যে জন্মের মৃতু্য নেই

বাঙালির কাছে বঙ্গবন্ধুর নাম অক্ষয় ও অমর হয়ে থাকবে। স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে তার কীর্তিময় জীবনালেখ্য। তাকে শ্রদ্ধা ভরে কেবল স্মরণই নয়, তার আদর্শকে বুকে ধারণ করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।

প্রকাশ | ২২ মার্চ ২০১৯, ০০:০০

ডা. এস এ মালেক
জন্ম হলে মৃতু্য অনিবার্য। জীব মাত্রই মৃতু্যর আস্বাদ গ্রহণ করবে। এটাই দুনিয়ার চিরন্তন বিধান। বঙ্গবন্ধু জন্মেছিলেন তাই তাকে মৃতু্যবরণ করতে হয়েছে। তবে যে ধরনের মৃতু্য তিনি বরণ করেছিলেন, তা ছিল অস্বাভাবিক ও হৃদয় বিদারক। বেঁচে থাকলে এক সৌভাগ্যশালী বাংলাদেশকে হয়তো তিনি উপহার দিতেন। যে বাংলাদেশের জনগণ নিরাপদে, সুখে-শান্তিতে বসবাস করতেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তার মৃতু্য হয়েছে ঘাতকের বুলেটে। বুলেট বিদীর্ণ করেছে সেই পবিত্র দেহকে। পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম ও জঘন্য হৃদয়বিদারক হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছিল ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে। একবার ভেবে দেখুন তো সিঁড়ি বেয়ে উঠেছে ঘাতকের দল, হাতে মারণাস্ত্র, উপরে তাকাতে পারছে না, সেই মহান ব্যক্তির দিকে, যাকে তারা হত্যা করতে উদ্যত। ভাবতে বিস্মিত হতে হয়, কী করে বাঙালিরা তাদের জাতির জনককে এমন নৃশংসভাবে হত্যা করল। যার অফুরন্ত ভালোবাসায় বাংলার মাটি, জল, আকাশ, বাতাস সিক্ত হয়েছিল। ভালোবাসার টানে যিনি নিবিড়ভাবে আসক্ত বাঙালি, বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষা ছাড়া যিনি কিছুই বুঝেন না। সাক্ষাৎ বাঙালিত্বকে ওরা হত্যা করল। ওরা কি একবারও ভেবে দেখেনি, কাকে ওরা হত্যা করতে যাচ্ছে? যে দেশে ওরা বসবাস করবে সেই দেশটিকে তো ওরা হত্যা করল। যে জাতিসত্তায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে ওরা জীবনযাপন করবে; সেই জাতিসত্তাকে ওরা হত্যা করল। তিনি স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতীক; তাকে কি কখনো হত্যা করা যায়? তাই ঘাতকরা ছিল বোধশক্তিহীন মানবরূপী দানব ছাড়া আর কিছু নয়। নরঘাতকরা সেই দিন দেশের অফুরন্ত ক্ষতি করল। বঙ্গবন্ধুর জন্ম হয়েছিল টুঙ্গিপাড়ায় ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ এক সম্ভ্রান্তত্ম মুসলিম শেখ পরিবারে, শেখ লুৎফর রহমানের ঘরে। প্রাচুর্য নিয়ে জন্মেছিলেন এ কথা বলা যাবে না। তবে অভাবগ্রস্ত ছিলেন না। দান-খয়রাত দেয়ার মতো পারিবারিক সামর্থ্য ছিল। ক্লাসের সহপাঠীর বই নেই, ছাতা নেই, কলম নেই, নেই ভালো একটা পোশাক, ছাত্র বন্ধুদের এরূপ অভাব তিনি অহরহ পূরণ করতেন। নাম তার খোকা, সবাই আদর করে ওই নামে ডাকতো। ওই খোকা যে একদিন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক হবেন, বঙ্গবন্ধু হবেন, বাংলাদেশের জনগণের মুক্তির জন্য জীবন উৎসর্গ করবেন, বিশ্বের নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়াবেন, সাম্রাজ্যবাদের একমাত্র শত্রম্ন হিসেবে চিহ্নিত হবেন, এটা কি কেউ কোনোদিন ভেবেছিল। ৭ কোটি মানুষকে স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দেয়ার পরও সেই মানুষের হাতেই তার জীবন যাবে; তা কি কেউ কল্পনা করেছে। এই বাংলার অমন একদিন ছিল শেখ মুজিবের নির্দেশেই চলত এ দেশের রাষ্ট্রযন্ত্র। তিনি যা বলেছেন জনগণ তাই শুনেছেন এবং তার নির্দেশমতো কাজ করেছেন। ঐতিহাসিক ৬ দফা ছিল বংশীবাদকের বাঁশী। বাদক যা বলেছেন- অনুসারীরা তাই করেছেন। তা না হলে কী করে টেকনাফ থেকে তেতুঁলিয়া ৭ কোটি বাঙালি গর্জে উঠলো- জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বলে। বঙ্গবন্ধুকে বিজয়ী করেই ছাড়লো তারা। ওই বিজয়ের ফসলেই তো আজকের বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশে, মুজিবের স্বাধীন করা বাংলাদেশে মাত্র সাড়ে ৩ বছর তিনি দেশ শাসন করার সুযোগ পেলেন। বিশ্ববাসীরা বলে বাঙালি বিশ্বাসঘাতক জাতি। তা না হলে কী করে তারা জাতির জনককে হত্যা করার সাহস পায়। আমি বলি আসুন, দেখে যান- দশ, বিশ, পঞ্চাশ, একশ' বছর পরে আসুন কান পেতে শুনুন, এই বাংলার ইথারে ভাসছে- জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু জয়ধ্বনি। বজ্রকণ্ঠ, অগ্নিঝরা বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ সাক্ষাৎ করেন গ্রাম-বাংলার ১০০ বছর বয়সী বৃদ্ধদের সঙ্গে শেখ মুজিব সম্পর্কে দেখবেন আবেগপ্রবণ আর রুদ্ধকণ্ঠে বলছে- এমন মানুষ আর কখনো আসবে না। বড় ভালো মানুষ ছিলেন তিনি। শেখ মুজিবের কথা শুনে চোখ অশ্রম্নসজল হয়েছে। বাককণ্ঠ রুদ্ধ হয়েছে। এই সব কিছু মুজিবের প্রাণঢালা ভালোবাসার কারণে। তিনি বলেছেন, আমি বাংলার মানুষকে ভালোবাসি, এটাই আমার গুণ। আর আমার দোষ হচ্ছে, আমি তাদের খুব বেশি ভালোবাসি। বিদেশি একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধু সেদিন মনের অনুভূতি এভাবেই ব্যক্ত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর কিশোর জীবন কেটেছে গোপালগঞ্জে। খেলাধূলা-রাজনীতি ও সমাজসেবার মাধ্যমে। যৌবন কেটেছে কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে লেখাপড়া করে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শের-এ-বাংলা এ কে এম ফজলুল হক, মজলুম জননেতা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, দেশবন্ধুসহ অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তিদের সংস্পর্শে। রবীন্দ্র ও নজরুল ভক্ত বাংলার নেতা, বাঙালির নেতা ছিলেন অত্যন্ত সংস্কৃতিমনা। নজরুলের কবিতা ও রবীন্দ্রনাথের গান শুনতে তিনি খুব ভালোবাসতেন। ওরে যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে। এই একলা চলার নীতি অভ্যাস করেছেন ব্যক্তিজীবনে। বলো বীর, বলো উন্নত মমশির। এই উন্নত শিরেই চলেছেন বাঙালির মহান নেতা। সত্য ও সুন্দরের আশ্রয় নিয়ে আন্দোলন করেছেন। বিদ্রোহ করেছেন, মুক্ত করেছেন চিরদিনের জন্য ৭ কোটি বাঙালিকে। তাই মুজিব মানে ভালোবাসা, মুজিব মানে অসীম সাহসিকতা, মুজিব মানেই দৃঢ় সংকল্প, মুজিব মানেই জলন্ত আগুনে ঝাঁপ দেয়ার মতো সাহস, মুজিব মানেই বিদ্রোহ, বিপস্নব, মুজিব মানেই বিপস্নব, স্বাধীন জাতিসত্তা, বাঙালির আত্মপরিচয়ের ঠিকানা। বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু শব্দ দুটি তাই সমার্থক। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পতনের পর ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি পৃথক রাষ্ট্রের সৃষ্টি হলেও ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই জাতিগত বৈষম্য ও ধর্মান্ধবাদ এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রভৃতি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের বিনষ্ট করে মারাত্মকভাবে। মুজিব বললেন, এসব কোনকিছুই গ্রহণযোগ্য নয়। প্রেম-স্নেহ, ভালোবাসা, পারস্পরিক সহমর্মিতা, সহাবস্থান, সহনশীলতা, এটাই তো বাঙালির স্বভাবসুলভ আচরণ। আবেদন জানালেন, আসুন আমরা খাঁটি বাঙালি হই। দীপ্ত হই বাঙালিত্বের গুণে আর তা বাস্তবায়ন করতে হলে পরাধীন বাঙালি দিয়ে সম্ভব নয়। স্বাধীন করতে হবে বাংলাদেশ। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র বিলুপ্ত করে, গড়তে চাইলেন জাতি রাষ্ট্র। ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিভিত্তিক, বাঙালিত্বভিত্তিক তার চিন্তার ফসল অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। বাঙালি কী মুজিবকে ভুলে গেছে? তা না হলে কী করে আজও মুজিবের বাংলায় সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প বিষাক্ত করেছে বাংলার আকাশ-বাতাস। মহান স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরেও কিন্তু এখনো নির্বাচনকালে সুযোগ পেলেই আক্রান্ত হয় এ দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। ওরা কি বাঙালি নয়, স্বদেশের মাটিতে কেন তাদের সঙ্গে এরূপ আচরণ। কেন সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ওদের আপন করে নিতে পারেননি। ইসলাম তো কখনো এ কথা বলেনি, ওদের জন্য স্বতন্ত্র সৃষ্টিকর্তা আছে। আছে পৃথক জল-বায়ু, আলো-বাতাস। ওদের রক্ত কণিকাগুলি কি লাল নয়? ওরা কি বাংলায় কথা বলে না। বাঙালির মতো ভালোবাসতে জানে না। বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখতেন- হিন্দু-মুসলমান- বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সব সম্প্রদায়ের মানুষের মিলনমেলা হবে এই বাংলায়। বাঙালি এখনো সংগঠিত করে চলেছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা। দেশ বিভক্ত হয়েছিল কিন্তু হৃদয় তো বিভক্ত হয়নি। ভালোবাসার স্রোত কখনো তো টান পড়েনি। কত বাঙালি যুবক ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রেম-প্রীতি অভ্যাস করে, সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে ওঠে করেছে সুসংহত-শান্তিময় জীবনযাপন। বাঙালি-বাঙালি করে যিনি সারাজীবন কাঁদলেন, বাঙালির জয়গান গেয়ে গেলেন, বাঙালির কারণে জীবন উৎসর্গ করলেন, সেই বাংলাদেশে কেন বাঙালিরা বারবার ঘুরে দাঁড়াতে ও অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। টুঙ্গিপাড়ায় শুয়ে আছেন ওই মহান বাঙালি- যাকে বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধু বলে জানতো। বঙ্গবন্ধু যখন জাতির পিতা হলেন সশ্রদ্ধ সালাম জানাতো। আজও তাই সমাধিতে শত সহস্র মানুষের আগমণ ঘটে। যে ভালোবাসায় তিনি আবদ্ধ করছেন বাঙালিকে, সমাধিতে আসে কৃতজ্ঞতা ভরে কিছুটা শোধিতে ঋণ। যেদিন বঙ্গবন্ধু টুঙ্গিপাড়ায় জন্মেছিলেন সেদিন এই গ্রামগুলো ছিল অত্যন্ত সহজ-সরল, সাদা-মাটা গ্রাম। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে কয়েকটা টিনের ঘর আর একটা পুরনো দেয়াল ঘেরা দালান ছিল। এই নিভৃত পলস্নীতে। আজ সেই টুঙ্গিপাড়ায় সৃষ্টি হয়েছে বাঙালির হৃদয়ের রাজধানী। ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু নেই সেখানে। শুয়ে আছেন মহান নেতা পবিত্র বাংলার মাটির স্পর্শে। কোনোদিন ওই মরদেহ আসবে না সজীব হয়ে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অবয়ব আজও ওই ঘরে ভাসে। যাদের প্রাণ আছে, অনুভূতি আছে, তারা দেখতে পায়। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। মুজিব প্রদত্ত সেই স্বাধীনতা আজ আমাদের কাছে খুবই প্রিয়। তারই কন্যা আজ স্বাধীনতা সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন। কাজ করে যাচ্ছেন নিরন্তর। একটি মাত্র স্বপ্ন-সাধনা তার, নিরন্ন ও দুঃখী বাঙালিকে সর্বপ্রকার শোষণ ও বঞ্চনার হাত থেকে মুক্ত করা। বাংলাদেশকে দাঁড় করানো বিশ্বের অন্যতম উন্নত এক দেশে, যাতে মাথা উঁচু করে বাঙালি বলতে পারে- জয় বাংলা, বঙ্গবন্ধুর জয়। জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরেই আজ বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণের কাজ দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে। বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছা পূরণ হতে চলেছে। সেই দিন আর বেশি দূরে নয়, বঙ্গবন্ধু যে ধরনের বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে চেয়েছিলেন তার বাস্তবায়নের। বাঙালির কাছে বঙ্গবন্ধুর নাম অক্ষয় ও অমর হয়ে থাকবে। স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে তার কীর্তিময় জীবনালেখ্য। তাকে শ্রদ্ধা ভরে কেবল স্মরণই নয়, তার আদর্শকে বুকে ধারণ করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। \হ১৯৯৬ সাল থেকে ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন বাঙালি জাতির জন্য আর্শীবাদের একদিন, বড় আনন্দের একটি দিন। ২০২০ সালে দেশব্যাপী পালিত হবে বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী। এ ব্যাপারে জাতীয় কমিটিও হয়েছে। প্রখ্যাত সাহিত্যিক অন্নদা শঙ্কর রায় বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন- যতকাল রবে পদ্মা, মেঘনা, গৌরি, যমুনা বহমান, ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান। ডা. এস এ মালেক: রাজনীতিক ও কলাম লেখক