প্রয়োজন দৃঢ়চেতা স্বচ্ছ ও দুনীির্তমুক্ত নেতৃত্ব

আমাদের দুভার্গ্য, এ দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দৃঢ়চেতা নয়, অস্বচ্ছ ও দ্বিধাবিভক্ত। এক দল উত্তরে হঁাটে তো অন্য দল দক্ষিণে। এক দল হ্যঁা বললে অন্য দল না বলে। এক দলের ভালো কাজ ও উদ্যোগকে অন্য দল স্বীকৃতি দিতে চায় না। নিন্দা কুৎসা, আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ, ব্যক্তি, জাত ও গোষ্ঠী তুলে বকাবাজিÑ এসবই আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অনিবাযর্ অংশ হয়ে উঠেছে। তাতে বোঝা যায়, গণতান্ত্রিক শিষ্টাচার ও সহমমির্তা প্রকাশের ক্ষেত্রে আমরা কত পিছিয়ে আছি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে উদারভাবে গ্রহণ করার ক্ষমতা আমাদের নেই। তাদের বন্ধু সমালোচক না ভেবে সবর্ক্ষণ শত্রæ ভাবা হয়, মূল্যায়নও করা হয় সেভাবেই। এসব কারণেই দেশের উন্নতি হয়েছে, তবে পুরোপুরি হয়নি।

প্রকাশ | ১৮ জুলাই ২০১৮, ০০:০০

সালাম সালেহ উদদীন
বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে গৌরবজনক একটি দেশ। এ গৌরবের অংশীদার প্রধানত এ দেশের খেটে খাওয়া জনগণ এবং সরকার। যদিও পুরো কৃতিত্ব সরকার নিতে চায়। কৃতিত্ব নেয়া দোষের কিছু নয়, যদি তা সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। এ দেশের মানুষ পরিশ্রমী তবে বুদ্ধিমত্তা ও কৌশল অবলম্বন করে পরিশ্রম করতে পারে না। যার কারণে গাধার খাটুনি খেটেও উপযুক্ত পারিশ্রমিক বা ফল থেকে বঞ্চিত থাকে। দেশের অভ্যন্তরে যারা কাজ করেন দেশের উন্নয়নের জন্য, তাদের বিপুল অংশ শোষিত হয় মালিক শ্রেণির হাতে। এভাবে যারা বিদেশে কমর্রত তারাও নিরুপায় হয়ে গতর খাটেন এবং উপযুক্ত পারিশ্রমিক পান না। তারা আবার দালালদের মাধ্যমে প্রতারণা ও ভয়াবহ নিযার্তনের শিকার হন। কেউ কেউ জেলও খাটেন। এ ছাড়াও দেশের নানান উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গেলে ব্যয়ের বড় অংশ অথর্বরাদ্দ লুটপাটের কবলে পড়ে। ফলে উন্নয়ন ব্যাহত হয়। নানা সঙ্কট ও সীমাবদ্ধতার মাঝে সাড়ে চার দশকে বাংলাদেশ আপন গতিতে এগিয়ে চলছে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে। বাংলাদেশের এই উজ্জ্বল অভিযাত্রা আমাদের আশাবাদী করে তোলে। ’৭২ সালের যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ আর ২০১৮ সালের বাংলাদেশ এক নয়। তৎকালীন মাকির্ন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলেছিলেন আর এখন বাংলাদেশকে বলা হচ্ছে ‘এশিয়ার বাঘ’। বাংলাদেশের মানুষের রক্তে মিশে আছে গণতন্ত্র ও সংগ্রাম। বাংলাদেশ অপার সম্ভাবনার দেশ। তলাবিহীন ঝুড়ির অভিযোগ এখন সাফল্যে পরিণত হয়েছে। যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল বাংলাদেশকে পরাজিত করার জন্য তারাই আজ বাংলাদেশের প্রশংসা করছে। সমস্যা আর সংকটের পাহাড় ঠেলে ঠেলে সামনের দিকে এগোচ্ছে বাংলাদেশ। এটা আমাদের জন্য বড় অজর্ন। আমরা পরিশ্রমী আত্মবিশ্বাসী বলেই এগোতে পারছি। যে জাতি ভাষার জন্য রাজপথে রক্ত দিয়েছে, যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেÑ তাদের তো কোনোভাবেই পিছিয়ে থাকার কথা নয়। বাঙালি ইতিমধ্যে নানা দিকে সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে। বাংলার কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে মাঠে ফসল ফলিয়ে ষোল কোটি মানুষের অন্নের জোগান দিচ্ছে। অথচ তারা ফসলের, শাকসবজির ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না। তার পরও তারা দেশের কৃষি অথর্নীতির প্রধান চালিকাশক্তি। এ দেশের শ্রমিকশ্রেণি দেশের অভ্যন্তরে যেমন বিভিন্ন গামেের্ন্ট ও শিল্প কারখানায় কাজ করে দেশের উন্নয়নে বিশেষ ভ‚মিকা রাখছে। একইভাবে এদের উল্লেখযোগ্য অংশ প্রবাসে কমর্রত থাকায় রেমিট্যান্স প্রবাহ অনেক বেড়েছে। বেড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজাভর্ও। তাহলে সহজেই বোঝা যাচ্ছে এ দেশের কৃষক ও শ্রমিক হচ্ছে উন্নয়নের প্রাণশক্তি প্রাণভোমরা। অথচ এরা নানাভাবে অবহেলিত, শোষিত ও বঞ্চিত হয়Ñ যা উন্নয়নের ইতিবাচক ধারাকে ব্যাহত করে। মনে রাখতে হবে সামষ্টিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ বা প্রয়াস। একইভাবে প্রয়োজন জাতীয় ঐকমত্য। আমাদের দুভার্গ্য যে ওই সংস্কৃতি আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। এটা আমাদের জাতীয় ব্যথর্তা। এ অনৈক্যের মধ্যেও আমাদের দামাল ছেলেরা ক্রীড়া ক্ষেত্রে সাফল্য দেখিয়েছে, আমাদের তরুণ-তরুণীরা এভারেস্ট জয় করেছে, বতর্মান সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় পোলিওমুক্ত বাংলা হয়েছে, শিশু ও মাতৃ মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে, বিপুল চাহিদার মধ্যে বিদ্যুৎ ঘাটতি অনেক কমেছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে। শিক্ষা ক্ষেত্রে সাফল্য এসেছে। আমরা প্রথমে মিয়ানমার এবং পরে ভারতের কাছ থেকে সমুদ্র জয় করেছি। আমাদের সেনাবাহিনী ও পুলিশ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে গিয়ে সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলাদেশ এখন অনেক এগিয়ে। দেশের প্রায় তিন কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। আধুনিক ব্যাংক ব্যবস্থাপনা ও করপোরেট হাউসগুলো পুরোপুরিই তথ্যপ্রযুক্তির ওপর নিভর্রশীল। বোনম্যারো প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সাফল্য দেখিয়েছে। পাট ও মহিষের জন্মরহস্য আবিষ্কৃত হয়েছে। এভাবে ধীরে ধীরে বাংলাদেশ তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পেঁৗছাতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে আমরা উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পেঁৗছেছি। এসব দেখেবুঝেই হয়তো বতর্মান সরকার বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছে। এ ঘোষণা বাস্তবায়ন কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর একটি বিপজ্জনক প্রবণতা হচ্ছে তারা একে-অন্যকে তথ্য ও যুক্তি দিয়ে ঘায়েল করার পরিবতের্ হানাহানি, সংঘাত, রক্তপাতে লিপ্ত হয়। এর প্রধান কারণ কে কাকে ল্যাং মেরে ক্ষমতায় যাবে অথবা ক্ষমতায় টিকে থাকবে এ চেষ্টায়ই তারা অবিরত লিপ্ত থাকে। হরতাল, অবরোধ, নাশকতার মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে চাওয়া মানে বঁাকা পথ অবলম্বন করা। আগামী জাতীয় নিবার্চনকে সামনে রেখে সেই ধরনের নীল নকশা অঁাকা হচ্ছে। তবে এ পথ গণতন্ত্রের নয়। গণবিরোধী বলপ্রয়োগের রাজনীতি কখনো সুফল বয়ে আনে না। এর ফলে দেশ পিছিয়ে যায়, দেশের অথর্নীতি পঙ্গু হয়ে পড়ে। দেশের রাজনৈতিক দলগুলো যদি সংকীণর্তার ঊধ্বের্ উঠে জনকল্যাণমূলক রাজনীতি করত, গণতান্ত্রিক রীতিপদ্ধতি মেলে চলত তাহলে দেশ আরও এগিয়ে যেত। একশ্রেণির মানুষ দেশ নিয়ে হতাশ হতো না। এ কথাও স্মরণে রাখতে হবে দেশের উন্নয়ন অগ্রগতির সঙ্গে জনগণের ভাগ্যও জড়িত। জনগণ কেবল খেটে মরবে, তাদের ভাগ্যের পরিবতর্ন হবে না এ কেমন কথা। দেশের অধিকাংশ মানুষ এখনো দারিদ্র্যকবলিত। মাত্র কয়েক লাখ মানুষের হাতে অথর্-সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে আছে। আর এসব তারা সৎপথে অজর্ন করেনি। এদের বেশির ভাগই জনগণের টাকা আত্মসাৎ করেছে চুরি-দুনীির্ত আর লুটপাটের মাধ্যমে। যার কারণে সমাজ ও রাষ্ট্রে অথৈর্নতিক বৈষম্য পাহাড়সমান। এ সমাজে ধনী আরো ধনী হচ্ছে, আর গরিব হচ্ছে আরো গরিব। সমাজের একশ্রেণি ঠিকমতো আহার-পোশাক, বাসস্থান ও সন্তানের লেখাপড়ার খরচ জোগাড় করতে পারে না, অন্য শ্রেণির কাছে এসব তুচ্ছ ও মামুলি ব্যাপার। এই আকাশ-জমিন অথৈর্নতিক বৈষম্যও উন্নয়নের অন্তরায়। এ অন্তরায় দূর করা সহজ কাজ নয়। জনগণের মাঝ থেকে যদি অথৈর্নতিক ও সম্পদের বৈষম্য দূর করা যেত, দূর করা যেত দুনীির্ত ও গোষ্ঠীপ্রীতি বা স্বজনপ্রীতি তাহলে হয়তো বা বাংলাদেশ আরো এগিয়ে যেত। অথৈর্নতিকভাবে যেসব দেশ শক্তিশালী ওইসব দেশ বিশ্বের মধ্যে প্রভাবশালীও। অন্যভাবে গণতান্ত্রিকভাবে যেসব দেশ প্রতিষ্ঠিত ওইসব দেশও মেরুদÐ সোজা করে সচল রয়েছে। এ কথার সারবত্তা হচ্ছে, শক্তিশালী অথর্নীতি ও সুষ্ঠু গণতন্ত্রচচার্ই পারে দেশকে এগিয়ে নিতে। সে জন্য হিংসা-বিভেদ, হানাহানি ভুলে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে নিতে হবে বলিষ্ঠ ভ‚মিকা। বাংলাদেশ সুস্থ ও স্বাভাবিক ধারায় চলতে না পারার শত কারণ রয়েছে। অন্যতম প্রধান কারণ দেশের একশ্রেণির মানুষের সীমাহীন লোভ, অসততা ও উচ্চাভিলাষ। তারা সাধারণ মানুষকে জিম্মি ও মৃত্যুর মুখোমুখি দঁাড় করিয়ে রাতারাতি বিল গেটসের মতো বিত্তশালী হতে চায়। এরা কেবল মানুষেরই শত্রæ নয়, দেশেরও শত্রæ। আমাদের দুভার্গ্য, এ দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দৃঢ়চেতা নয়, অস্বচ্ছ ও দ্বিধাবিভক্ত। এক দল উত্তরে হঁাটে তো অন্য দল দক্ষিণে। এক দল হ্যঁা বললে অন্য দল না বলে। এক দলের ভালো কাজ ও উদ্যোগকে অন্য দল স্বীকৃতি দিতে চায় না। নিন্দা কুৎসা, আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ, ব্যক্তি, জাত ও গোষ্ঠী তুলে বকাবাজিÑ এসবই আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অনিবাযর্ অংশ হয়ে উঠেছে। তাতে বোঝা যায়, গণতান্ত্রিক শিষ্টাচার ও সহমমির্তা প্রকাশের ক্ষেত্রে আমরা কত পিছিয়ে আছি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে উদারভাবে গ্রহণ করার ক্ষমতা আমাদের নেই। তাদের বন্ধু সমালোচক না ভেবে সবর্ক্ষণ শত্রæ ভাবা হয়, মূল্যায়নও করা হয় সেভাবেই। এসব কারণেই দেশের উন্নতি হয়েছে, তবে পুরোপুরি হয়নি। প্রশ্ন উঠতে পারে, এর থেকে মুক্তির উপায় কী। পরিস্থিতি এমন এক পযাের্য় চলে গেছে যে কোনো সরকার বা রাজনৈতিক দল চাইলেই এ ভয়াবহ চিত্র পাল্টানো সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও দীঘের্ময়াদি পরিকল্পনা। আর তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন সৎ, যোগ্য নেতৃত্ব। দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব কলুষিত ও বিতকির্ত। তাদের চরিত্রের বদল এবং মানসিকতার পরিবতর্ন না হলে সমাজকে সুস্থ ও সুষ্ঠু ধারায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। দেশের পুরোপুরি উন্নয়ন চাইলে, দেশকে পূণর্মাত্রায় গণতান্ত্রিক ধারায় প্রতিষ্ঠিত করতে হলে রাজনৈতিক সমঝোতা ও ঐকমত্য যেমন প্রয়োজন, তেমনি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে প্রয়োজন সরকারের কঠোর ও কাযর্কর পদক্ষেপ। যারা এসব কাজে যুক্ত থাকবেন তাদের হতে হবে দৃঢ়চেতা স্বচ্ছ ও দুনীির্তমুক্ত। বাংলাদেশের জন্য প্রতিক‚ল পরিবেশ জাতীয় ও আন্তজাির্তকভাবে থাকবেই। থাকবে দেশ নিয়ে নানা অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্র। এর মধ্যেই প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন করে নিভের্য় সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। জয় আমাদের হবেই। সালাম সালেহ উদদীন: কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক