কবি আল মাহমুদের প্রয়াণ

সাহিত্যজগতে তার শূন্যতা অপূরণীয়

প্রকাশ | ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
নিয়তির বিধান মেনে লোকান্তরিত হয়েছেন বাংলা ভাষার অন্যতম কবি ও সাহিত্যিক আল মাহমুদ। ১৫ ফেব্রæয়ারি শুক্রবার রাত ১১টা ৫ মিনিটে রাজধানীর একটি হাসপাতালে লাইফ সাপোটের্ থাকাকালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ৮২ বছর বয়সী কবি। তিনি ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোড়াইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রকৃত নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়াংশে সক্রিয় থেকে আধুনিক বাংলা কবিতাকে তিনি নতুন আঙ্গিকে, চেতনায় ও বাক্ভঙ্গিতে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ ও প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্প লেখক, শিশুসাহিত্যিক এবং সাংবাদিক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি সম্মুখ সমরে অংশ নিয়েছিলেন। কবির মৃত্যুর খবরে ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচুর ভক্ত ও গুণগ্রাহী শ্রদ্ধা জানিয়ে শোক প্রকাশ করেছেন। . তথ্য মতে, ১৯৫৪ সালে ১৮ বছর বয়স থেকে তার কবিতা প্রকাশ পেতে থাকে। সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত ‘সমকাল’ কলকাতার ‘নতুন সাহিত্য’, ‘চতুষ্কোণ’, ‘ময়ূূখ’, ‘কৃত্তিবাস’ ও বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায় লেখালেখির সুবাদে ঢাকা-কলকাতার পাঠকদের কাছে সুপরিচিত ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘লোক লোকান্তর’ (১৯৬৩) তাকে স্বনামধন্য কবিদের সারিতে জায়গা করে দেয়। এরপর ‘কালের কলস’ (১৯৬৬), ‘সোনালি কাবিন’ (১৯৬৬), ‘মায়াবী পদার্ দুলে উঠো’ (১৯৬৯) কবিতাগুন্থগুলোর মাধ্যমে তিনি কবি হিসেবে ব্যাপক খ্যাতি অজর্ন করেন। তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার শহরমুখী প্রবণতার মধ্যে ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ আবহ, নদীনিভর্র জনপদ, চরাঞ্চলের জীবনপ্রবাহ এবং নরনারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহকে কবিতায় উপজীব্য করেন। নারী ও প্রেমের বিষয়টি তার কবিতায় ব্যাপকভাবে এসেছে। উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী হিসেবে নারীর যৌনতা, আকাক্সক্ষা ও ভোগের লালসাকে তিনি শিল্পের অংশ হিসেবেই দেখিয়েছেন। আধুনিক বাংলা ভাষার প্রচলিত কাঠামোর মধ্যে স্বাভাবিক স্বতঃস্ফ‚তর্তায় আঞ্চলিক শব্দের প্রয়োগের ক্ষেত্রেও তিনি অনন্য কীতির্র অধিকারী। সঙ্গত কারণে তার মৃত্যুতে সাহিত্যজগতে গভীর এক শূন্যতা সৃষ্টি হওয়াও অমূলক নয়। উল্লেখ্য, ১৯৫০-এর দশকে যে কয়েকজন লেখক বাংলা ভাষা আন্দোলন, জাতীয়তাবাদ, রাজনীতি, অথৈর্নতিক নিপীড়ন এবং পশ্চিম পাকিস্তানি সরকার বিরোধী আন্দোলন নিয়ে সোচ্চার ছিলেন, কবি আল মাহমুদ তাদেরই একজন। সংবাদপত্রে লেখালেখির সূত্র ধরে ১৯৫৪ সালে মাহমুদ ঢাকা আসেন। লেখালেখির এক পযাের্য় তিনি সরকারবিরোধী দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। সম্পাদক থাকাকালে সরকারের বিরুদ্ধে লেখার কারণে এক বছরের জন্য কারাবরণও করেন। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি গল্প লেখার দিকে মনোযোগী হন। ১৯৭৫ সালে তার প্রথম ছোটগল্প গ্রন্থ ‘পানকৌড়ির রক্ত’ প্রকাশিত হয়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে শিল্পকলা একাডেমির গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের সহপরিচালক পদে নিয়োগ দেন। দীঘির্দন দায়িত্ব পালনের পর তিনি পরিচালক হন। আর পরিচালক হিসেবেই ১৯৯৩ সালে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি অকপটে বলেছেন, ‘আমাদের ধমর্ হোক ফসলের সুষম বণ্টন।’ তবে ১৯৯০-এর দশক থেকে সাম্যবাদী চেতনার এই কবির কবিতায় বিশ্বস্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস উৎকীণর্ হতে শুরু করলে তিনি গ্রগতিশীলদের সমালোচনার মুখোমুখি হন। স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে অঁাতাতের বিষয়টিও আলোচনায় আসে। কোনো কোনো তাত্তি¡কের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, বিশ্বাসগ্রস্ততার কারণে তার বেশকিছু কবিতা লোকায়তিক সাহিত্যদশর্ন দৃষ্টান্তবাদ দ্বারা অগ্রহণযোগ্য। আবার একথাও সত্য, কবিতায় দশর্ন থাকে, কিন্তু দশর্ন দিয়ে কবিতা নিয়ন্ত্রিত নয়, কবিতা আবেগের কারবার। আল মাহমুদ সাহিত্যকমের্র স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৬৮ সালে বাংলা একাডেমি এবং ১৯৮৬ সালে একুশে পদক অজর্ন করেন। এ ছাড়াও অজর্ন করেছেন জয় বাংলা পুরস্কার, হুমায়ুন কবীর স্মৃতি পুরস্কার, জীবনানন্দ স্মৃতি পুরস্কার, কাজী মোতাহার হোসেন সাহিত্য পুরস্কার, কবি জসীমউদ্দীন পুরস্কার, ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার, নাসির উদ্দিন স্বণর্পদক, ভানুসিংহ সম্মাননা পদক এবং লালন পুরস্কার। সাবির্কভাবে বাংলা কবিতা ও সাহিত্যে তিনি যে অবদান রেখেছেন তা অবিস্মরণীয়, অভ‚তপূবর্। তার কীতির্ কখনো ¤øান হতে পারে না, তার মৃত্যুজনিত শূন্যতাও অপূরণীয়। তবে তার বহুলপঠিত গ্রন্থ ‘সোনালি কাবিন’-এর মধ্যদিয়ে তিনি প্রজন্মের পর প্রজন্ম, পাঠক হৃদয়ে পুনজার্গরিত হবেন, এমনটি আশা করা যায়। আমরা তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনাসহ শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।