ঊর্ধ্বমুখী দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে করণীয়

মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে হবে। সমবায় ভিত্তিতে প্রান্তিক উৎপাদনকারীদের বাজারে প্রবেশের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। সরকারের নীতিনির্ধারকদের হাতে যেসব উপায় ও সক্ষমতা রয়েছে তার সদ্ব্যবহারের এখনই উপযুক্ত সময়।

প্রকাশ | ১৩ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০

অমল বড়ুয়া
দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধিতে নাকাল সাধারণ মানুষ। জীবনযাপন কষ্টকর হয়ে পড়েছে- নিম্ন, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের। ফোর্বসের মতো সাময়িকীগুলো বলছে, ১৯৮০-র দশকের শুরুর দিকের পর এই প্রথম এত দ্রম্নতগতিতে বেড়েছে জিনিসপত্রের দাম আর তাদের ধারণা মূল্যস্ফীতির এই ঊর্ধ্বগতি সহসাই কমার সম্ভাবনা কম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর হিসাবমতে, ২০১৭ থেকে ২০২১ এই চার বছরে মূল্যস্ফীতির হার ২৮ দশমিক ৭ শতাংশ। অর্থাৎ ২০১৭ সালে ১০০ টাকা দিয়ে যে পণ্য কেনা যেত ২০২১ সালে এসে সেটি কিনতে খরচ হয়েছে প্রায় ১৩১ টাকা। সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর প্রকাশিত (১৭ আগস্ট, ২০২২) তথ্য অনুযায়ী, 'গত এক বছরের ব্যবধানে চালের দাম বেড়েছে প্রায় ১২ শতাংশ, আটা ৭৫ শতাংশ, মসুর ডাল ৪১ শতাংশ, অ্যাঙ্কর ডাল ৫৩ শতাংশ, সয়াবিন তেল ৪১ শতাংশ, মুরগি (ব্রয়লার) ৫৬ শতাংশ এবং ডিমের দাম বেড়েছে ৫৪ শতাংশ।' নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। খাদ্য তালিকা থেকে অনেকেই মাছ মাংস ছেঁটে ফেলছেন। শাকসবজির দামেও লেগেছে আগুন। নিম্ন আয়ের মানুষ যা আয় করছে, তার পুরোটাই জীবনধারণের জন্য নূ্যনতম খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও শিক্ষা ইত্যাদির জন্য ব্যয় করার মতো অর্থ তাদের হাতে থাকছে না। আয় যে হারে বেড়েছে, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য। আর এর কারণ হচ্ছে বাজারের ওপর কর্তৃপক্ষের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে বিভিন্ন অজুহাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে বিপাকে ফেলছে। একবার যে পণ্যের দাম বাড়ে, তা আর কমে না। গত এক বছরে ভোজ্যতেলের মতো বিভিন্ন আমদানিভিত্তিক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমেছে। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো ভোক্তা স্থানীয় বাজারে এর প্রভাব দেখেননি। কারণ মার্কিন ডলারের ঘাটতি এবং সরকারি সংস্থাগুলো পেট্রোলিয়াম ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির জন্য উচ্চতর আমদানি ব্যয়ের কারণে আমদানিকারকরা দাম কমায়নি। তবে, এর পেছনের কারণ হিসেবে সরবরাহ শৃঙ্খলের অসঙ্গতিকে দায়ী করেছেন ব্যবসায়ীরা। ২০২৩ সালের আগস্টে প্রধান খাদ্যদ্রব্যগুলোর বৈশ্বিক মূল্য দুই বছরের সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছালেও, বাংলাদেশে এই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ- যা ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। সামগ্রিক মূদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) মতে, মুদ্রাস্ফীতির কারণে মানুষ শিক্ষা, চিকিৎসা ও বিনোদন খাতে ব্যয় কমিয়ে দিয়েছে। এটি ভবিষ্যতে তাদের জীবনে নেতিবাচক জটিলতা সৃষ্টি করবে। জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির ফলে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার মান খারাপ হয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মধ্যম ও স্থির আয়ের মানুষের দুর্দশা আরও বেড়েছে। বেসরকারি চাকরিজীবী, পোশাক কারখানার চাকরিজীবী ও দিনমজুর সবার অবস্থা খুবই নাজুক। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্য ও দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদিত পণ্যের দাম বেড়ে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস ওঠেছে। সাধারণ মানুষের দুর্দশা লাঘবে কোনো পক্ষের কোনো উদ্যোগ এ পর্যন্ত দৃশ্যমান হয়নি। বরং অনেকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিকে বৈশ্বিক কারণ বলে দায় সারছেন। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলছে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্য রপ্তানি ব্যাহত হওয়ায় বিশ্বে খাবারের উচ্চমূল্য নতুন রেকর্ড গড়েছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বলেছে, বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে স্থানীয় বাজারে কেরোসিন, ডিজেলসহ বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্য ও জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি ও সরকারের প্রদত্ত বিভিন্ন প্রণোদনার কারণে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ সাম্প্র্রতিক এক বিশ্লেষণে বলেছে, বাংলাদেশে পণ্যের উচ্চমূল্য শুধু বাহ্যিক বা আন্তর্জাতিক বাজারের কারণেই নয়। এর পেছনে আছে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের অভাব, বাজারের সিন্ডিকেট, প্রয়োজনীয় মনিটরিংয়ের অভাব ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকা। শুধু নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নয়, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হোল্ডিং ট্যাক্স, কর, ভ্যাটসহ সরকারি সেবার মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টিও। জ্বালানি সংশ্লিষ্ট কোম্পানি বিশেষ করে গ্যাস কোম্পানিগুলো দাম বৃদ্ধির অসম প্রতিযোগিতায় নেমেছে। বর্তমানে প্রতিদিন ৩ হাজার ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস বাংলাদেশে সরবরাহ করে বিতরণ কোম্পানিগুলো। তার মধ্যে ২ হাজার ৩০০ ঘনফুট গ্যাস দেশীয় উৎস থেকে সরবরাহ করা হয়। বাকি ৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি গ্যাস আমদানি করা হয়। এই স্বল্প পরিমাণ গ্যাসের জন্য এত বেশি মূল্যবৃদ্ধি অযৌক্তিক বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাছাড়া তিতাস গ্যাস কোম্পানিও বিইআরসিতে যে হিসাব জমা দিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে যে, গত চার বছরে কোম্পানিটি ১৪০৯ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। জ্বালানির দাম বৃদ্ধি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, পরিবহণ ব্যয়, চিকিৎসা ব্যয় ও শিক্ষা ব্যয়ের কারণে মাসিক বেতন দিয়ে সব খরচ মেটাতে পারছেন না নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষ। ডবিস্নউএফপির জরিপমতে, ৭১ শতাংশ পরিবার খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়াকে সর্বোচ্চ উদ্বেগের বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করেছে। প্রতি ১০ জনের ৭ জন জীবনযাত্রার মান কমিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। যাদের বড় অংশ আগের চেয়ে খাবার খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন, ঋণ করছেন এবং উৎপাদনশীল সম্পদ বিক্রি করছেন ও বাকিতে খাবার কিনছেন। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) গবেষণা বলছে, যে ৭৪ শতাংশ পরিবার ঋণ করে চলেছে, তাদের ঋণ করা বন্ধ হয়েছে বা বন্ধ হবে, এমন পরিস্থিতি এখনো আসেনি। আর পরিস্থিতি যদি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে ৮৫ শতাংশ পরিবারের কথা হলো আগামী ছয় মাসে তাদের আরও ঋণ করতে হবে। সঞ্চয় বিমুখ হয়েছে ৫৫ শতাংশ পরিবার। ৮৫ শতাংশ পরিবার মনে করে যে, আগামী ছয় মাসে তাদের আরও ঋণ করে চলতে হবে। ৩৫ শতাংশ পরিবার তাদের সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। আয় না বাড়লেও গত ছয় মাসে এসব পরিবারের ব্যয় বেড়েছে ১৩ দশমিক ১ শতাংশ। ফলে ঋণ করেও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না তারা। দ্রব্যমূল্য যেভাবে পালস্না দিয়ে বাড়ছে সেভাবে মানুষের আয় বাড়ছে না। বর্তমান ঊর্ধ্বমুখী বাজারমূল্যের এ সময়ে সীমিত আয় দিয়ে সব খরচ সামলে চলা দারুণ কষ্টের। বিশেষ করে যারা মধ্যবিত্ত তাদের অবস্থা আরও খারাপ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দ্রব্যমূল্যের এই লাগাম টানবে কে? বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশের অনুচ্ছেদ ১৪-তে কৃষক ও শ্রমিকের মুক্তির কথা বলা হয়েছে- রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে মেহনতি মানুষকে, কৃষক ও শ্রমিককে এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সব ধরনের শোষণ হতে মুক্তি দান। অনুচ্ছেদ ১৫-এর 'ক' ধারায় বলা হয়েছে- রাষ্ট্র অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করবে। অর্থাৎ জনগণের বেঁচে থাকার সামগ্রিক শর্ত নির্মাণে রাষ্ট্র সাংবিধানিকভাবে বাধ্য। তাই সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব হিসেবে সাধারণ মানুষের বেঁচের থাকার প্রয়োজনীয় উপকরণের সহজলভ্যতার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারের দায়িত্ব সাধারণ মানুষের জীবনকে সহনীয় রাখা। এর জন্য সরকার প্রয়োজন অনুযায়ী কর কমাতে পারে। অতি মুনাফালোভী মজুতদার সিন্ডিকেট ও কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারী ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাজার মনিটরিংকে জোরদার করতে হবে। দেশে সংরক্ষণের অভাবে বছরে ৩০ শতাংশ খাদ্যপণ্য নষ্ট হয়। এর সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া জরুরি। \হমধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে হবে। সমবায় ভিত্তিতে প্রান্তিক উৎপাদনকারীদের বাজারে প্রবেশের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। সরকারের নীতিনির্ধারকদের হাতে যেসব উপায় ও সক্ষমতা রয়েছে তার সদ্ব্যবহারের এখনই উপযুক্ত সময়। অমল বড়ুয়া : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক