শিক্ষার উদ্দেশ্য অর্থ উপার্জন নয়
এই শিক্ষাক্রমের আরেকটি জোরজবরদস্তির দিক হলো বাধ্য করা। আনন্দের কথা বললেও বাস্তবে বেত্রাঘাতের আয়োজন রাখা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের স্বাধীন মননের বিকাশ এখানে মুখ থুবড়ে পড়বে। শিক্ষার্থীদের পছন্দ-অপছন্দের দিক এখানে আমলে নেওয়া হয়নি।
প্রকাশ | ০৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
বাল্যকাল থেকে শিক্ষার সঙ্গে আনন্দ নেই। শিক্ষা আর আনন্দ পাশাপাশি হাত ধরে চলে। আনন্দের অভাব অনুভব করেছেন স্বয়ং বিশ্বনন্দিত কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এছাড়া অসংখ্য প্রবন্ধ ও গল্প লিখে শিক্ষার অসঙ্গতি উন্মোচন করেছেন। নিজস্ব ভাবনা সবার দৃষ্টি আকর্ষিত করতে নিয়মিত শিক্ষা নিয়ে লিখে গেছেন এবং ভাবনার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়ে। রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও শরৎচন্দ্র, নজরুল, বেগম রোকেয়া, মোতাহের হোসেন চৌধুরী'সহ অন্য সব মনীষীরা শিক্ষা নিয়ে ভেবেছেন, সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু কোনো মনীষীই এখন পর্যন্ত শিক্ষার উদ্দেশ্য 'অর্থ উপার্জনের' হাতিয়ার করে দেখেননি। জীবিকা অর্জন আর বিদ্যা অর্জন একই বস্তু নয়। বিদ্যা অর্জন না করেও জীবিকার সন্ধান করা যায়। কিন্তু প্রচলিত সমাজে শিক্ষার উদ্দেশ্যকে ভিন্নখাতে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। মুখে মুখে রটানো হয়েছে- লেখাপড়া করে যে গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে। তোতাপাখির মতন এমন সব আপ্তবাক্য গলাধঃকরণ করতে করতে শৈশব কেটে যায়। হালের গরুর মতো বাধ্যতার আঁচলে বেঁধে বিদ্যালয়ে প্রবেশ করলেও শিশু মনে বিদ্যার আলো তেমন প্রবেশ করে না। যা জ্ঞান অর্জনের পথে শক্তিশালী অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। এমতাবস্থায় যে প্রশ্ন বরংবার উত্থাপিত হওয়ার কথা ছিল সে প্রশ্ন আলোচনার বাইরে চলে যায়। শিক্ষার সত্যিকারের উদ্দেশ্য কী? শিক্ষার উদ্দেশ্য কী 'স্কুলে যাও, চাকরি কর, আদর্শ নাই ইহার বড়।' না-কি শিক্ষার উদ্দেশ্য 'শিখিতে উদ্বুদ্ধ করা।' শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো জীবসত্তার ঘর থেকে মানবসত্তার ঘরে মানুষকে পৌঁছে দেওয়া। ন্যায়-নীতিবোধের ধারণা মানুষের মধ্য তৈরি করা। সহজ কথায়, চিত্তের বিকাশ ঘটানো। প্রতিকূল পরিবেশকে জয় করতে গিয়ে মানুষের অভিজ্ঞতার সারসংকলন জ্ঞান। যুগসঞ্চিত জ্ঞানের সান্নিধ্য লাভ শিক্ষার উদ্দেশ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ফলে শিক্ষার উদ্দেশ্য অর্থ উপার্জন নয়। বারংবার অর্থ উপার্জনের বৃত্তে ঘুরপাক খেতে গিয়ে জন্ম হয়েছে বাজারমুখী শিক্ষা বা কারিগরি শিক্ষা। যা শিক্ষার উদ্দেশ্যের সঙ্গে সম্পূূর্ণ বিরোধাত্মক। বাজারমুখী শিক্ষা বা কারিগরি শিক্ষার দৌরাত্ম্যের ফলে একদল সনদপ্রাপ্ত স্বাক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন মানুষের জন্ম হলেও বুদ্ধি বিবেচনা সম্পন্ন মানুষের অভাব দেখা দিয়েছে। আমলা ও কেরানিকুল বেড়েছে। কমেছে বিবেকসম্পন্ন জ্ঞানী মানুষ। ফলে জনসাধারণের সামনে শিক্ষার উদ্দেশ্যকে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। বাংলাদেশের অভু্যদয়ের ইতিহাস ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস। শাসকশ্রেণি যতবারই শিক্ষা বিষয়ে গণবিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ছাত্র-শিক্ষক সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। জন্ম দিয়েছে '৬২-র শিক্ষা আন্দোলন। মুক্তিযুদ্ধ এবং তার পরবর্তী সময়ে স্বৈরাচারী এরশাদের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধেও ছাত্রদের প্রতিরোধ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় হয়ে আছে। ব্রিটিশ ভারতে শাসকরা চেয়েছে 'একদল মানুষ তৈরি করতে যারা রক্তে মাংসে হবে ভারতীয়। শিক্ষায় ও রুচিতে হবে ব্রিটিশ।' পাকিস্তানিরাও তাই চেয়েছিল। স্বাধীন দেশেও কী তাই হবে? স্বাধীন দেশে বিজ্ঞানভিত্তিক, গণতান্ত্রিক একমুখী শিক্ষার দাবি উত্থাপিত হয়। শিক্ষা সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গিটা হবে কূপমন্ডূক নয়, ইহজাগতিক। সেই আকাঙ্ক্ষায় মোস্তফা-বাবুল-অজিউলস্নাহ জীবন উৎসর্গ করেছে। স্বাধীন দেশে স্বৈরাচারী শিক্ষা পদ্ধতির বিরুদ্ধে লড়াই করে জীবন উৎসর্গ করেছে জাফর-জয়নাল-দিপালী সাহা। এখন প্রশ্ন এসেছে এত জীবন উৎসর্গের পরও কী কাঙ্ক্ষিত শিক্ষা অর্জিত হয়েছে। গত পঞ্চাশ বছরের ইতিহাস শহীদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার ইতিহাস। কুদরতে-খুদা কমিশনের হাত ধরেই শহীদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা শুরু হয়। শিক্ষার পরামর্শক হয়ে ওঠে বিশ্বব্যাংক। তাদের চাপানো শিক্ষার ধারা জোর করে গেলানো হয় শিক্ষার্থীদের। জোর করে গেলানো শিক্ষার ফলে শত-সহস্র শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে। যা এখনো চলমান। আশির দশকে ঘটা করে প্রচার দেওয়া হয়, 'এসো নিজে করি' প্রকল্পের। কোন ধরনের গবেষণা ছাড়াই এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ওঠে পড়ে তৎকালীন শিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ, এসে গেছে নতুন প্রকল্প বহুনির্বাচনি প্রশ্নপত্র। এসো নিজে করি প্রকল্পের সফলতা-ব্যর্থতার যথোপযুক্ত মূল্যায়ন না করেই পরবর্তী প্রকল্পে ঢুকে গেছে। আবার ফলাও করে প্রচার চলল। উদ্বিগ্ন অভিভাবক, তার চেয়ে উদ্বিগ্ন শিক্ষক। শিক্ষার্থীরা ভালো মানুষ হওয়ার পরিবর্তে ভালো রেজাল্ট করার জন্য রাতদিন একাকার করে জীবনযাপন শিক্ষাগ্রহণে লেগে গেল। পরীক্ষা নামক দানব শিক্ষার্থীদের পাশমোড়া করে বেত্রাঘাত করতে থাকল। ফলে পাস করলে ভালো। ভালো পাস করলে আরও ভালো। ফেল করে চিরতরে পরিসংখ্যান হয়ে গেল লাখ লাখ শিক্ষার্থী। বাস্তবে পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল- শিক্ষা ব্যবস্থার, শিক্ষকের। সর্বশেষে শিক্ষার্থীর। শিক্ষা ব্যবস্থার বৃহৎ পরিবারে ছোট সন্তান হিসেবে সবার কানডলার ফলে শিক্ষার্থীদের কান লাল হয়ে গেল। তখনি জমজমাট আসরে বাহারি নামে নতুন প্রকল্প সামনে আসল- সৃজনশীল পদ্ধতি। বুদ্ধিজীবীদের একটা অংশ তার পক্ষে পত্রপত্রিকায় লেখা শুরু করল। এবার সৃজন হবে। কিন্তু কারা করবে সৃজন? শিক্ষকরা এই পদ্ধতি রপ্ত করতে পারছে না। শিক্ষার্থীরা পড়ছে না। পরীক্ষা দরজায় কড়া নাড়ছে। অভিভাবকরা আতঙ্কিত। এই সমস্ত যন্ত্রণার অবসানের বাণী নিয়ে হাজির হলো- কোচিং সেন্টার কিংবা গাইড বই বিতান। যদিও সৃজনশীলের পক্ষে বলতে গিয়ে শিক্ষাবিদরা বলেছে- কোচিং এবং গাইড বইয়ের বাণিজ্য বন্ধ করবে সৃজনশীল পদ্ধতি। বিপরীতে এই পদ্ধতি অভিভাবকদের হুমকি দিল- 'ফেল কড়ি মাখো তেল।' তারপর পরীক্ষার ফলাফলে এগিয়ে যেতে প্রশ্নপত্র ফাঁসের রমরমা আয়োজন চলল বছরের পর বছর। দশক ঘুরতে না ঘুরতে এখন এলো নতুন প্রকল্প। নামকরণটা যথেষ্ট চটকদার 'পাইলট প্রকল্প'। প্রতিবারের ন্যায় এবারও জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২৩ এর গালভরা কথার সম্ভাষণে হৃদয় ভরানোর চেষ্টা করা হয়েছে। শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য এখানেও আড়াল করা হয়েছে। বরং এখানে এমন সব বিষয়কে যুক্ত করেছে- যা শিক্ষার মূল চেতনার সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। অথাৎ কারিগরি শিক্ষার বিষয়বস্তু এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু দেশে নানা ধারায় বিভক্ত শিক্ষাকে এক ধারায় ফেরানোর আলোচনা উবে গিয়ে বলা হচ্ছে- আনন্দময় পরিবেশে পাঠদান করা হবে। তার অংশ হিসেবে শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে। বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের নানা ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। যার ফলে উদ্বিগ্নতা বাড়ছে অভিভাবকদের। এখানে আনন্দের সঙ্গে পাঠদান হবে নাকি তান্ডব নৃত্য হবে। সে বিষয়ে সংশয় রয়ে যায়। শিক্ষার সঙ্গে ক্ষমতাসীন সরকারের শিক্ষাবিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি যেহেতু সরাসরি জড়িত, সেহেতু নানা মহল থেকে সমালোচনা হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের টনক নড়ছে না। ফলে অভিভাবকদের মধ্যে দুশ্চিন্তা ও হতাশা বাড়ছে। জাতীয় শিক্ষাক্রমের-২০২৩ এর বিবেচ্য বিষয় সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা নয়। একদল কারিগরি মানুষ তৈরি করা। যাদের লক্ষ্যই হবে জীবিকার সন্ধান করা। জ্ঞান-বিজ্ঞানের সম্প্রসারণ এখানে গৌণ আলোচ্য বিষয়। এখানে প্রযুক্তি নির্ভরতরাকে প্রাধান্য দিলেও বিজ্ঞান ও গণিত শিক্ষাকে নামমাত্র স্থান দেওয়া হয়েছে। যার ফলে, এখানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে জীবন ও জীবিকা নামক বিষয়। কারিগরি দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে জীবিকার্জন করা যাবে। কিন্তু আবিষ্কারের নেশা থেকে পিছিয়ে পড়বে শিক্ষার্থীরা। কারিগরি শিক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়ার ফলে পারস্পরিক প্রতিযোগিতা বেড়ে যাবে। যা ছাত্রদের বিচ্ছিন্ন করবে দেশ ও সমাজ থেকে। 'আপনি বাঁচলে বাপের নাম'- এই মনোভাব বেড়ে যাবে। কম সময়ে দক্ষ জনশক্তি গড়তে 'কম্পিটেন্সি বেইজড' শিক্ষার ধারণা এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২৩ সে চিন্তা থেকেই প্রণয়ন করা হয়েছে। গত দশকে কেনিয়া, জাম্বিয়া, তানজেনিয়ায় এই ধারণার শিক্ষা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। প্রকল্প সহযোগী ইউনেসকো। সেখানেও জনসাধারণের বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছে। হাতেকলমে শেখানোর প্রজেক্ট হিসেবে এই পদ্ধতির কথা বলা হলেও বাস্তবে ক্লাসরুম সম্প্রসারণ, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত হ্রাস করার কোনো কথাই এই শিক্ষাক্রমে আলোচিত হয়নি। এই পদ্ধতিতে শিক্ষকের হাতে শিক্ষার্থী মূল্যায়নের সব ক্ষমতা থাকায় পক্ষপাতিত্বের সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। শিক্ষকদের বেতন কাঠামোর পরিবর্তন এবং সামাজিক মর্যাদা না বাড়ালে কোচিং বা ব্যক্তিগত টিউশন বন্ধ হবে না। ফলে পূর্বের মতন শিক্ষকরা স্ব-কোচিংয়ের শিক্ষার্থীদের সুবিধা বৃদ্ধিতে মনযোগী হবে- যা শিক্ষার্থীদের যথোপযুক্ত মূল্যায়ন বঞ্চিত করবে। এই শিক্ষাক্রমের আরেকটি জোরজবরদস্তির দিক হলো বাধ্য করা। আনন্দের কথা বললেও বাস্তবে বেত্রাঘাতের আয়োজন রাখা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের স্বাধীন মননের বিকাশ এখানে মুখ থুবড়ে পড়বে। শিক্ষার্থীদের পছন্দ-অপছন্দের দিক এখানে আমলে নেওয়া হয়নি। ফলে মেধা ও আগ্রহের বিভিন্নতা থাকলেও সবাইকে একই ধরনে পাঠ্যপুস্তকে বা পদ্ধতিতে মনোনিবেশ করতে হবে- যা প্রতিভাকে ধ্বংসের সূক্ষ্ণ আয়োজন। এছাড়া বিজ্ঞানমনস্ক করার জন্য বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসার না বাড়িয়ে নৈতিকতা নামক পুস্তক অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। জীবন এবং মনন সমৃদ্ধ এবং যুক্তিবাদী না হলে নৈতিক বোধ গড়ে ওঠা মরুভূমিতে ফুল ফোটানোর মতোই দুর্লভ। পরিশেষে, সামগ্রিক বিবেচনায় এই শিক্ষাক্রমে জাতীয় বিকাশের রাস্তা সম্প্রসারিত না হয়ে প্রকল্পের অর্থ ব্যয়ে আমলা ও মন্ত্রীদের বিদেশ ভ্রমণ, মিটিংয়ের নামে সিটিং মানির চমৎকার ব্যবস্থা হয়েছে- যা জাতি গঠনের শক্তিশালী ভিত্তি না হয়ে অনিশ্চিত, খুপরিবদ্ধ প্রজন্ম তৈরির পথের পাথেয় হবে। কাজেই প্রকল্পনির্ভর শিক্ষা কার্যক্রম বাতিল করা সময়ের দাবি। \হ রিয়াজ মাহমুদ : কবি ও প্রাবন্ধিক