গণমাধ্যমের স্বাধীনতা
রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে স্বাধীন গণমাধ্যমের অনস্বীকার্য ভূমিকাকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বিরোধী দল অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে থাকে। কোনো কারণে কোনো জায়গায় যদি সরকারের প্রতিপক্ষ হিসেবে বিরোধী দল জনগণের পক্ষ নিয়ে ভূমিকা পালন করতে না পারে সে জায়গায় গণমাধ্যমের সোচ্চার কণ্ঠ রাজনীতিতে একটি ব্যালেন্স নিয়ে আসতে পারে।
প্রকাশ | ২৩ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০
মো. সাখাওয়াত হোসেন
স্বাধীন গণমাধ্যমের বিষয়ে আমরা সবাই সোচ্চার, কিন্তু কার্যত কতজন আমরা গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা মানে পত্রিকায় যা খুশি তা লেখা নয়; প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্তের সমন্বয়ে যে কোনো বিষয়ে সংবাদ পরিবেশন করাই হচ্ছে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা থাকলে মাধ্যমগুলো নিঃসঙ্কোচে-নির্ভয়ে সংবাদ পরিবেশন করতে পারে, আর স্বাধীনতা খর্বিত হলে যে কোনো একটি পক্ষের লেজুড়বৃত্তি করে সংবাদ পরিবেশনে ব্যতিব্যস্ত থাকে সংবাদ মাধ্যমগুলো। গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় সরকারের ইতিবাচক দিকের যেমন প্রশংসা করা যায় আবার নেতিবাচক বিষয়ের সমালোচনাও পত্রিকার পাতায় তোলে নিয়ে আসা যায়। সঙ্গত কারণেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ব্যতীত সত্যিকারের সমালোচনা আশা করা দুরূহ। সময় ও একাত্তর টিভির টকশো বর্জনের সিদ্ধান্ত বিএনপি নেতাদের, এমন সংবাদ গণমাধ্যমের প্রকাশিত হওয়ার পর সংশ্লিষ্টজনদের তীব্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। প্রকৃত অর্থে বিএনপি ক্ষমতায় এলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় তারা কী করবে, এমন প্রশ্ন ঘুরেফিরে সামনে আসছে। উলেস্নখ্য, ক্ষমতায় থেকে তারা প্রথম একুশে টিভিকে বন্ধ করেছিল।
গণমাধ্যমে বিকাশে তার সরকারের অবদানের কথা উলেস্নখ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, '১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে আমরাই দেশে প্রথম বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন চালুর অনুমোদন দিই। আমরা ২০০৯ সাল থেকে গণমাধ্যম, তথ্য ও তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশে ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। আমরা তথ্য অধিকার আইন-২০০৯ প্রণয়ন করে তথ্য কমিশন প্রতিষ্ঠা করেছি। জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা-২০১৪ প্রণয়ন করা হয়েছে। বেসরকারি খাতে অনেকগুলো টেলিভিশন, এফএম রেডিও এবং কমিউনিটি রেডিও চ্যানেলের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের ফলে টেলিভিশন সম্প্র্রচারে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। দেশের গণমাধ্যম এখন পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করছে।' অর্থাৎ গণমাধ্যমবান্ধব আওয়ামী লীগ সরকার গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছে।
বিএনপির পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্টদের প্রতি চিঠিতে উলেস্নখ করা হয়, 'কয়েকটি টিভি চ্যানেলের মালিক পক্ষ সরকারি দলকে খুশি করতে উলঙ্গভাবে আমাদের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে আমাদের নেতা তারেক রহমানের বিরুদ্ধে শত্রম্নতামূলক প্রতিবেদন করেই চলছে। কখনো কখনো টকশো মঞ্চের উপস্থাপক অথবা উপস্থাপিকাসহ গোটা মঞ্চটাই পরিকল্পিতভাবে সাজানো হয় আমাদের দল ও নেতৃত্বকে হেয় করতে। এমতাবস্থায় দলের সিনিয়র আলোচকদের পরামর্শ ও যথাযথ হাইকমান্ডের অনুমোদনক্রমে আমরা একাত্তর ও সময় টিভির টকশো সাময়িকভাবে বর্জন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।'
এতে বিএনপি সমর্থক আলোচকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে চিঠিতে আরও বলা হয়, 'আমাদের দলের আলোচকদের অনুপস্থিতিতে দর্শকদের কাছে সংশ্লিষ্ট ওই টকশো ও চ্যানেল দর্শকশূন্যতায় পর্যবসিত হবে। আর তখনই কেবল তারা আমাদের দর্শক-শ্রোতাদের পছন্দ ও সত্য তথ্য দিতে বাধ্য হবে। আসুন আমরা সব আলোচক আগামী ৯ আগস্ট থেকে একাত্তর ও সময় টিভির টকশোতে অংশগ্রহণ বন্ধ রাখি।' বিএনপির এ ধরনের সিদ্ধান্তের পরবর্তী সময়ে রাজনীতিতে ব্যাপারটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। এ আলোচনার হেতু সাংবাদিক সমাজ থেকে অতিক্রম করে দেশের প্রতিটি মানুষের কাছে একটি উলেস্নখযোগ্য বিষয় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে সরাসরি চিঠি দিয়ে মিডিয়া বয়কটের এমন চিত্র তেমন নেই বললেই চলে।
নির্বাচনের প্রাক্কালে দুটি মিডিয়ার ওপর বিএনপির এ ধরনের বয়কট পুরো সাংবাদিক সমাজকে আহত করেছে, শুধু তাই নয়; এ দলের ব্যাপারে সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে সাংবাদিক সমাজের একটি বিশেষ ভয় কাজ করবে। বিএনপি সংক্রান্তে কোনোরকমের নিউজে বিএনপির শীর্ষ কমান্ড রাগান্বিত হয়, সংক্ষুব্ধ হয়ে বয়কট করে- এ মর্মে সাংবাদিকরা সংবাদ পরিবেশন করতে উৎকণ্ঠায় থাকবে। এ ছাড়া বিএনপি যখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল তখন একুশে টিভির সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় সরকার। কাজেই সাংবাদিকদের প্রতি বিএনপির বিরাগভাজনের ইতিহাস নতুন নয়, পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় এলে দলটি সাংবাদিক সমাজের ওপর যে কোনো রকমের বিরূপ সিদ্ধান্ত নিতেও পিছপা হবে না এমনটিই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকরা।
রাজনীতির মাঠে হঠকারী সিদ্ধান্ত, ক্রোধের রাজনীতি প্রকৃত অর্থে সংশ্লিষ্টদের জন্য শাপেবর হয়। তাছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ ধরনের বিষয় সব সময়ই অগ্রহণযোগ্য আকারে পরিচিতি পেয়েছে এবং ভবিষ্যতেও পরিচিতি পাবে। প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে আরও বিচক্ষণ হতে হবে, এ ছাড়া তেমন বিকল্প নেই। এমনও হতে পারে, দলটির অনেক সদস্য উলিস্নখিত টিভি দুটি থেকে প্রচারিত টকশো অবলোকন করে না কিন্তু অন্যান্য অনেক অনুষ্ঠানের মুগ্ধ দর্শক। তাদের ক্ষেত্রে এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের বাস্তবতা তেমন নেই, তাছাড়া দলটির এ ধরনের অবিচেনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত দলের অনেক নেতাকর্মীকে আহত করেছে, মনোকষ্ট প্রদান করেছে। এছাড়া তাদের এ ধরনের সিদ্ধান্তে বিএনপির মিডিয়া উইংয়ের সঙ্গে কাজ করা অসংখ্য সাংবাদিকরা সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে আগ্রহ বোধ নাও করতে পারেন। কেননা, সাংবাদিকদের মধ্যে ঐক্য রয়েছে, সংহতিবোধ রয়েছে; সে জায়গা থেকে দুটি মিডিয়ার ওপর এমন অযাচিত আচরণ অন্য মিডিয়াতে সংযুক্ত সাংবাদিকদের মনোকষ্টের কারণ হতে পারে। অধিকন্তু অন্যান্য সাংবাদিকরা যদি বিএনপিকে বয়কট করে তাহলে বিএনপি ঘোষিত কর্মসূচি সংবাদপত্রে কভারেজ না পেলে বিএনপি দলীয়ভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। তাছাড়া বিএনপির এ ধরনের সিদ্ধান্ত, রাজনীতির ময়দানে বিএনপির তুলনায় অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে এগিয়ে রাখবে। কাজেই বিএনপির হাইকমান্ডের উচিত এ ধরনের স্পর্শকাতর বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে আরও দূরদর্শী চিন্তা ভাবনার জায়গা থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া।
রাজনীতির ময়দানে রাজনীতিবিদদের ভূমিকাকে ও গৃহীত কর্মকান্ডকে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে সাংবাদিকদের অগ্রণী ভূমিকা রাজনীতিবিদদের কাজকে সহজ করে দেয়। অর্থাৎ রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে দেশগড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ভিন্নভাবে বলা যায়, পরস্পর পরস্পরের সহযোগী হিসেবে কাজ করে। সেই জায়গায় যদি রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকরা পরস্পর পরস্পরের প্রতিপক্ষ হয়ে যায়, আস্থা-অনাস্থার সৃষ্টি হয় তাহলে রাজনীতির সমীকরণ বিপরীতমুখী হয়ে যায়। সংশ্লিষ্ট দুটি টেলিভিশনের সুনির্দিষ্ট টকশোর বিষয়ে প্রয়োজনীয় বিষয়াদি উলেস্নখ করে বিএনপি বিবৃতি প্রদান করলে বিএনপির জন্যই সেটা মঙ্গলজনক হতো। কিন্তু বিএনপি দুটি মিডিয়াকে বয়কট করে দলীয়ভাবে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে, দলীয় নেতাকর্মীদের কাছে বিএনপির হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে স্বাধীন গণমাধ্যমের অনস্বীকার্য ভূমিকাকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বিরোধী দল অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে থাকে। কোনো কারণে কোনো জায়গায় যদি সরকারের প্রতিপক্ষ হিসেবে বিরোধী দল জনগণের পক্ষ নিয়ে ভূমিকা পালন করতে না পারে সে জায়গায় গণমাধ্যমের সোচ্চার কণ্ঠ রাজনীতিতে একটি ব্যালেন্স নিয়ে আসতে পারে।
শুধু তাই নয়, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের খবরাখবর মুহূর্তের মাধ্যমে সবার গোচরীভূত করার কাজটিও সাংবাদিক বন্ধুরাও করে থাকে। সাংবাদিকদের কারণেই কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে বেগ পেতে হয় না। তবে হলুদ সাংবাদিকতার বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা। সে কারণেই, সাংবাদিকদের যৌক্তিক সমালোচনা সহ্য করার সৎসাহস ও মনোবল না থাকলে রাজনীতির জায়গায় কাজ করার নৈতিকতা নিয়ে অনেকেরই প্রশ্ন থেকে যায়।
মো. সাখাওয়াত হোসেন : চেয়ারম্যান, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়