রিজার্ভ বাড়াতে নানামুখী পদক্ষেপ নিতে হবে

রিজার্ভ বৃদ্ধির জন্য আমাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এর মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান দুইটি উৎসকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এক, রপ্তানি আয়। রপ্তানি আয় বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস। রপ্তানি আয় বৃদ্ধিতে চারটি কাজ করতে হবে। এগুলো হলো যথাক্রমে- পণ্য বহুমুখীকরণ, বাজার বহুমুখীকরণ, প্রযুক্তি বহুমুখীকরণ ও বিনিয়োগ বহুমুখীকরণের দিকে নজর দিতে হবে। পণ্য বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে সবার আগে পোশাক খাতের বাহিরে থাকা পাট, চামড়া, সিরামিক ইত্যাদি খাতকে গুরুত্ব দিতে হবে। একইসঙ্গে রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য ইউরোপের বাহিরের দেশগুলোর দিকে নজর দিতে হবে। যেমন চীন, জাপান, রাশিয়া, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, ভারত- এসব দেশে রপ্তানি বাড়াতে হবে। আর তার জন্য প্রয়োজন এসব দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি করা।

প্রকাশ | ২৬ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০

শহীদুল ইসলাম
একটি দেশ তথা বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের আসল গুরুত্ব হলো এটি একটি দেশের অর্থনীতির গতিশীলতা ও শক্তির প্রতীক। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত বলতে কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রায় গচ্ছিত সম্পদকে বুঝায়। অর্থাৎ রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স, ঋণ বা অন্যান্য উৎস থেকে আসা বৈদেশিক মুদ্রা থেকে আমদানি, ঋণ ও সুদ পরিশোধ, বিদেশে শিক্ষা ইত্যাদি নানা খাতে ব্যয় হওয়া বৈদেশিক মুদ্রা বাদ দেওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে যা সঞ্চিত থাকে সেটাই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। সাধারণত শক্তিশালী বা অনমনীয় মুদ্রা যা আন্তর্জাতিক বাজারে সহজে বিনিময়যোগ্য, যেমন- মার্কিন ডলার, ব্রিটিশ পাউন্ড, ইউরো, ইয়েন, ইত্যাদি মুদ্রায় বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ গড়ে তোলা হয়। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত একটি দেশের নিজস্ব মুদ্রার দেনা পরিশোধ ও মুদ্রানীতি প্রভাবিত করতে ব্যবহৃত হতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত দেশের অর্থনীতির ঘাত প্রতিরোধ ক্ষমতা ও নমনীয়তা বৃদ্ধি করে। দেশীয় মুদ্রামানের দ্রম্নত অবমূল্যায়ন ঘটলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ ব্যবহার করে বাজারের ঘাত প্রতিরোধ করা হয়। বর্তমানে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ রিজার্ভ হচ্ছে ডলার- যা সহজে বিভিন্ন মুদ্রায় কনভার্ট করা যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকে ডলার ছাড়াও আরও কয়েকটি দেশের মুদ্রায় রিজার্ভ রাখা হয়। এইতো মাত্র দুই বছর আগের কথা। ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উন্নীত হয়েছিল দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৪৮ দশমিক ০৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। পরের বছর তথা ২০২২ সালের জুলাইয়ে তা কমে দাঁড়িয়েছিল ৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। আর চলতি ২০২৩ সালের মে মাসে আরো কমে তা নেমে আসে ২৯ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঘরে। এটাতো হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এতদিন যে নিজস্ব হিসাবায়ন পদ্ধতি অবলম্বন করে আসছিল সে হিসাব। এখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণপ্রাপ্তির শর্তের চাপে পড়ে জুলাই থেকে আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুসরণ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সে হিসাবের আলোকে দেশে এ মুহূর্তে (১৬ আগস্ট পর্যন্ত) রিজার্ভের পরিমাণ ২৩ দশমিক ২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ব্যবহারযোগ্য তথা নিট রিজার্ভ এর পরিমাণ হবে প্রায় ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা তার চেয়েও কম। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূলত জ্বালানি তেল, এলএনজি সারসহ, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির দায় মেটানোর জন্য ডলার বিক্রি করছে। পাশাপাশি সরকারের বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধের জন্যও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে বলে জানা যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে রেকর্ড প্রায় সাড়ে ১৩ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর চলতি অর্থবছরের এখন পর্যন্ত প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছে। অর্থাৎ রিজার্ভ থেকে যে হারে ডলার ছাড়া হচ্ছে তার ফলে আগামীতে রিজার্ভ যে আরো সংকুচিত হবে তা সহজেই অনুমেয়। রিজার্ভ সংকটের পেছনে প্রধানত দুইটি কারণ দায়ী- এক, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও দুই, করোনা মহামারি। মূলত করোনা মহামারি পরবর্তী সময় ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানিসহ বিভিন্ন জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পায়। এতে আমাদের দেশের আমদানি ব্যয়ও বৃদ্ধি পায়। রপ্তানি উন্নয়ন বু্যরোর তথ্যমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরের চেয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রায় ৪৬ শতাংশ আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছিল। এতে ওই সময় ইতিহাসে রেকর্ড পরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতির মুখে পড়ে বাংলাদেশ। যার পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল প্রায় ৩৩ দশমিক ২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। একই বছরে ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ১৮ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এতে বৈদেশিক মুদ্রা ডলারের সংকট দেখা দেয়। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে চাহিদামত বাজারে ডলার ছাড়তে হয়। যার প্রভাব পড়ে রিজার্ভ এর ওপর। ফলে রিজার্ভ ধীরে ধীরে কমতে থাকে। একইভাবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২০২১-২২ অর্থবছরের চেয়ে আমদানির পরিমাণ প্রায় ১০ শতাংশ হ্রাস পেলেও তার বিপরীতে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধি না পাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার ছাড়া অব্যাহত রাখতে হয়। এতে রিজার্ভ এর পতন অব্যাহত থাকে। এছাড়াও রিজার্ভ সংকটের পেছনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দুর্নীতি, লুটপাট, অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা, অভ্যন্তরীণ ও প্রশাসনিক দুর্বলতা ও অর্থপাচারের মতো ঘটনাও জড়িত বলে অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন। বাংলাদেশ মূলত কয়েকটি উৎস থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে থাকে। এগুলো হলো যথাক্রমে রপ্তানি, রেমিট্যান্স, বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আয় আছে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স থেকে। এ দুইটি উৎস হলো বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস। রপ্তানি উন্নয়ন বু্যরোর (ইপিবির) তথ্যমতে, বাংলাদেশে ইতিহাসে সর্বোচ্চ রপ্তানি আয় এসেছে ২০২২-২৩ অর্থবছরে। যার পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল প্রায় ৫ হাজার ৫৫৬ কোটি মার্কিন ডলার। যা ২০২১-২২ অর্থবছরের চেয়ে ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি ছিল। আবার এরপূর্বে ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২০২০-২১ অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। কিন্তু বিপরীতে আমদানির পরিমাণ বেশি থাকায় প্রতি বছরই বড় ধরনের বাণিজ্য ঘাটতির মুখে পড়তে হয় বাংলাদেশকে। রপ্তানি ও বাণিজ্যের মধ্যে যে ব্যবধান তা রেমিট্যান্স দিয়ে পূরণ করা হয় এবং উদ্বৃত্ত অংশ দিয়ে রিজার্ভ বৃদ্ধি করা হয়। অর্থাৎ রিজার্ভ বৃদ্ধির প্রধান উৎস হলো প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। কিন্তু ২০২০-২১ অর্থবছরে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এলেও ২০২১-২২ অর্থবছরে তা হ্রাস পায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে যেখানে রেমিট্যান্স এসেছিল প্রায় ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, সেখানে ২০২১-২২ অর্থবছরে তা কমে ২১ দশমিক ০৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়ায়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে কিছুটা তথা ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে তা দাঁড়ায় ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। অর্থাৎ যে রেমিট্যান্স আসছে তা দিয়ে বাণিজ্য ঘাটতি পূরণ এবং রিজার্ভ বৃদ্ধি সম্ভব নয়। বরং সংকট দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হচ্ছে। সর্বোপরি, বর্তমানে রিজার্ভ এর যে আবস্থা তা আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য শঙ্কার। ইতোমধ্যে রিজার্ভ হ্রাস ও ডলার সংকট আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব পেলেছে। অর্থাৎ রিজার্ভের সংকট মানে আমাদের অর্থনীতির প্রতিটি সূচকে অস্থিরতা বিরাজ করা। এর প্রভাব পড়ে সাধারণ জনগণের ওপর। রিজার্ভ বৃদ্ধির জন্য আমাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এর মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান দুইটি উৎসকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এক, রপ্তানি আয়। রপ্তানি আয় বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস। রপ্তানি আয় বৃদ্ধিতে চারটি কাজ করতে হবে। এগুলো হলো যথাক্রমে- পণ্য বহুমুখীকরণ, বাজার বহুমুখীকরণ, প্রযুক্তি বহুমুখীকরণ ও বিনিয়োগ বহুমুখীকরণের দিকে নজর দিতে হবে। পণ্য বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে সবার আগে পোশাক খাতের বাহিরে থাকা পাট, চামড়া, সিরামিক ইত্যাদি খাতকে গুরুত্ব দিতে হবে। একইসঙ্গে রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য ইউরোপের বাহিরের দেশগুলোর দিকে নজর দিতে হবে। যেমন চীন, জাপান, রাশিয়া, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, ভারত- এসব দেশে রপ্তানি বাড়াতে হবে। আর তার জন্য প্রয়োজন এসব দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি করা। \হএছাড়াও বিদেশি ক্রেতা ও ব্র্যান্ডের কাছে বাংলাদেশি পণ্য পৌঁছানোর জন্য প্রযুক্তি বহুমুখীকরণের দিকে নজর বাড়াতে হবে। দুই, প্রবাসী আয় তথা রেমিট্যান্স। রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় বৃদ্ধিতেও নিম্নলিখিত কাজগুলো করতে হবে। এগলো হলো যথাক্রমে- রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ কমানো, বিদেশে কর্মরত ব্যাংকের শাখা ও এক্সচেঞ্জ হাউসগুলোকে রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে দক্ষ করে তোলা, প্রবাসীরা যেসব দেশে কর্মরত, সেসব দেশের স্থানীয় ব্যাংকগুলোর সঙ্গে এ দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ড্রয়িং ব্যবস্থা জোরদার করা, প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোয় উদ্বুদ্ধ করা এবং একইসঙ্গে হুন্ডির মাধ্যমে অবৈধভাবে রেমিট্যান্স আসা বন্ধ করা। এছাড়াও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ বহুমুখীকরণের দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। বিনিয়োগ বহুমুখীকরণের জন্য দরকার দেশীয় বিনিয়োগের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগ উৎসাহিত করা। পাশাপাশি আমরা যেসব পণ্য আমদানি করে থাকি তা আমাদের নিজস্ব উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে আমাদের আমদানি খরচ কমে আসতে পারে। সর্বোপরি, সংকট কাটাতে ও রিজার্ভ বৃদ্ধির জন্য এ মুহূর্তে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও গ্রহণ করতে হবে। শহীদুল ইসলাম : নবীন কলাম লেখক