কেন বেঁচে থাকা জরুরি?
মানুষকে বাঁচতে হবে তার পরিবারের কথা ভেবে। বাঁচতে হবে হুইলচেয়ারে বসে বাসায় চলাফেরা করা বাবার কথা ভেবে। বাঁচতে হবে বোনের পড়াশোনার খরচ চালানোর একমাত্র ভাই হিসেবে। বাঁচতে হবে বাবা-মায়ের মুখে সুন্দর হাসি ফোটানোর জন্য। বাঁচতে হবে পৃথিবীর রূপ রস গন্ধ সৌন্দর্য উপভোগ জন্য।
প্রকাশ | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০
সাইদুল হাসান
মানুষ বেঁচে থাকার স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে উঠে। চারপাশের সবুজ শ্যামল, লতাপাতায় ঘেরা পরিবেশে নিজেকে হারিয়ে ফেলে প্রকৃতির অপার মুগ্ধতায়। চোখ ধাঁধানো মায়াবী চাঁদ, খসে পড়া তারা, অবিরাম বয়ে চলা সাগর-নদী, পাহাড়ের বুক ছুঁয়ে গড়িয়ে পড়া জল, বৃষ্টিময় রাতে টিনের চালের ঝনঝনানি শব্দ, হলুদ শাড়ি পরা সরিষা ফুল, পদ্মবিলে ফোটা শাপলা, ঘরের কোণে চিকচিক করে শব্দ করা চড়ুই আমাদের বাঁচার জন্য যেন প্রতিনিয়ত নিজেদের অকাতরে বিলিয়ে দেয়। মানুষের চোখে ভর করে স্বপ্ন ও ঘুম। স্বপ্নের পথ ধরে মানুষ বিরামহীন ছুটে চলে দু'চোখে টনটন করা ঘুম তাড়িয়ে। ঘুম পিছুটানে- তবে মানুষ থামে না, অবিরত হাঁটছে তো হাঁটছেই। কেননা, অদূরে তাকে হাত বাড়িয়ে ডাকে সফলতার চাদর।
মানুষ কেন মরে? কেন নিজেকে গুটিয়ে নেয় এই সুন্দর পৃথিবীর মায়া থেকে। কেন চোখের জলে ভেজা ফুটফুটে সুন্দর গাল তার মায়ের চুমুর কথা স্মরিয়ে দেয়? কেন-ই বা স্কুল পালিয়ে মেলায় যাওয়া, খেলতে যাওয়াকে কেন্দ্র করে নরম গালে বাবার চড় বসানো দিনগুলো স্মৃতিতে ভেসে উঠে? কেন বোনের সঙ্গে খেলনা নিয়ে ঝগড়া করে অভিমান করে চকোলেট গিফট্ পাওয়ার কথাটাই বারবার মনে পড়ে! কেন খেলার মাঠে পায়ে ব্যথা পাওয়ার সেই দিনে খেলার সাথীরা কোলে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ভালোবাসার স্মৃতি আমাকে পিছুটেনে ধরে? কেন নানুর পকেট থেকে পাঁচ টাকার কয়েন চুরি করে মজা চানাচুর খাওয়ার সেসব দিন দু'চোখে ভেসে উঠে? কেন একসঙ্গে, একই রুমে, একই ডিপার্টমেন্টে থাকা বন্ধুটার কথা মগজে হানা দেয় জোরালো ভাবে? আমি এসব ভেবেও কীভাবে দেহটা ঝুলিয়ে দেই রশ্মির পঁ্যাচে? কীভাবে ঠেলে দেই পিচঢালা পথে? কেন-ই বা রেললাইনের পাতে বিছিয়ে দেই নরম দেহ? কেন নিজেকে শেষ করাতে মুক্তির পথ খুঁজি!
মানুষ যখন তার দেহটা উৎসর্গ করে দেয় প্রকৃতির সোপর্দে তখন সে ভাবে পৃথিবী নামক গোলকধাঁধা কিংবা হতাশার আবদ্ধ ঘর থেকে নিজেকে রেহাই দিল। ভাবে যেন তার মুক্তি চাই। এ দেহ থেকে রুহটা মুক্তি চায়। সে কোথাও খুঁজে পায় না এক পরশ সুখ, শান্তি এবং ভালোবাসা। এক পশলা বৃষ্টি তার হৃদয়ে সুখের সঞ্চার না করে উল্টো চোখের জল কেড়ে নেয়। কেড়ে নেয় তার ঘুম কিংবা মানসিক বিশ্রাম। সে কোথাও খুঁজে পায় না সুখ। কোথাও পায় না তার জীবন সমস্যার সমাধান। যেখানেই যায় যেন লাঞ্ছনার শিকার। পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় অবহেলার পাথর যেন তাকে চেপে ধরে। কথার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে দেয় হৃদয়। সে যেদিকেই তাকায় যেন প্রকৃতি তাকে রুহত্যাগে উৎসাহিত করে। তবে এসব সে কখনোই সুস্থ মাথায় ভাবে না।
মানুষ বাঁচবে কেন কিংবা কেন বেঁচে থাকা উচিত? এ প্রশ্নের বহু ধরনের জবাব আসতে পারে বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে। মানুষ মূলত তার লালিত স্বপ্ন পূরণে বাঁচতে চায়। তার ছোট্ট এই জীবনটাকে ঘিরে তার অজস্র স্বপ্নের দল তার মাথায় আন্দোলন করে। সে স্টেপ বাই স্টেপ সে স্বপ্ন পূরণে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কখনো স্বপ্নের চাবি হাতে ধরিয়ে চিরতরে হারিয়ে যায় বাবা-মা। তবু স্বপ্ন থেকে থাকে না। সে ভিন্ন পন্থা অবলম্বনে বেশ পারদর্শী বাড়তে থাকে। সে তার স্বপ্ন এবং বাবা-মাকে জীবনের চেয়ে অধিক ভালোবাসে। শত বাধা অতিক্রম করে, প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে, এগিয়ে যায় জীবনের এই মহাসাগরে। যতই ঝড়-ঝঞ্ঝা আসুক মানুষ নদীতে ছোট্ট নায়ে বসে ওপাড়ে যাওয়ার জন্য তড়িঘড়ি করে। সে যে কোনো পরিস্থতিতে ভেঙে পড়ে না। নিজের ওপর তার বিশ্বাস অটল। সে পারবে এমন দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় নিজেকে সচল রাখে রোজ।
মানুষ তার ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবে। সেখানে যদি বাধা পায় তখনই হতাশ হয়ে পড়ে। একাডেমিক জীবনে জিপিএ, সিজিপিএ একটু খারাপ হলে হতাশ। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ভালো একটা সাবজেক্ট না পেলেই হতাশ। পড়াশোনা শেষে চাকরি পেছনে দৌঁড়ানোর পর চাকরি পেতে ব্যর্থ হলে হতাশ। তখন বাবা-মা বাসা থেকে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেয় তা নিয়ে হতাশ। একটা মেয়ের সঙ্গে দীর্ঘদিন রিলেশনশিপ থাকার পর ব্রেকাপ হলে হতাশ। ভালো একটা চাকরি পাওয়ার পর ভালো, সুন্দরী একটা মেয়ে বিয়ে করা নিয়ে চিন্তিত। সে মেয়ে যদি পরকীয়া কিংবা অন্যত্র রিলেশনশিপে থাকে তা জানার পর হতাশ। বিয়ের পর ছেলেমেয়ে হয় না তা নিয়ে হতাশ। অফিসের বসের সঙ্গে ফাইল নিয়ে কথাবার্তায় মেজাজ বিগড়ে যায় তারপর ভর করে হতাশা। গ্রামের বাড়ি জায়গাজমি নিয়ে চাচার সঙ্গে বাগবিতন্ডা নিয়ে চরম হতাশ। বাবা-মায়ের সঙ্গে স্ত্রীর ভালো সম্পর্ক নেই, ঝগড়াঝাটি লেগে থাকে তা নিয়ে হতাশ। মেয়েদের ক্ষেত্রেও সেইম ঘটে। চারপাশে যেন হতাশার ছায়া পড়ে তার হৃদয়ে। সে কোনোক্রমেই বেরিয়ে আসতে পারে না মায়াজাল থেকে।
মানুষকে বাঁচতে হবে তার পরিবারের কথা ভেবে। বাঁচতে হবে হুইলচেয়ারে বসে বাসায় চলাফেরা করা বাবার কথা ভেবে। বাঁচতে হবে বোনের পড়াশোনার খরচ চালানোর একমাত্র ভাই হিসেবে। বাঁচতে হবে বাবা-মায়ের মুখে সুন্দর হাসি ফোটানোর জন্য। বাঁচতে হবে পৃথিবীর রূপ রস গন্ধ সৌন্দর্য উপভোগ জন্য।
বাঁচতে হবে মায়ের চিকিৎসার খরচ চালানোর একমাত্র উপায় হয়ে। বাঁচতে হবে একজনের সুখে নিজেকে হাসিখুশি রাখার মাধ্যমে। বাঁচতে হবে নিজেকে অন্যের সঙ্গে তুলনা না করে নিজের সঙ্গেই তুলনা করে। বাঁচতে হবে একটি সুন্দর, সুশীল ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ও দেশ উপহার দিতে। মোটকথা, বাঁচতে হবে পরিবেশ, প্রকৃতি ও নিজের জন্য।
আমি কেন মরব? আমার এত কিসের হতাশা? কত মানুষ শুধু পৃথিবীর সৌন্দর্য দেখে জীবনটা পার করে দিয়েছে কোনো দিন কথা বলার সামর্থ হয়নি। কত মানুষ শুনে গিয়েছে, বলে গিয়েছে পৃথিবীর রীতিনীতি তবে দেখার সুযোগ হয়নি। কেউবা হুইলচেয়ারে ভর করে রোজ সকালে অফিসে ছুটে চলে। কেউ তো দুটো হাত ছাড়ায় হাসিমুখে জীবন কাটায়। কতটা কষ্টে সে জীবনযাপন করছে? ফুটপাত কিংবা রেলওয়ে স্টেশনের পাশে অর্ধনগ্ন, জট পাকানো, ছেঁড়া জামা গায়ে জড়ানো ছোট্ট মেয়েটির হাসি দেখেছেন কতটা মিষ্টি? তার পেটে দানা নেই তবে মুখে নেই দুঃখের ভাব। আপনি কোন স্টেজে এসে নিজের ওপর হতাশ? আপনি জানেন না, মানুষ কেন বাঁচতে হবে? কেন নিজেকে একজন ত্যাগী মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে? মানুষের সুখ দেখে আনন্দ করা, ভালোবাসা ছড়ানো, স্বপ্ন পূরণে অবিচল থাকা, বাবা-মায়ের সঙ্গে চমৎকার মুহূর্ত কাটানো, প্রিয়তমার সঙ্গে একটি সুন্দর গোধূলি বিকাল কিংবা জোছনা রাত উপভোগ, গরিব-দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়ানো, সাধ্যমত নিজেকে তাদের তরে বিলিয়ে দেওয়া, নিজের জ্ঞানকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া এবং একজন সৎ মানুষ ও নির্ভীক দেশপ্রেমিক হওয়ার জন্য বেঁচে থাকা উচিত। হতাশা আসবেই তবে তা ঠান্ডা মাথায় মোকাবিলা করতে হবে। মানুষের সঙ্গে, রবের সঙ্গে নিজের ভালো সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে যেন হতাশার সময় মহান সৃষ্টিকর্তা আপনার পাশে থাকে। সৃষ্টিকর্তার ওপর ভরসা রাখলে সে কখনই হতাশ হতে পারে না। মহান সৃষ্টিকর্তা পবিত্র কোরআনে বলেছেন- তোমরা কখনই আমার রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। সূরা আয-যুমার (আয়াত নং-৫৩) যেখানে স্রষ্টা আপনাকে ভরসা দেয় সেখানে কেন আপনি হতাশায় গ্রাসিত হয়ে নিজেকে প্রকৃতির হাতে সোপর্দ করবেন? মনে রাখা খুবই দরকার, আপনি মানুষ। আপনি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ট জাতি। আপনার বিবেক বুদ্ধি তো প্রবল। তাহলে কেন এই আত্মহত্যা?
সাইদুল হাসান :নবীন কলাম লেখক