শান্তির দেশে অশান্তি কেন

পৃথিবীর দেশগুলো তখনই শান্তির দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে যখন প্রতিটি নাগরিকের প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সমতা, সুষম বণ্টন, সাম্য, নায্যতা থাকবে। অসাম্প্রদায়িক শোষণহীন রাষ্ট্রীয় কাঠামো ছাড়া শান্তির দেশ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।

প্রকাশ | ২৭ মার্চ ২০১৯, ০০:০০

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
পৃথিবীতে শান্তির দেশ হিসেবে যে দেশগুলোকে অভিহিত করা হয়, তার মধ্যে নিউজিল্যান্ড অন্যতম। ওশানিয়া অঞ্চল হিসেবে খ্যাত অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড দেশ তিনটিতে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড নেই বললেই চলে। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া মহাদেশটিকে শান্তির মহাদেশ বলা যায়। সাগর বক্ষে জেগে ওঠা দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো নিয়ে গঠিত এই ওশানিয়া অঞ্চল। ভূপ্রকৃতি এবং আবহাওয়াগত বিষয়টা ওশানিয়া অঞ্চলের বেশ অনেকটা নাতিশীতোষ্ণ। এই অঞ্চলের শহরগুলো পরিপাট্য এবং দূষণমুক্ত এবং শান্তির। তাই কথিত তৃতীয় বিশ্বের ধনীরা তাদের বৈধ এবং অবৈধ আয়ের বিপুল অঙ্কের টাকা জমা রাখে এই সব দেশগুলোর ব্যাংকে, বিশেষ করে সুইজ ব্যাংক তার অন্যতম। বিদেশিদের পাচার হওয়া অর্থে এই অঞ্চলের সুইজ ব্যাংকগুলোর অর্থনীতির গতিপ্রবাহ বাড়ায়। এই অঞ্চলের শান্তি এবং অর্থনীতির সমৃদ্ধির নেপথ্যে এশিয়া এবং আফ্রিকার দেশগুলো থেকে পাচার হওয়া অর্থ বড় নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে। এশিয়া এবং আফ্রিকার দেশগুলোকে তৃতীয় বিশ্ব বলা হয় দরিদ্রতার কারণে। এই দরিদ্র দেশগুলোতে ধনী হওয়ার জন্য চলে এক ধরনের অসম প্রতিযোগিতা। আর এই প্রতিযোগিতার কারণে জন্ম নেয় নানা ধরনের দুর্নীতি; এবং অনৈতিক কার্যকলাপ তাই দেখা দেয় অর্থনৈতিক বৈষম্য। অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বৈষম্যের কারণে নানা ধরনের অশান্তির সৃষ্টি হয় এশিয়া এবং আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশে। এই দেশগুলোতে দেখা দেয় সন্ত্রাসসহ নানা ধরনের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি ফ্যাসাদ। আফ্রিকা এবং এশিয়ার এই দেশগুলোতে এ ধরনের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে কথিত উন্নত বিশ্ব নেপথ্য কারিগর হিসেবে কাজ করে। এই দুটি মহাদেশের একটি গোষ্ঠী অশান্তি ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে অবৈধভাবে। এই গোষ্ঠীরা শেষজীবনে বিলাসবহুল জীবনযাপনের লক্ষ্যে টাকা পাচার করে থাকে সুইস ব্যাংকে। এশিয়া এবং আফ্রিকার দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী এবং শাসকশ্রেণির একটি বড় অংশ তাদের লুটপাটের টাকা সুইস ব্যাংকে জমা রাখে। এই দুই মহাদেশের দুর্নীতির অর্থেই স্ফিত হয় কথিত শান্তির দেশের অর্থনীতির কাঠামো। এশিয়ায় এবং আফ্রিকার দেশগুলোতে অশান্তিময় হয়ে থাকার পেছনের কারণ হলো- বর্ণবাদ, সাম্প্রদায়িকতাসহ কিছু সামাজিক অনিয়ম এই অনিয়মগুলোকে কেন্দ্র করে দাঙ্গা-ফ্যাসাদ যুদ্ধ-বিগ্রহের সৃষ্টি হয়। দুই মহাদেশের অশান্তির জন্য দারিদ্র্য জনগোষ্ঠী মানুষ দায়ী নয়। শাসকশ্রেণি নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য এ ধরনের একটি পরিস্থিতি তারা তৈরি করে রাখে। শাসকশ্রেণির সৃষ্ট পরিমন্ডলের খপ্পরে পড়ে প্রাণ হারায় নিরীহ দরিদ্র মানুষ। পৃথিবীতে যে সব অঞ্চলে এ পর্যন্ত ধর্মকে কেন্দ্র করে যুদ্ধ, দাঙ্গা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি হয়েছে তার পেছনে রয়েছে শাসকশ্রেণির কায়েমী স্বার্থ। পৃথিবীব্যাপী লক্ষ্য করলে দেখা যায়, শাসকশ্রেণি যদি নিজেদের কায়েমী স্বার্থ দ্বিধাহীন বা বাধাহীনভাবে অর্জন করতে পারে তাহলে সেই সব দেশগুলোতে অশান্তি সৃষ্টি হয় না। বিশেষ করে ওশানিয়া অঞ্চলে শাসকশ্রেণি নিজেদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলি অর্জনে তেমন একটা বাধার মুখে পড়েনি আগে কখনো। কারণ এই বাধাটা ভবিষ্যতে আসতে পারে জেনেই ওশানিয়া অঞ্চলের শাসকশ্রেণি আঁতুড় ঘরেই তা নিধন করে ফেলে। নিউজিল্যান্ডের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রায় ৭০০ বছর আগে পলিনেশীয় জাতিরা নিউজিল্যান্ড আবিষ্কার করে। পলিনেশীয় জাতিগোষ্ঠীর মানুষই নিউজিল্যান্ডকে আবাদী করে গড়ে তোলে। পলিনেশীয় জাতির বসতি স্থাপন এবং তাদের জীবনধারায় এই দেশটিতে মাওরি সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। নিউজিল্যান্ড হয়ে ওঠে পলিনেশীয় জাতির মাওরি সংস্কৃতির দেশ। ১৬৪২ সালে ইউরোপীয় অভিযাত্রী ওলন্দাজ আবেল তাসমান নিউজিল্যান্ডে নোঙর ফেলেন। ওই সময় থেকেই বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের নিউজিল্যান্ডে যাতায়াত শুরু হয়। ১৮০০ শতাব্দীর শেষ দিকে অভিযাত্রী, মিশনারী, পর্যটক, বণিক নিয়মিত আসতে থাকে নিউজিল্যান্ডে। সারা বিশ্বে সেই সময় ব্রিটিশ নৌশক্তি ছিল প্রবল পরাক্রমশালী। এই সময় ব্রিটিশরাই নিউজিল্যান্ডে যায়। ১৮৪০ সালের শেষ দিকে মাওরি জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তখন থেকে নিউজিল্যান্ড ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত দেশ হিসেবে পরিগণিত হয়। যদিও নিউজিল্যান্ড এখন একটি স্বাধীন দেশ তবে দেশটি ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত নাগরিক দ্বারা শাসিত। কারণ নিউজিল্যান্ডে এখন ব্রিটিশ বংশোদ্ভূতরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। ১৮৪০ সালে চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে মাওরি জাতিগোষ্ঠীর মানুষ সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়। যদিও আক্ষরিকার্থে মাওরিদের ব্রিটিশদের সমমর্যাদা দেয়ার কথা চুক্তিতে উলেস্নখ থাকে। মাওরিদের সমমর্যাদার বিষয়টি ব্রিটিশরা যথার্থভাবে পালন করেনি। ব্রিটিশদের সঙ্গে চুক্তির পর মাওরিরা জমিজমা হারাতে শুরু করে এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়। অন্যদিকে নিউজিল্যন্ডের সব ভূমির মালিক হয়ে যায় ব্রিটিশরা তারা ভূমিগুলো দখল করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। আর মাওরিরা নিউজিল্যান্ডের আদিবাসী যারা এই এলাকাকে আবাদী করে গড়ে তোলে তারা কমতে থাকে দিন দিন, এক সময় এসে মাওরি জনগোষ্ঠী হয়ে যায় সংখ্যালঘু, অথচ এই মাওরিরা এই অঞ্চলকে আবাদযোগ্য করে গড়ে তুলেছিল নিজেদের বংশধরদের জন্য। বর্তমানে নিউজিল্যান্ডের পুরো আধিপত্য ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত নাগরিকদের হাতে। সাম্প্রতিক কালের একটি পরিসংখ্যন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দেশটির মোট জনসংখ্যার শতকরা ৭৮ ভাগ হলো ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত নাগরিক, মাত্র শতকরা ১৪.৬ ভাগ হলো আধিবাসী মাওরি, এশিয়ান বংশোদ্ভূতদের সংখ্যা শতকরা ৬.৯ শতাংশ। ভাষা এবং সংস্কৃতির বিষয়টি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নিউজিল্যান্ডের পুরো আদিবাসী মাওরি ভাষাটি ক্ষয়িষ্ণুর পথে। শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষের ভাষা হলো ইংরেজি, মাত্র ৪.২ ভাগ মানুষ এখন মাওরি ভাষায় কথা বলে। আর আদি ভাষা যে ভাষাটি অনেক পুরনো বলে জানা যায়, তাহলো নিউজিল্যান্ড সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ, সেই ভাষায় কথা বলে মাত্র .০৮ শতাংশ মানুষ। নিউজিল্যান্ড সরকার পদ্ধতি পালামেন্টারি, তবে প্রতীকী রানী এখনো ব্রিটেনের রানীকে মানা হয়। রাষ্ট্রটির গভর্নর জেনারেল রাষ্ট্রপ্রধান তবে রাষ্ট্রের সব নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর কাছে। নিউজিল্যান্ড শান্তির দেশ হিসেবে পরিচিত, এখানে অস্ত্র (স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, পিস্তল, রিভলবার) উন্মুক্তভাবে কেনাবেচা হয়। প্রশ্ন হলো- শান্তির দেশে জনগণের কেন নিজের কাছে অস্ত্র রাখার দরকার হয়? বাংলাদেশে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, ব্যবসায়ী বা বিশেষ কোনো পদমর্যাদার ব্যক্তি নিজেদের নিরাপত্তার জন্য সাধারণত অস্ত্র রাখেন। বাংলাদেশে কোনো ব্যক্তির অস্ত্র রাখার বিষয়টি নিজের নিরাপত্তার ওপর নির্ভর করে। কোনো ব্যক্তির এ রকম নিরাপত্তার প্রয়োজন দেখা দিলে তিনি সরকারকে জানান। তখন সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই ব্যক্তির প্রয়োজনীয়তা পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষ অস্ত্র রাখার অনুমোদন দেন। আর এই অনুমোদন প্রাপ্তির পর সরকারি লাইসেন্স নিয়ে অস্ত্র রাখতে হয়। নিউজিল্যান্ড এত শান্তির দেশ সবার কাছে অস্ত্র রাখার প্রয়োজনটা কি? নিউজিল্যান্ডের নাগরিকদের অস্ত্র রাখার বিষয়টি সম্পর্কে যতদূর বোঝা যায় তা হলো- নাগরিকদের নিজের কাছে অস্ত্র রাখা দেশটির একটি পুরনো প্রথা। ব্রিটিশরা নিউজিল্যান্ডে আসার পর ব্রিটিশ বংশোদ্ভূতরা নিজেদের কাছে অস্ত্র রাখতো তারা আদিবাসী মাওরিদের প্রতিপক্ষ ভাবতে। সেই প্রক্রিয়ায়ই এখনো ব্রিটিশ বংশোদ্ভূতরা অস্ত্র সহজেই কেনা-বেচা করে থাকে নিউজিল্যান্ডে। জুমার মসজিদে ঘটে যাওয়া ঘটনার পর নিউজিল্যান্ডের কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। কারণ মাওরিরা ক্ষয়িষ্ণু পর্যায়ে চলে গেছে তাদের পক্ষে আর ব্রিটিশ বংশোদ্ভূতদের বিরুদ্ধে কিছু করা সম্ভব না। সুতরাং নাগরিকদের কাছে অস্ত্র রাখার আর প্রয়োজন নেই। ১৯ শতাব্দীতে সারা বিশ্বে যখন সমাজতন্ত্রের আন্দোলন গড়ে ওঠে তখন নিউজিল্যান্ড তার রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী ব্যবস্থারও খোলস পাল্টায়। পুঁজিবাদকে স্থায়ী রূপ দিতে ১৯৩০ সালে কল্যাণমুখী রাষ্ট্র হিসেবে নিউজিল্যান্ড যাত্রা শুরু করে। কল্যাণমুখি রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে মাওরি আদিবাসীদের সংস্কৃতিসহ নানা ধারা পরিবর্তন ঘটে। পুরো দেশের কৃষ্টি কালচার ব্রিটিশ আদলে হয়ে যায়। কিন্তু ১৮৪০ সাল থেকে ব্রিটিশরা যেভাবে অস্ত্র নিয়ে খোলামেলা চলাফেরা করত সেই ধারাটি অব্যাহত থাকে। আর এই অব্যাহত ধারার ফল জুমার নামাজে গুলি। একটা সময় বিশ্বের বিশাল অঞ্চল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল, কোনো কোনো অঞ্চলে ব্রিটিশরা নিজেরাই স্থায়ী নাগরিক হিসেবে বসবাস শুরু করে। এ রকম অঞ্চলের মধ্যে ওশানিয়া এবং উত্তর আমেরিকা অন্যতম। ওই সব অঞ্চলের ভূমি ব্রিটিশরা নিজেদের ভূমি হিসেবেই দখল করে নেয় এবং নিজেদের স্থায়ী বসতি গড়ে তোলে। এশিয়ার অঞ্চলগুলো ব্রিটিশরা ছেড়ে যেতে বাধ্য হয় তাই এখানে তাদের স্থায়ী বসতি গড়ে ওঠেনি। তবে ব্রিটিশরা স্থানীয়দের সমমর্যাদা দেয়নি কখনো তাদের শাসনামলে। ব্রিটিশরা স্থানীয়দের ন্যাটিভ হিসেবে চিহ্নিত করে। ব্রিটিশ শাসনামলে তারা স্থানীয়দের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক ভাবত। যে ঘাতক জুমার নামাজে গুলি বর্ষণ করল তার ভাষ্য নিউজিল্যান্ডে এখন অভিবাসীদের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। এখানে প্রশ্ন হলো- তিনি কে, তারা পূর্বপুরুষও তো নিউজিল্যান্ডে গিয়ে বসতি স্থাপন করেছে, তিনিও তো নিউজিল্যান্ডের আদিবাসী নন। সুতরাং আদি ইতিহাসটা পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। সারা পৃথিবীতে ধর্মের নামে যে সব লোমহর্ষক হত্যাযজ্ঞ চালানো হচ্ছে তার নেপথ্যে রয়েছে রাজনৈতিক কারণ। কায়েমী স্বার্থ হাসিলের জন্য ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করা হয় বর্তমান সময়ে ব্যাপকভাবে। তাই সারা দুনিয়ায় রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। তা না হলে কথিত শান্তির দেশগুলোও অশান্তির আগার হিসেবে চিহ্নিত হবে। পৃথিবীর দেশগুলো তখনই শান্তির দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে যখন প্রতিটি নাগরিকের প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সমতা, সুষম বণ্টন, সাম্য, নায্যতা থাকবে। অসাম্প্রদায়িক শোষণহীন রাষ্ট্রীয় কাঠামো ছাড়া শান্তির দেশ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : কলাম লেখক