সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবের জীবনাদর্শ
আসলে তার জীবন ও কর্মই তাকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবের স্বীকৃতি দিয়েছে।
প্রকাশ | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০
মো. জিলস্নুর রহমান
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব বিশ্বনবী হজরত মুহম্মদ (সা.)। তিনি ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল আরবের মক্কায় মা আমিনার কোল আলো করে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের পূর্বেই তিনি পিতা আবদুলস্নাহ এবং মাত্র ছয় বছর বয়সে মা'কে হারান। তিনি খুব ছোট সময় থেকেই আলআমীন বা সত্যবাদী বলে সবার কাছে স্বীকৃত হন। এ কারণে তিনি খুব অল্প বয়সে কাবা ঘর পুনর্নির্মাণের সময় হাজরে আসওয়াদ (পবিত্র কালো পাথর) স্থাপন করে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। তিনি নবীদের সর্দার, কিয়ামত পর্যন্ত আগত সব মানুষ ও জিনের জন্য শ্রেষ্ঠনবী এবং তিনিই সর্বশেষ নবী। তার পরে আর কোনো নবী আসবেন না। তার সম্মান ও মর্যাদার সাক্ষ্য পবিত্র কোরআনসহ সব আসমানি গ্রন্থে বর্ণনা করা হয়েছে। মহান আলস্নাহ তাকে সৃষ্টিজগতের জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছেন। তার সময়ে আরব জাহান ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। তারা আলস্নাহকে ভুলে গিয়ে নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ে। সর্বত্র দেখা দিয়েছিল অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা। তারা মারামারি আর হানাহানিতে লিপ্ত ছিল এবং মূর্তিপূজা করত। এ যুগকে বলা হয় 'আইয়ামে জাহেলিয়াত'। এ থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে, তাদের আলোর পথ দেখাতে মহান আলস্নাহ মুহম্মদ (সা.)-কে এ পৃথিবীতে পাঠান।
মহানবী হজরত মুহম্মদ (সা.) সব মুসলমানদের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় মানুষ। বিশ্বের সর্বকালের সেরা মহামানব হিসেবে মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে প্রশ্নাতীতভাবে স্বীকৃত। ইন্টারনেট জায়ান্ট 'গুগল' ডটকমেরর্ যাঙ্কিংয়েও বিশ্বসেরা মানুষ হিসেবে তালিকায় প্রথম স্থানেই তার নাম রয়েছে। গুগলে নবংঃ সধহ, নবংঃ যঁসধহ, নবংঃ যঁসধহ রহ :যব ড়িৎষফ, 'যিড় রং :যব নবংঃ সধহ রহ :যব ড়িৎষফ- ইত্যাদি লিখে সার্চ করলে প্রথমেই চলে আসে হজরত মুহম্মদ (সা.)-এর নাম। বিখ্যাত লেখক মাইকেল হার্টসের লেখা 'বিশ্ব সেরা ১০০ মনীষী' গ্রন্থে প্রথম স্থানেই রয়েছে হজরত মুহম্মদ (সা.)-এর নাম। ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত ওই বইটি তখন বিভিন্ন মহলে ব্যাপক হইচই ফেলে দেয়। তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় কান্ডারী। তার এই বিশেষত্বের অন্যতম কারণ হচ্ছে আধ্যাত্মিক ও জাগতিক উভয় জগতেই চূড়ান্ত সফলতা অর্জন। তিনি ধর্মীয় জীবনে যেমন সফল তেমনই রাজনৈতিক জীবনেও। সমগ্র আরব বিশ্বের জাগরণের পথিকৃৎ হিসেবে তিনি অগ্রগণ্য; বিবাদমান আরব জাতিকে একীভূতকরণ তার জীবনের অন্যতম সফলতা।
তরুণ বয়সেই হজরত মুহম্মদ (সা.) সত্য ও সুন্দর সমাজ গঠনের লক্ষ্যে শান্তিকামী যুবকদের নিয়ে 'হিলফুল ফুযুল' অর্থাৎ শান্তিসংঘ গঠন করে আরব সমাজে হইচই ফেলে দেন। হিলফুল ফুযুলের উদ্দেশ্য ছিল, আর্তমানবতার সেবা করা, অত্যাচারীকে প্রতিরোধ করা, শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা, গোত্রে গোত্রে সম্প্রীতি বজায় রাখা ই্যাদি। কোরআনে তাকে 'রাহমাতুল লিল আ'লামীন' বা জগতবাসীর জন্য 'রহমত' বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ইসলামের আগে আরব সমাজে নারীর মর্যাদাপূর্ণ কোনো অবস্থান ছিল না। তাদের গণ্য করা হতো ভোগের বস্তু হিসেবে। নারী ছিল রাতের কবিতার আসর আর মদের আড্ডার বিশেষ অনুষঙ্গ। জীবন ও সমাজে তাদের বড় জোর স্বামী বা মনিবের মরোঞ্জনের উপকরণের বেশি কিছু মনে করা হতো না। নারীকে পরিবার, সমাজ ও বংশের জন্য অসম্মান ও অভিশাপ মনে করা হতো। এমনকি সামাজিক লজ্জার ভয়ে নারীকে জীবন্ত কবর দেয়া হতো। পবিত্র কোরআনে পুরুষদের সঙ্গে নারীদেরও সম্পত্তির উত্তরাধিকার নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। একইভাবে মায়েদের, স্ত্রীদের, কন্যাদের, স্বামীদের সম্পত্তির এবং বিশেষ অবস্থায় বোনদের-ভাইদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার সাব্যস্ত করা হয়েছে।
সব নবীই কায়িক পরিশ্রম করে জীবিকা উপার্জন করেছেন। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহম্মদ (সা.) মা খাদিজা (রা.)-এর কোম্পানিতে দীর্ঘকাল সততা, বিশ্বস্ততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে চাকরি করেছেন। তিনি ভিক্ষাবৃত্তিকে চরমভাবে নিরুৎসাহিত করেছেন। বেতন ও পারিশ্রমিক কর্মজীবীর ন্যায্য অধিকার। ইসলাম দ্রম্নততম সময়ে তা আদায়ের নির্দেশ দিয়েছে। রাসূল (সা.) বলেছেন, ঘাম শুকানোর আগেই শ্রমিকের পারিশ্রমিক দিয়ে দাও। অন্য হাদিসে পারিশ্রমিক ও প্রাপ্য অধিকার নিয়ে টালবাহানাকে অবিচার আখ্যায়িত করা হয়েছে। মহানবী (সা.) বলেন, ধনী ব্যক্তির টালবাহানা অবিচার অর্থাৎ সামর্থ্য থাকার পরও মানুষের প্রাপ্য ও অধিকার প্রদানে টালবাহানা করা অন্যায়। আর ঠুনকো অজুহাতে বেতন-ভাতা ও প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা ভয়ংকর অপরাধ।
যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বর্ণবৈষম্য দূরীকরণে আন্দোলন হয়েছে। আইন হয়েছে, নানা নীতিমালা ও বিভিন্ন কমিশন হয়েছে। কিন্তু কোনোক্রমেই এই সাদা কালোর বৈষম্য ও ভেদাভেদ থামছে না। অথচ ইসলামে কোনো বর্ণবৈষম্য নেই। ইসলাম বর্ণবাদ বা বর্ণবৈষম্যকে কোনোভাবেই সমর্থন করে না। বর্ণবাদকে নির্মূল করে আদর্শ রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার অনন্য এক উদাহরণ প্রতিষ্ঠিত করেছেন মানবতার মুক্তির দূত নবী মুহম্মদ (সা.)। তাই তো আমরা হাবশী কৃতদাস হজরত বিলালকে (রা.) ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিনরূপে দেখতে পাই। পবিত্র কোরআনের অসংখ্য আয়াতে এবং হজরত রাসুলুলস্নাহ (সা.) অনেক হাদিসে বর্ণবাদিতাকে চরমভাবে নিষেধ করা হয়েছে। এমনকি হজরত রাসুলুলস্নাহ (সা.) বিদায় হজের ভাষণে বলেছেন, হে লোক সব, তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আলস্নাহর কাছে অধিকতর সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী, যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়া অবলম্বন করে, সব বিষয়ে আলস্নাহর কথা অধিক খেয়াল রাখে। ধর্ম বিশ্বাস, গোত্রবর্ণ, শক্তি ও বংশের অহংকারবশত কোনো ব্যক্তি বা জাতি কর্তৃক নিজেদের শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করাকে ইসলাম প্রত্যাখ্যান করে।
রাসুল (সা.)-এর প্রধান বড় দু'টি কাজ ছিল- একটি হলো তাওহিদ অর্থাৎ আলস্নাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা। অপরটি মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। নির্ভেজাল তাওহিদের একমাত্র স্রষ্টা হচ্ছেন মহান আলস্নাহ তায়ালা। তার কোনো শরিক নেই, তার কোনো পুত্র-কন্যা নেই, তার কোনো স্ত্রীও নেই। সব উত্তম গুণই তার। তিনি সৃষ্টি জগতের সবকিছুরই দেখভাল করছেন। তাকে সহায়তা করার জন্য কোনো দেবদেবীর বিন্দুমাত্রও প্রয়োজন নেই। আলস্নাহ তায়ালার কাজ সম্পাদনের জন্য ফেরেশতারা নিযুক্ত রয়েছে। রাসুল (সা.) এর জীবনাদর্শের প্রভাবে আরব দেশের প্রায় সবটাই তার অধীন হয়ে যায় এবং তিনি গোটা আরব দেশেই তাওহিদের বিস্তার ঘটালেন। রাসুল (সা.)-এর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। মদিনায় এর আগে কোনো রাষ্ট্র ছিল না। তেমনিভাবে মক্কাও কোনো রাষ্ট্র ছিল না। সেখানে কুরাইশ ছাড়াও অন্যান্য গোত্র ছিল। প্রত্যেকের শাসন ছিল আলাদা আলাদা। প্রকৃতপক্ষে আরব দেশে কোনো রাষ্ট্রই ছিল না। রাসুল (সা.) সর্বপ্রথম মদিনায় রাষ্ট্র স্থাপন করেন। তার সময়েই গোটা আরব ভূমি এ রাষ্ট্রের অধীনে চলে আসে। রাষ্ট্র ব্যবস্থা ইসলামেরই যে অংশ অবিচ্ছেদ্য, তা তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে প্রমাণ করে গেছেন।
মক্কা বিজয়ের পর তিনি মুসলমান, খ্রিষ্টান, ইহুদিসহ সব সম্প্রদায়ের লোকের পরস্পরের মধ্যে শান্তি, সম্প্রীতি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য ঐতিহাসিক 'মদিনা সনদ' সম্পাদন করেন এবং তখনকার ইহুদিরা পর্যন্ত এ সনদ মেনে নিয়েছিল। ইসলামী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, এ মদিনা সনদই ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম লিখিত চুক্তি বা সংবিধান। এর দীর্ঘ বারোশ' বছর পরে অষ্টাদশ শতাব্দীতে যুক্তরাষ্ট্রে লিখিত সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। এ সনদের ফলে মুসলমান আর অমুসলমানদের মধ্যে এক অপূর্ব সম্প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠে। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হয়। নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলামের ইতিহাসে এ রকম রাষ্ট্রকে 'কল্যাণ রাষ্ট্র' বলা হয়। তাই বলা হয়, মদিনা রাষ্ট্রের আগে পৃথিবীতে কোনো কল্যাণ রাষ্ট্র ছিল না। তাছাড়া, ইসলামের ইতিহাসে তথা বিশ্বের ইতিহাসে 'হুদায়বিয়ার সন্ধি' এক যুগান্তকারী ঘটনা। বিশ্বের ইতিহাসে এ সন্ধি এক নুন অধ্যায়ের সূচনা করে। এ সন্ধিতে স্বাক্ষর করে মহানবী হজরত মুহম্মদ (সা.) এক অসাধারণ রাজনৈতিক প্রতিভা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দেন। তাই 'হুদায়বিয়ার সন্ধি' মহানবী (সা.)-এর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
মহান আলস্নাহ দ্বীন ইসলামকে বিজয়ী ও পূর্ণতা দানের জন্য মহানবী (সা.)কে প্রেরণ করেছিলেন। যখন দ্বীন ইসলাম বিজয় ও পূর্ণতা লাভ করে তখন তিনি তার বিদায়ের কথা অনুভব করেন। দশম হিজরিতে লক্ষাধিক সাহাবির সামনে জিলহজ মাসের ৯ তারিখ বিকালে আরাফাতের ময়দানে যে বক্তব্য পেশ করেন তা ঐতিহাসিক বিদায় হজের ভাষণ হিসেবে ব্যাপক পরিচিত। সৃষ্টির আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত আগত, বিগত পৃথিবীর সব ভাষণের মধ্যে এ ভাষণ শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় বিভূষিত। বিশ্ব মানবতার মুক্তির এমন কোনো দিক নেই, যার ছোঁয়া এই মূল্যবান ভাষণে লাগেনি। মূলত বিদায় হজের ভাষণ মহানবী (সা.)-এর ২৩ বছরের নবুয়তি জীবনের কর্মপন্থা ও প্রজ্ঞার নির্যাস। আর তখনই কোরআনের শেষ আয়াতটি নাজিল হয়, 'আজকের এই দিনে তোমাদের দীনকে পূর্ণ করে দিলাম। তোমাদের ওপর আমার নিয়ামত পূর্ণ করে দিলাম। ইসলামকেই তোমাদের ওপর দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।' বিশ্বনবী জীবন সায়াহ্নের আগে দিয়ে গেছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ- যা ইসলামের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত আছে। এ ভাষণের পর তিন মাস তিনি এই নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে অবিনশ্বর জগতে পাড়ি জমান। ৬৩২ খ্রিষ্ঠাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল, সোমবার ৬৩ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। তিনি আজ নেই কিন্তু তিনি ছিলেন সর্বশেষ নবী, সর্বকালের সেরা মানব। তিনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন দু'টি মূল্যবান জিনিস। একটি হলো সর্বকালের সেরা কিতাব আল কোরআন আর অপরটি হলো তার সর্বশ্রেষ্ঠ জীবনাদর্শ সুন্নাহ। বলা হয়েছে, এই দু'টিকে শক্ত করে আকড়ে ধরলে মানুষ কখনো পদভ্রষ্ট হবে না।
আসলে তার জীবন ও কর্মই তাকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবের স্বীকৃতি দিয়েছে।
মো. জিলস্নুর রহমান :ব্যাংকার ও কলাম লেখক