বাংলাদেশের কৃষির অব্যাহত অগ্রযাত্রায় চলমান আন্দোলনের বিধ্বংসী প্রভাব

জাতির পিতার ন্যায় বঙ্গবন্ধুকন্যাও একইভাবে কৃষি অন্তপ্রাণ। তিনিও কৃষিতে বিনিয়োগ বা ভর্তুকি প্রতি বাজেটে বাড়িয়েই চলেছেন। আর জলবায়ু সহায়ক কৃষির বিকাশে তিনি বরাবরই নিবেদিত। প্রেক্ষাপট পরিকল্পনা, বদ্বীপ পরিকল্পনা এবং মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনায় তিনি সবুজ প্রবৃদ্ধি তথা জলবায়ু সহায়ক কৃষির উন্নতির প্রশ্নে খুবই তৎপর।

প্রকাশ | ২১ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০

অধ্যাপক ড. মো. মোতাহার হোসেন
বাংলাদেশের কৃষি খাত দেশের অর্থনীতিতে মুখ্য ভূমিকা পালন, জনসংখ্যার একটি উলেস্নখযোগ্য অংশের কর্মসংস্থান এবং বিশ্বজুড়ে চলমান যুদ্ধ-সংঘাত, মহামারি, জলবায়ু বিপর্যয়জনিত নানা অভিঘাত মোকাবিলা করে দেশের খাদ্য চাহিদার অব্যাহত জোগান তথা খাদ্য নিরাপত্তা বজায় রেখে চলেছে। সারা পৃথিবী যখন অর্থনৈতিক মন্দার কবলে নিজেদের টালমাটাল অবস্থা থেকে উত্তরণের প্রচেষ্টায় লিপ্ত, তখন বাংলাদেশের অভাবনীয় অগ্রগতি যে কৃষির অভাবনীয় উন্নয়নের জন্যই ঘটছে একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশের কৃষির এই রূপান্তরের পেছনে রয়েছে শেখ হাসিনা সরকারের দূরদৃষ্টি ও ধারাবাহিক বিনিয়োগ, কৃষিবিজ্ঞানীদের উদ্ভাবন ও গবেষণা, সম্প্রসারণকর্মীদের মাঠ পর্যায়ের ভূমিকা এবং সর্বোপরি ফসলের মাঠে কৃষকের ঘাম ঝরানো পরিশ্রম। সরকারের পাশাপাশি উন্নয়নমুখী কেন্দ্রীয় ব্যাংক উপযুক্ত কৃষিঋণ নীতিমালা প্রণয়ন, সবুজ কৃষির জন্য বিশেষ তহবিল গঠন, নারী উদ্যোক্তাসহ সবুজ উদ্যোক্তাদের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়নের সুযোগ সৃষ্টির কথাও বিশেষভাবে উলেস্নখযোগ্য। সবার এই সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের কৃষি আজ খোরপোশ কৃষি থেকে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরিত হয়েছে। কিছুদিন আগেও ভয়াবহ করোনাকালে সরবরাহ চেইন ভেঙে পড়ার ফলে কৃষি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিল এবং তাৎক্ষণিকভাবে সরকার দ্রম্নত প্রণোদনা প্যাকেজ নিয়ে কৃষকের পাশে দাঁড়িয়েছিল বলেই কৃষির আজকের এ উন্নতি সম্ভব হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের কৃষিবিজ্ঞানীরা নিত্যনতুন উদ্ভাবন ও মাঠ পর্যায়ে গবেষণায় নিজেদের যেভাবে নিয়োজিত রেখেছেন তাও আমাদের মনে রাখতে হবে। তাছাড়া, কৃষিপণ্যের সংরক্ষণ, সোলার ইরিগেশন পাম্পের প্রসার এবং ই-কমার্সের মাধ্যমে কৃষির সম্প্রসারণের চ্যালেঞ্জসমূহ উত্তরণের ভূমিকাও কম নয়। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জের শিকার প্রথম সারির দেশ। তাছাড়া, কোভিডের প্রভাবে সারের উৎপাদন যেভাবে কমে গেছে, তাতে কৃষির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সাম্প্রতিক ইসরাইল-হামাস যুদ্ধ ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধও বিশ্ব খাদ্য বাজারকে ওলটপালট করে দেওয়ার আশঙ্কা তৈরি করেছে। বাংলাদেশ সার, গম ও ভোজ্যতেল সংগ্রহে বেশ চাপেই আছে। এর মাঝে বিএনপি-জামায়াত জোটের চলমান নেতিবাচক রাজনৈতিক কর্মসূচি যেন 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা'। লাগাতার অবরোধ-হরতাল তথা যত্রতত্র গাড়িতে অগ্নিসংযোগ-ভাঙচুরের ফলে কৃষিতে বিধ্বংসী প্রভাব পড়ছে এবং কৃষির অব্যাহত অগ্রযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। বাধাগ্রস্ত কৃষিকাজ কৃষি কাজের সঙ্গে বাংলাদেশের ৮০ ভাগ মানুষ সরাসরিভাবে জড়িত। অথচ এই কৃষিকে ধ্বংস করতে নানামুখী ষড়যন্ত্র এখনো বিদ্যমান। বিগত ২০১৪ সালে টানা হরতাল-অবরোধে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল কৃষি খাত; এরপর করোনাকালীন মুখ থুবড়ে পড়ে দেশের কৃষি খাত, এবারও একই সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। যার ভুক্তভোগী হচ্ছে দেশের কোটি কোটি জনগণ। বর্তমান সরকারের নানামুখী পদক্ষেপে কৃষি খাতকে ভগ্নদশা থেকে উত্তরণের জন্য কৃষকরা কঠোর পরিশ্রম করে কৃষিকে একটা পর্যায়ে উন্নীত করতে পেরেছে- যা আবারও অবরোধ-হরতালে ভেঙে পড়ার মতো অবস্থায় উপনীত হয়েছে- যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে কৃষকরা মাঠে ফসল বুনে, সেই সঙ্গে বুনে তাদের স্বপ্নও। এই স্বপ্ন বুনতে কিছু উপকরণ প্রয়োজন হয় তাদের। হরতাল-অবরোধের ফলে যথাসময়ে তাদের এসব উপকরণ প্রাপ্তিতে বিঘ্ন ঘটে; যার ফলে, থমকে যায় তাদের স্বপ্ন। উপকরণসমূহের মধ্যে আছে বীজ, সার, বালাইনাশক, তাছাড়াও আছে শ্রমিকের ঘাটতি- যা এসব নেতিবাচক কর্মসূচির মাধ্যমে বিঘ্নত হয়। তাইতো, সম্প্রতি ঈশ্বরদীর শ্রমিক নেতা সিদ্দিকুর রহমান ক্ষোভের সঙ্গে বলেছেন, আন্দোলন সংগ্রাম করে কৃষক ও কৃষি পণ্যকে জিম্মি করে রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতায় যায়, তারা লাভবান হন। আর ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষক। হরতাল অবরোধে কৃষিপণ্য বা কৃষি উপকরণ নির্বিঘ্নে চলাচল করতে দেওয়া না হলে দেশে খাদ্য সংকট দেখা দেবেই। আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের কোটি কোটি কৃষক। যার প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতিতে। এমনিতেই, কোভিড-১৯ মহামারি এবং ইসরাইল-ফিলিস্তিন ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বাংলাদেশসহ বিশ্ব অর্থনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় ব্যাঘাত, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এবং মুদ্রাস্ফীতির চাপ ব্যবসা করার খরচ বাড়িয়েছে। আমদানি হ্রাসের ফলে উৎপাদন ও রপ্তানি হ্রাস পেয়েছে- যা সামগ্রিক অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলেছে। যদি ধর্মঘটের কারণে শ্রমিকের ঘাটতি দেখা দেয়, হয় বিক্ষোভে অংশগ্রহণের কারণে বা পরিবহণ ব্যাঘাতের কারণে, কৃষকরা সংকটজনক সময়ে পর্যাপ্ত শ্রমঘাটতির কবলে পড়ে- যা কৃষি উৎপাদনশীলতাকে প্রভাবিত করে। ব্যাহত কৃষি সরবরাহ ব্যবস্থা ধর্মঘট-অবরোধে খামার থেকে বাজারে কৃষি পণ্য পরিবহণে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। এর ফলে, বিলম্ব হয় পরিবহণ; পরিবহণ খরচও বেড়ে যায় এবং আলটিমেটলি, ফসল সংগ্রহোত্তর ক্ষতির সম্মুখীন হয় কৃষক। সম্প্রতি ঈশ্বরদী প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে হরতাল-অবরোধে কৃষিপণ্য নির্বিঘ্নে বাজারজাতকরণের দাবি জানিয়েছেন কৃষক নেতারা। কৃষকদের ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ দেওয়া হয় না দাবি করে তারা বলেন, এনজিও এর সুদসহ ঋণের কিস্তি দিতে আজ কৃষক সমাজ হিমশিম খাচ্ছে। ঠিক সে সময়ে হরতাল আর অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি গ্রহণ করেছে বিরোধী রাজনৈতিক জোট। এতে কৃষি পণ্যের বাজারজাতকরণের সমস্যায় মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের কৃষক সমাজ। তিন দফা অবরোধের মধ্যে যানচলাচল বন্ধ হয়ে লোকসানে পড়েছেন গড়াছড়ির পেঁপে চাষিরা। ফলে অর্ধেক মূল্যে পেঁপে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন অনেক চাষি। দেশের অন্যতম পেঁপে উৎপাদনকারী জেলা খাগড়াছড়ি। চলতি মৌসুমে জেলার ৯ উপজেলায় ৫৭১ হেক্টর জমিতে পেঁপে চাষ হয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এই পেঁপে সরবরাহ করা হয়। অবরোধের কারণে প্রায় লক্ষাধিক কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে জানিয়েছে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। চাষিরা জানান, স্বাভাবিক সময়ে ৪০ টাকা কেজি দরে পেঁপে বিক্রি হলেও এখন ২০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। আবার অনেক মালিক বিক্রি করতে না পারায় বাগানেই পেঁপে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বাজারে প্রবেশে বাধা অবরোধ-ধর্মঘটের সময় কৃষকরা তাদের পণ্য বিক্রি করার জন্য বাজারে প্রবেশে করতে বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। এটি তাদের আয়কে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। ঈশ্বরদীসহ দেশের অনেক উৎপাদন জোনে শত শত টন আগাম শীতকালীন সবজি খেতেই নষ্ট হচ্ছে। শীতকাল সামনে রেখে যে স্বপ্ন তারা বুনেছিলেন, তাধূলিসাৎ হয়ে গেছে। এলাকার জমির মালিকদের কাছ থেকে জমি লিজ নিয়ে সবজি চাষ করেন ভূমিহীন প্রান্তিক চাষিরা। বিভিন্ন জায়গা থেকে ধার-কর্জ, এনজিওর ঋণ ইত্যাদি নিয়ে তারা এসব সবজি চাষ করেন। ফসল উঠলে টাকা পরিশোধ করে লাভের হিসাব কষেন। এই অবরোধে, তাদের সবারই কপাল পুড়েছে। লোকসানের শিকার হয়েছেন অধিকাংশ কৃষক। অধিকাংশ চাষির খেতের সবজি হরতাল-অবরোধের কারণে তুলতে না পেরে খেতেই নষ্ট হচ্ছে। বেশ কয়েকজন মিলে ট্রাক ভাড়া করে বাজারে পাঠানোর উদ্যোগ নিলেও সেখানে গুনতে হচ্ছে অনেক বেশি ভাড়া- যা তার উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। উদাহরণস্বরূপ, চলতি মৌসুমে গোদাগাড়ীতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার হেক্টর জমিতে আগাম জাতের শীতকালীন টমেটোর চাষ হয়েছে। প্রায় এক মাস আগে জমি থেকে টমেটো তোলা শুরু হয়। কিন্ত গত ২৬ নভেম্বর থেকে চলমান অবরোধে পরিবহণ বন্ধ থাকায়- ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বিভিন্ন জেলায় টমেটো সরবরাহ করতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। কৃষি বিভাগসহ স্থানীয় কৃষকরা প্রতি বছর রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার টমেটো বিক্রি করেন। এবার তার চার ভাগের এক ভাগ, অর্থাৎ ১০০ কোটি টাকাও বিক্রি করতে পারবেন কিনা সন্দেহ। প্রতি বছর এ সময়ে যেখানে গোদাগাড়ীতে টমেটো চাষিদের মধ্যে উৎসব দেখা যেত, এখন সেখানে বিরাজ করছে চরম হতাশা। কৃষি উপকরণের ঘাটতি হরতাল-অবরোধের কারণে দেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলাগুলোয় সার ও ডিজেলের সংকট সৃষ্টি হয়। সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ী নৌবন্দর থেকে উত্তরবঙ্গের ১৬টি জেলায় সার সরবরাহ বন্ধ থাকায় বাঘাবাড়ী বন্দরে খোলা আকাশের নিচে হাজার হাজার টন ইউরিয়া সার পড়ে থাকতে দেখা যায়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে দেশে প্রতি বছর সারের গড় চাহিদা ৪৫ থেকে ৪৭ লাখ টন। এর মধ্যে ইউরিয়ার চাহিদা ২৮ থেকে ২৯ লাখ টন। এছাড়া টিএসপি ছয় থেকে সাত লাখ ও মিউরেট অব পটাশ (এমওপি) প্রয়োজন হয় বছরে সাড়ে ছয় লাখ টন। এসব সারের ৬৫ শতাংশই প্রয়োজন বোরো মৌসুমে। সাধারণত কৃষকের জন্য সার সরবরাহ করেন বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) ও বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএপএ) ডিলাররা। এখন দেশের সব এলাকায় বোরো বীজতলা তৈরি ও রোপণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় এবং সারের চাহিদা সর্বোচ্চ। কিন্তু হরতাল-অবরোধের কারণে সার পরিবহণ ব্যাহত হচ্ছে। আমদানি করা প্রচুর পরিমাণ সার পড়ে আছে দেশের বৃহত্তম দুই সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম ও মংলায়। টানা অবরোধের কারণে সারাদেশে বিঘ্নিত হচ্ছে জ্বালানি তেল সরবরাহ কার্যক্রম। একই সঙ্গে কমেছে বিক্রিও। নৌপথে সরবরাহ ব্যবসা চালু থাকলেও গত এক মাসে সাপ্তহিক ছুটির দিন সড়ক ও রেলপথে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধই ছিল বেশি। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের হিসাবে চট্টগ্রাম নগরের পতেঙ্গায় অবস্থিত জ্বালানি তেলের প্রধান ডিপো থেকে এক দিনের অবরোধে দেশের ডিপোগুলোয় গড়ে ১৬ থেকে ১৮ হাজার মেট্রিক টন জ্বালানি তেল সরবরাহ বিঘ্নিত হয়। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সেচনির্ভর বোরো মৌসুমের ওপর। চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝে নির্ধারিত সময়ে আলুবীজ সংগ্রহ ও বিক্রি নিয়ে উদ্বিগ্ন রংপুর অঞ্চলের ডিলাররা। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) ২০২৩-২৪ বিতরণবর্ষে ডিলারদের জন্য বীজ বরাদ্দের বুকিংয়ের শেষ দিন ছিল ৫ নভেম্বর। নির্ধারিত সময়ে রংপুর অঞ্চলের ৮৫৬ ডিলারের মধ্যে বুকিং দিয়েছেন ৭৪৯ জন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কোল্ড স্টোরেজ থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে তাদের। হরতাল-অবরোধ চলতে থাকলে পরিবহণ সংকটে নির্ধারিত সময়ে বীজ সংগ্রহ নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে ডিলারদের মাঝে। আবার নভেম্বরের মধ্যে কৃষকের কাছে বীজ বিক্রি করতে না পারলে লোকসানের ঝুঁকিও রয়েছে। নিদির্ষ্ট সময়ে মানসম্পন্ন বীজ না পেলে আলু আবাদে নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা রয়েছে কৃষকদেরও। হরতাল অবরোধের আর্থিক ক্ষতি অনাকাঙ্ক্ষিত হরতাল-অবরোধের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির বিষয়ে ঢাকা চেম্বার ২০১৩ সালে একটি গবেষণা পরিচালনা করেছিল। সেখানে দেখা গিয়েছিল, প্রতিদিন হরতালের কারণে ক্ষতি হয় প্রায় এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে ২০১৪ সালে সিপিডি তাদের গবেষণায় দেখিয়েছিল, এই ক্ষতির পরিমাণ প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। আমাদের অর্থনীতির আকার আগের তুলনায় অনেক বড় হয়েছে। সে কারণে এটা বলা যায় যে, চলমান হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচিতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আগের তুলনায় অনেক বেশি হবে। যেহেতু হরতাল-অবরোধ দেশের সব খাতকেই আক্রান্ত করছে এবং দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে ব্যাহত করছে; সে কারণে এই অস্থিরতা দীর্ঘায়িত হলে এলডিসি থেকে উত্তরণও কঠিন হয়ে পড়বে। সুতরাং, এই সংকট নিরসনের পাশাপাশি অর্থনীতি যাতে আর ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে। বিনিয়োগ ও উন্নয়নে ক্ষতিকর প্রভাব হরতাল-অবরোধের আরেক ধরনের ক্ষতি হচ্ছে, দেশের ভাবমূর্তির ক্ষতি। কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং নিয়ে সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সারা বিশ্বে বাংলাদেশ নানা ক্ষেত্রে সুনাম অর্জন করেছে। বিগত দেড়-দশক ধরে সরকার যখন বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের সুন্দর পরিবেশ সম্পর্কে একটি ইতিবাচক চিত্র তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে; আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়রা যখন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশংসা করছে; ইকোনমিস্ট ইন্টেরিজেন্স ইউনিট যখন পূর্বাভাস দিচ্ছে যে, বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে বিশ্বের ২০তম অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হবে; তখন, হরতাল-অবরোধের মতো ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি বিদেশে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা দিচ্ছে। আমরা যে সুনাম অর্জন করেছি, তার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এর ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার চিন্তা করবে। আমরা এরই মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগ এবং বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের ক্রমহ্রাসমান প্রবণতা লক্ষ্য করছি। বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহের হার ৯.৮২ শতাংশে নেমে এসেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও আন্তর্জাতিক বাজারে অবস্থান হারাবে। বিনিয়োগ প্রবাহ বজায় রাখার জন্য ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। ২০৪১ সালের মধ্যে ২০তম অর্থনীতিতে রূপান্তরের জন্য দ্রম্নত শিল্পায়নের দিকে যেতে হবে। বাংলাদেশ যে বিনিয়োগ ও ব্যবসার জন্য একটি আদর্শ স্থানে পরিণত হয়েছে- তা আমরা অনেক সূচককের উন্নতির দিকে লক্ষ্য করলে বুঝতে পারি। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে ভৌগোলিকভাবে কৌশলগত সুবিধাজনক অবস্থানে থাকার কারণে বাংলাদেশও বিশ্বের বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি অন্যতম আদর্শ গন্তব্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। হরতাল-অবরোধ এবং যে কোনো সহিংস কর্মসূচি অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে। তাই অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে অগ্রাধিকার বিবেচনায় নিয়ে সবাইকে হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচির থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি। তাদের কাছে আমাদের একটাই প্রত্যাশা, ব্যবসা করতে পারেন এবং সাধারণ মানুষ যেন নির্ভয়ে চলাফেরা করতে পারে সেদিকে নজর দিতে হবে। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও তাদের সহযোগীদের ডাকা একের পর এক হরতাল-অবরোধ কর্মসূচির কারণে টান পড়েছে শিশুখাদ্যেও। দুধ সরবরাহ বন্ধ থাকায় দেশের সবচেয়ে বড় সমবায়ী প্রতিষ্ঠান মিল্ক ভিটায় প্রতিদিন ক্ষতি হচ্ছে এক কোটি পাঁচ লাখ টাকা। অন্যদিকে, মিল্ক ভিটা থেকে দুধ কেনা বন্ধ থাকায় চরম দুর্যোগে পড়েছেন সমবায়ী খামারিরা। এদিকে চট্টগ্রামের পশ্চিম পটিয়ার শিকলবাহা দুগ্ধপলিস্নর পাঁচ শতাধিক খামারি তাদের প্রতিদিনের উৎপাদিত ৪৮ হাজার লিটার দুধ সরবরাহ করতে না পারায় কয়েকদিন আগে দুধ ঢেলে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রতিবাদ জানিয়েছেন। চলমান অবরোধের অর্থনৈতিক ক্ষতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আইসিটি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্ট করা পোস্টে লিখেছেন, ২৮ অক্টোবর থেকে ৬ নভেম্বর বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী ও তাদের সহযোগীরা মোট ৬ দিনের অবরোধ-হরতাল পালন করেছে। শুধু এই ছয় দিনে অর্থনীতির আনুমানিক ক্ষতি ৩ দশমিক ৫ বিলিয়নের বেশি। হরতাল অবরোধে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, দিনমজুর এবং এসএমই খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, সরবরাহ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে- যা ইতোমধ্যে সংকটজনক অর্থনৈতিক সময়ে আমদানিকারক এবং রপ্তানিকারক উভয়কেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে। শিশু ও যুবকদের শিক্ষা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। দীর্ঘদিন লাগামহীন ভোগ্যপণ্যের বাজারে এখন নতুন খড়গ হরতাল-অবরোধের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচি। এ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের শঙ্কা, এ ধরনের রাজনৈতিক সংঘাতপূর্ণ কর্মসূচি দীর্ঘায়িত হলে বাজারে সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি ভোগ্যপণ্যের দাম আরও বাড়বে। টানা অবরোধে অনিশ্চত গন্তব্যের দিকে যাচ্ছে দেশ। নমনীয়তা দেখাচ্ছে না বিরোধী দলগুলো। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবিতে তিন দিনের অবরোধের পর বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, গণতন্ত্র মঞ্চসহ সমমনা দলগুলো রোববার থেকে ফের ৪৮ ঘণ্টার অবরোধের ডাক দিয়েছে। দাবি না মানতে অনড় সরকার। বিরোধীদের ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি ঠেকাতে আওয়ামী লীগ রয়েছে কঠোর অবস্থানে। অবরোধে দূরপালস্নার বাস প্রায় বন্ধ থাকায় জনজীবন অনেকটাই থমকে গেছে। গণ্যবাহী যান চলাচল কমে যাওয়ায় ব্যবসা, কৃষি, শিল্পসহ সব খাতই কমবেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে। সরবরাহ বিঘ্নিত হয়ে দ্রব্যমূল্য আরও ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার যে আভাস পাওয়া যাচ্ছে, তাতে সাধারণ মানুষ আরও চিড়েচ্যাপ্টা হতে পারেন। স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে যাওয়ায় শিক্ষা কার্যক্রমেও বিঘ্ন ঘটেছে। বিশেষ করে নভেম্বর-ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য বার্ষিক পরীক্ষা নিয়ে উদ্বিগ্ন শিক্ষক ও অভিভাবকরা। উপসংহার জাতির পিতার ন্যায় বঙ্গবন্ধুকন্যাও একইভাবে কৃষি অন্তপ্রাণ। তিনিও কৃষিতে বিনিয়োগ বা ভর্তুকি প্রতি বাজেটে বাড়িয়েই চলেছেন। আর জলবায়ু সহায়ক কৃষির বিকাশে তিনি বরাবরই নিবেদিত। প্রেক্ষাপট পরিকল্পনা, বদ্বীপ পরিকল্পনা এবং মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনায় তিনি সবুজ প্রবৃদ্ধি তথা জলবায়ু সহায়ক কৃষির উন্নতির প্রশ্নে খুবই তৎপর। তা ছাড়া আমাদের কৃষক, কৃষি উদ্যোক্তা, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান মিলেই তো মাথাপিছু চালের উৎপাদন ১৯৭৩ সালের ১৪০ থেকে ২০১৮ সালে ২৪০ কেজিতে উন্নীত করেছেন। এই সময়ে মাছের মাথাপিছু উৎপাদন বেড়েছে ১১ থেকে ২৫ কেজিতে। মাংস ৩ থেকে ৪৪ কেজিতে। ডিম ১৫ থেকে ১০১টিতে। দুধ ৬ থেকে ৫৮ কেজিতে। এ সবই সম্ভব হয়েছে সরকারসহ সব অংশীজনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নেওয়া হোমগ্রোন সলিউশনের মাধ্যমে। সহায়ক সরকারি নীতি, মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণকর্মীদের লেগে থাকা, গবেষণা ও উন্নয়ন এবং উদ্ভাবনীমূলক ব্যক্তি খাত মিলেই এই সাফল্য অর্জন করা গেছে। এই সাফল্য বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মন্ডলেও পৌঁছে গেছে। হরতাল-অবরোধের মতো ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি পরিহার করে স্মার্টকৃষির পরিপূর্ণ বিকাশ আমরা দেখতে চাই বর্তমানে এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা। অধ্যাপক ড. মো. মোতাহার হোসেন : পরিচালক, আইকিউএসি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর