, ০০:০০
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
আগামী সাধারণ নির্বাচনকে ঘিরে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যে হাওয়া সৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল তেমনটি হচ্ছে না। জনগণকে নির্বাচনমুখী করা বা জনগণকে সম্পৃক্ত করে সরকারবিরোধী কর্মসূচি নেওয়ার বিষয়ে বিরোধী দলগুলো ঢিলেঢালা কর্মসূচি নিচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচন বিষয়ে হয়ে উঠছে বিদেশি কূটনৈতিক নির্ভর। তাই রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলো তারা সম্পন্ন করছে দায়সারাভাবে। সবাই ধরনা দিচ্ছে এ দেশে অবস্থানরত বিদেশি দূতাবাসের কাছে- কেউ জনগণের কাছে আসছে না। রাজনৈতিক আন্দোলন এবং কর্মসূচির প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ কমছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশনে ভোট প্রদানের হার কমছে গত নির্বাচনের চেয়ে প্রায় আট শতাংশ। স্থানীয় সরকার ও জাতীয় নির্বাচনে ভোট প্রদানের বিষয়ে মানুষ আগ্রহ হারাচ্ছে। এটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য শুভ ইঙ্গিত বহন করে না। এ জন্য দায়ী কারা? দেশের একদল কথিত সুশীল রাতভর টক শো করেন। এই টক শোগুলো কি জনগণকে নির্বাচনমুখী বা রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে সম্পৃক্তকরণ করতে পারছে? না পারার কারণ নিশিকথকরাও রাজনৈতিক দলগুলোর আজ্ঞাবাহী। নিশিকথকরাও কীভাবে জনসাধারণের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ততা বাড়ানো যায় তা নিয়ে আলোচনা করে না। দেশের রাজনীতিটা এখন এক ধরনের ব্যবসা। এক সময় রাজনীতিটা ছিল জনসেবা, রাজনীতি করে লাভ তো দূরের কথা নিজের পারিশ্রমিকটাও রাজনীতিবিদরা আশা করতেন না। বর্তমানে যারা রাজনীতি এবং রাজনীতি সংক্রান্ত বিষয়ে কথা বলেন, তারা নিজেদের কায়েমি স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে এই কাজগুলো করে থাকেন। জনগণের কি হলো বা কী হবে তা নিয়ে তাদের কোনো ভাবনাচিন্তা নেই। তাই দেশের রাজনীতিটা বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত হয়ে গেছে। নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বিষয়ে কথা বলার মানুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এই কমার মূল কারণ হলো দেশ এখনো দুই শিবিরের বিভক্ত। মার্কিনিদের কিছু কার্যক্রমে বিভক্তির বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিনিরা পাকিস্তানিদের পক্ষে ছিল, আবার ১৯৭৫ সালের পট পরির্বতন হয় মার্কিনিদের ঈঙ্গিতে, '৭৫-এর পট পরির্বতনের পর ক্ষমতায় এবং রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয় '৭১-এর পরাজিত শক্তি। যা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবাহী সাধারণ মানুষ মেনে নিতে পারে না। তাই সৃষ্টি হচ্ছে না গণতান্ত্রিক পরিবেশ। সামগ্রিক রাজনীতির পেক্ষাপটটির রাজনৈতিক কার্যকলাপের রূপটা নিয়েছে স্বাধীনতার পক্ষ আর বিপক্ষ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির সবকিছুই '৭১-এর আর্দশবাহীদের কাছে পছন্দের। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির কতিপয় রাজনৈতিকরা নির্দ্বিধায় অনিয়ম করে যাচ্ছে। স্বাধীনতার ৫২ বছরের রাজনৈতিক অনুশীলনের দেশবিরোধী রাজনৈতিক শক্তির ঘাঁটিটা নির্মূল হয়নি। এটা জাতির জন্য লজ্জাজনক। এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তির রাজনীতি অনুশীলনটা সম্পূর্ণরূপে বিফল হয়েছে। '৭১-এর পর সিরাজুল আলম খানের তাত্ত্বিক ধারণায় এ দেশে গড়ে উঠেছিল জাসদ। জাসদের প্রত্যাশা বা আর্দশ ছিল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষ সাম্য সমতার রাষ্ট্র গড়ার। বাস্তবে কি দেখা যায়, ১৯৭২ সালে গঠিত জাসদে তুণমূল পর্যায়ে স্বাধীনতাবিরোধীরা যোগ দেয়। পাকিস্তানি ভাবাদর্শপূর্ণ নাগরিকরাই বেশির ভাগ জাসদ হয়ে যায়। শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর সরকার হঠানোর আন্দোলন। এটা ছিল জাতির জন্য বড় ধরনের বিপর্যয়- কারণ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রবর্তক বীরমুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল আলম খান ছিলেন বঙ্গবন্ধুর একান্ত ঘনিষ্ঠজন। তাকে মহান মুক্তিযুদ্ধের নিউক্লিয়াসও বলা হয়ে থাকে। কারণ 'স্বাধীন বাংলা বিপস্নবী পরিষদ' নামে গোপন সংগঠনটি তিনি গড়ে তুলেছিলেন ১৯৬২ সালে। আর তিনি যখন জাসদ নামে দল গঠন করলেন আর ওই দলে '৭১-এর বিরোধীরা আশ্রয় নিল তাতেই দেশের রাজনৈতিক পেক্ষাপট গেল পাল্টে। ওই পাল্টানো ধারাটা আজও বহমান। এর ওপর ভর করেই ঘটল '৭৫-এর নির্মম হত্যাকান্ড। বিভক্ত হলো স্বাধীন দেশ দুই শিবিরে। '৭১-এর পরাজিত শক্তি এদেশীয় পাকিস্তানি দোসররা পুর্নবাসিত হলো রাজনীতিতে। ঘটনার পরম্পরা বিশ্লেষণে জানা যায়, সবকিছুই ঘটেছে মার্কিনিদের ইঙ্গিতে। তাই দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের বিষয়টা দাঁড়িয়ে গেছে বিদেশি নির্ভর। কয়েকদিন আগে একজন রাস্তার মিস্ত্রির সঙ্গে কথা হলো, তিনি আমাকে বললেন, কি বুঝাতাছেন ভাই, হাসিনা সরকার টিকে থাকতে পারবে? আমি বললাম, সামনে নির্বাচন, দেখা যাক কি হয়। তিনি বললেন, বিদেশিরা তো এখন আর হাসিনার সরকারকে চাইছে না। আমি বললাম, বিদেশিরা কি ভোট দেবে, ভোট দেব আমরা। তিনি বললেন, ভোট তো আর দিতে হয় না, আমি বললাম তাহলে কি বিদেশিরা আমাদের হয়ে হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দেবে। তাকে বুঝিয়ে বললাম, আমরা ভোট দিতে না পারলে আন্দোলন করতে পারি- যাতে করে স্বচ্ছ পক্রিয়ায় ভোট হয়, বিদেশিদের ওপর কেন নির্ভর করব। কিন্তু ওই রাস্তার মিস্ত্রি তা বুঝতে চাইছে না। তার ধারণা বিদেশিদের ছাড়া এ দেশের সরকার পরির্বতন হয় না। ভোট কোনো বিষয়ই না এবং আন্দোলন করে কিছুই করা যায় না। যা করতে পারবে তা বিদেশিরাই পারবে। এই মিস্ত্রি লেখাপড়া বলতে নাম স্বাক্ষরটা করতে পারে। দেশের গণতান্ত্রিক বিষয়গুলো এভাবেই এ দেশের সাধারণ মানুষের মনোজগতে বাসা বেঁধেছে। অথচ এই বাঙালিরাই ১৯৭১ সালে কোনো বিদেশি শক্তির ওপর নির্ভর না করে দেশমাতৃকাকে পাকিস্তানি হায়েনার কবল থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে বাঁশের লাঠি নিয়েই মুক্তিযুদ্ধে নেমেছিল। নিজেদের অধিকার আদায়ের সশ্রস্ত্র সংগ্রামে। আজ ৫২ বছর পর এসে সেই জাতিই মনে করে সরকার পরির্বতন করবে বিদেশি শক্তি। এর জন্য দায়ী মূলত, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের রাজনৈতিকগোষ্ঠী। কারণ তাদের ক্ষমতার দ্বন্দ্বের যে কাদা ছোড়াছুড়ি হয়েছিল, সেই কাদা ছোড়াছুড়ির মাঝেই '৭১-এর পরাজিত শক্তি এবং মার্কিনিরা এ দেশের রাজনীতিতে ঘাঁটি গড়ে তুলে। আজকের দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকাটা '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। ১৯৭৪ সালে এসে এই পত্রিকার ভূমিকাটা হয়ে উঠে বির্তকিত। রাজাকারা এ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এভাবে আসেনি তাদের ডেকে আনা হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার জিয়া রাষ্ট্রপতি হয়ে বিএনপিতে ঠাঁই দেয় রাজাকারদের। সেই সঙ্গে জামায়াতকে পুর্নবাসনের পক্রিয়ার কাজটি শুরু করে। পাকিস্তান ফেরত এরশাদকে জিয়া সেনাপ্রধান বানায়। আর এই কর্মকান্ডগুলো জিয়া সম্পন্ন করে মার্কিনি পরামর্শে। ফলে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে মোড়লের আসনে বসে যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিনি মোড়লীপনা এ দেশের জনগণের জন্য হিতকর হবে না তা এ দেশের একজন অবুঝ বালক বুঝে কিন্তু দুঃখের বিষয় এ দেশের রাজনৈতিক নেতারা তা বুঝে না মসনদে বসার লোভে। বর্তমানে মার্কিনিদের নানা ধরনের ইঙ্গিতে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে যে, দেশে পরিশীলিত গণতন্ত্র চর্চার বিষয়টি সুদূর পরাহত হয়ে যাবে।
বিদেশি দেশি নানা ধরনের অশুভ চালের ফলে এ দেশের সাধারণ মানুষ রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। কোন জনসভায় মানুষ আসে না স্বতঃস্ফূর্তভাবে। নিজেদের মাঝে চায়ের স্টলে রাজনৈতিক আলোচনাও আজকাল তেমন একটা হয় না। এটা গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য অশুভকর।
দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির এক্যবদ্ধভাবে গণতান্ত্রিক রাজনীতির অনুশীলনের প্রক্রিয়াটা শুরু করতে হবে।
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : কলাম লেখক