সাধারণ মানুষের গণতন্ত্র

রাষ্ট্রীয় কাজে অধিকসংখ্যক জনগণকে অংশগ্রহণের শ্রেষ্ঠ উপায় গণতন্ত্র। গণতন্ত্র একদিকে মানুষকে সহনশীল হতে শেখায় অন্যদিকে পরমতসহিষ্ণুতা ও বহুমতকে সহ্য করার প্রতি ব্যক্তি ও রাষ্ট্রকে অনুপ্রেরণা দেয়। গণতন্ত্রের মাধ্যমে সর্বাধিক মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব।

প্রকাশ | ২৬ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০

সালাম সালেহ উদদীন
বাংলা গণতন্ত্র পরিভাষাটি ইংরেজি ডেমোক্রেসি থেকে এসেছে। এই ইংরেজি শব্দটি আবার এসেছে গ্রিক শব্দ থেকে, যার অর্থ জনগণের শাসন। গণতন্ত্র বলতে কোনো রাষ্ট্রের এমন একটি শাসন ব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে নীতিনির্ধারণ বা সরকারি প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রত্যেক নাগরিক বা সদস্যের সমান ভোটাধিকার থাকে। তারা অবাধে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, একুশ শতকে এসে গণতন্ত্রের অবনমনের সূচনা হয়েছে। বিশ্বজুড়ে চালানো জরিপের জনমতে দেখা যাচ্ছে, আধা গণতান্ত্রিক অথবা একদলীয় শাসনের দেশের মানুষের চেয়ে গণতান্ত্রিক দেশগুলোর জনগণ তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক হতাশাগ্রস্ত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেই হতাশার ব্যবধান বেশি। নিজেদের সরকার সম্পর্কে তাদের আস্থার মাত্রার ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ অগণতান্ত্রিক দেশগুলোর চেয়ে গণতান্ত্রিক দেশগুলোর আস্থাশীলতার স্কোর অনেক নিচুতে। নিজ দেশের নাগরিকদের আস্থা অর্জনের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের সরকার যত স্কোর অর্জন করেছে, চীনের স্কোর তাদের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেশি। দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, অগ্রসর গণতন্ত্রের দেশগুলোতে লাখ লাখ শিশু দারিদ্র্যের মধ্যে বড় হচ্ছে। দারিদ্র্যের কারণে সেখানকার বহু প্রবীণকে খাদ্যতালিকায় কাটছাঁট করতে হচ্ছে। পশ্চিমের অগ্রসর গণতন্ত্রের বেশির ভাগ নাগরিকই তাদের জীবনমান আরও নিচের দিকে পড়ে যাবে কিনা, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। এর মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম ভারত। জাতপাতের সংঘাত, সাম্প্রদায়িক বিভেদ ও মেরুকরণ এবং দারিদ্র্য থাকার পরও ভারতই একমাত্র বড় গণতন্ত্র, যেখানে নাগরিকরা তাদের দেশের পরিচালন পদ্ধতি ও সরকারের প্রতি আশাবাদের ক্ষেত্রে উচ্চমাত্রার স্কোর অর্জন করেছে। এখান থেকে গণতন্ত্রকামী দেশের অনেক কিছু শেখার আছে। তা ছাড়া ভারতের পররাষ্ট্র নীতি হচ্ছে দেশ ও জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণ করা। তাদের দেশপ্রেম অনেক গভীরে। দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে তারা কোনো রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেয় না। ৫০ বছর আগেও পশ্চিমে বেশির ভাগ পরিবারে একজন উপার্জনকারী সদস্য ছিল এবং তারা বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে ছিল। আজ অসংখ্য পরিবারে মা-বাবা দুজনই উপার্জন করেন। তবু তারা কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। শুধু বাবা অথবা শুধু মা আছেন এমন বহু পরিবারের কপালে 'কর্মজীবী দরিদ্র' পরিবারের তকমা জুটছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমের ধনী দেশগুলো যে শিল্প ও অর্থনৈতিক আধিপত্যের স্বাদ উপভোগ করছিল, ১৯৮০-এর দশকে এশিয়ার অর্থনীতিগুলো তাদের পশ্চিমের সেই আধিপত্য বলয় থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়। বেশির ভাগ গণতান্ত্রিক দেশে প্রগতিশীল ও রক্ষণশীল দলগুলো পালা করে ক্ষমতায় আসে। এসব দেশের সরকারগুলো ঋণের বোঝায় নুয়ে পড়েছে। অনেক দেশের সরকারি ঋণের পরিমাণ জিডিপির ১০০ শতাংশের বেশি। এ ঋণের বোঝা পরবর্তী প্রজন্মের ঘাড়ে চাপিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অথচ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের এ ঋণের অর্থ শিক্ষা, অবকাঠামো ও স্বাস্থ্যসেবা খাতে ব্যয় করা হচ্ছে না। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ সমূহের অর্থনৈতিক চিত্রও সুখকর নয়। এ অবস্থা এসব দেশের ভোটারদের মনে প্রশ্ন জাগাচ্ছে, কেন তারা বছরের পর বছর ধরে এমন রাজনৈতিক নেতাদের ভোট দিয়ে গদিতে বসাচ্ছে, যাদের বানানো নীতির কারণে অসাম্য, দারিদ্র্য ও ঋণ উত্তরোত্তর বেড়েই যাচ্ছে। জনগণের এ ক্রমবর্ধমান হতাশা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ধারাবাহিক দুর্বলতা হিসেবে উন্মোচিত হচ্ছে। বেশির ভাগ গণতন্ত্রমনা দেশের একজন রাজনৈতিক প্রার্থীর পক্ষে সরকারি ব্যয় কমানো ও বরাদ্দ সংকোচনের প্রতিশ্রম্নতি দিয়ে ক্ষমতায় আসা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। 'জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য এবং জনগণের শাসনই গণতন্ত্র। পৃথিবীর শক্তিশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট ১৯ নভেম্বর ১৮৬৩ সালে গেটিসবার্গ বক্তৃতায় গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠ সংজ্ঞা প্রদান করেন। আর যিনি এই সংজ্ঞা প্রদান করেন তিনি হলেন দৃঢ় ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন, পরমত সহিষ্ণুতাসম্পন্ন, মানবতাবাদী, গণতন্ত্র প্রেমী এবং বাগ্মিতায় অনন্য অসাধারণ আব্রাহাম লিংকন। পৃথিবীর রাষ্ট্রসমূহের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী এবং স্থিতিশীল করে মানুষের সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস পালনের উদ্দেশ্য। রাষ্ট্রীয় কাজে অধিকসংখ্যক জনগণকে অংশগ্রহণের শ্রেষ্ঠ উপায় গণতন্ত্র। গণতন্ত্র একদিকে মানুষকে সহনশীল হতে শেখায় অন্যদিকে, পরমতসহিষ্ণুতা ও বহুমতকে সহ্য করার প্রতি ব্যক্তি ও রাষ্ট্রকে অনুপ্রেরণা দেয়। গণতন্ত্রের মাধ্যমে সর্বাধিক মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব। জনগণের জন্য, জনগণের মাধ্যমে গঠিত এ তন্ত্র বাক্‌সাধীনতাসহ মানুষের সার্বিক বিকাশে সর্বদা কার্যকর। ফলে এটি সর্বত্র, সব সময়, সর্বজনকর্তৃক আনন্দময় ও অর্থবহ বলে বিবেচিত। স্বাধীনতার মূল্যবোধ, মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা, মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচন গণতন্ত্রের জন্য অত্যাবশ্যক। সত্যিকার মূল্যবোধ ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। সাধারণ অর্থে গণতন্ত্র হচ্ছে মূলত সংখ্যা গরিষ্ঠের সঙ্গে গঠিত ও পরিচালিত সরকার। এর অর্থ এই নয় যে, গণতন্ত্র সংখ্যালঘুর মতামত ও স্বার্থকে উপেক্ষা করবে বরং গণতন্ত্রে আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান। বর্তমানে গণতন্ত্রের বিকাশ এতই সাফল্যজনক পরিস্থিতি লাভ করেছে যে, আধুনিক সভ্যতা গণতান্ত্রিক সভ্যতায় পরিণত হয়েছে। গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রেখেছে পৃথিবীর অনেক দেশ। এটাই সত্য, এটাই বাস্তব। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেই যদি বলি, দেশের চলমান উন্নয়নকে টেকসই করতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে এবং এর বিকাশকে ত্বরান্বিত করা জরুরি। কারণ গণতন্ত্র জনগণের মৌলিক অধিকার। গণতন্ত্র অব্যাহত রাখা ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের জন্য দলমতনির্বিশেষে সবার সম্মিলিত প্রয়াস খুবই প্রয়োজন। একটি অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দেশের গণতন্ত্রকে সুস্থ ও সবল করে তুলতে হবে। যাতে দেশের গণতন্ত্র নিয়ে কেউ প্রশ্ন করতে না পারে। মনে রাখতে হবে সাধারণ মানুষের গণতন্ত্র হচ্ছে ভোট ও ভাতের অধিকার। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পাঁচ দশকে আমাদের অনেক অর্জন রয়েছে। কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক উন্নতি লাভে পুরোপুরি সফল না হলেও অর্জিত সাফল্য আশাব্যঞ্জক। স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ের তুলনায় তো বটেই, এমনকি নব্বইয়ের দশকের তুলনায় দারিদ্র্যের হার উলেস্নখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। 'মাছে ভাতে বাঙালি' বলে পরিচিত আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য চাল ও আমিষের প্রধান উৎস মাছ উৎপাদনে দেশ স্বনির্ভরতা অর্জন করেছে। যদিও আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রশ্নবিদ্ধ। মানবসম্পদ উন্নয়ন ও সামাজিক ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে। আমরা চাই সাধারণ মানুষের গণতন্ত্র। সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক নিশ্চয়তাসহ সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যেতে পারত। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি বড় বাধা। দুর্নীতির রাহুগ্রাস থেকে বাংলাদেশ এখনো মুক্ত হতে পারেনি। বিশেষ করে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দুর্নীতিতে এমনভাবে জড়িয়ে পড়েছেন, তাদের বেতন দ্বিগুণ করেও কোনো লাভ হয়নি। তাদের লোভ ও মানসিকতার কোনো পরিবর্তন হয়নি। দুদকের বর্তমান তৎপরতার মাধ্যমে অনেক তথ্য রেবিয়ে আসছে। এর দ্বারা প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হয় যে, বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূল করা অনেক কঠিন কাজ। এ জন্য দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে রাষ্ট্রকেই। দুর্নীতি নিমূল করা সম্ভব হলে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ হবে বিশ্বের বুকে একটি মর্যাদাশালী ও গর্বিত দেশ। গণতন্ত্র বিকাশের মাধ্যমে বাংলাদেশ এগিয়ে যাক সমহিমায় তার উজ্জ্বলতা নিয়ে, আমরা আশাবাদী। \হ সালাম সালেহ উদদীন : কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক ও সাংবাদিক