নির্বাচনে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের আন্তরিকতা

ভোট গ্রহণের দিন সকাল ৮টায় ব্যালট বাক্স নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে কেন্দ্রে এসেছে; ব্যালট ছিনতায়ের কোনো ঘটনা ঘটতে পারেনি। সর্বোপরি নির্বাচন কমিশন ও সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় একটি নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন সম্ভবপর হয়েছে।

প্রকাশ | ১৮ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

মো. সাখাওয়াত হোসেন
ভোটের হার ৪১.৮ শতাংশ, সন্দেহ হলে চ্যালেঞ্জ করতে বললেন সিইসি। 'আমাদের অসততা যদি মনে করেন, তাহলে সেটাকে আপনারা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন,' বলেন তিনি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারাদেশে মোট ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট পড়ার তথ্য দিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, কারো সন্দেহ থাকলে তিনি 'চ্যালেঞ্জ' জানাতে পারেন। বিশেষত, নির্বাচন নিয়ে যাদের মাথাব্যথা, ভোটার উপস্থিতি নিয়ে যাদের সন্দেহ তারা ইচ্ছে করলে কাগজে কলমে কমিশনকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন। কমিশনের কার্যক্রমে নির্বাচন ইসু্যতে কমিশন শতভাগ সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করেছে, নিরপেক্ষতা বজায় রেখেছে বলেই কমিশন প্রকাশ্যে এ ধরনের চ্যালেঞ্জ জানাতে পেরেছে। কমিশনও অবগত, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে গভীর ষড়যন্ত্র হচ্ছে, সঙ্গত কারণেই নির্বাচনকে নিয়ে কোনো কারণ ব্যতিরেকে প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাওয়ার ব্রতে অগ্রসরমাণ; সে কারণেই শকুনের চোখ পড়েছে বাংলাদেশের ওপর। কোনোভাবেই যেন নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে না পারে সেসব দিক বিবেচনায় নিয়েই কমিশন তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচন আয়োজনে নজিরবিহীন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সরকারও শুরু থেকেই বুঝতে পেয়েছে, বিদেশিরা যেভাবে অযাচিত উপায়ে একটি রাষ্ট্রের নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে হস্তক্ষেপ করার অভিলাশ পেয়েছেন সেখানে দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের মদত দিচ্ছে এবং দেশীয় কুটচক্রগোষ্ঠী একজোট হয়ে নির্বাচনের বিরুদ্ধে কাজ করবে। এটিও সরকার অবগত, বৈশ্বিক রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে স্বাভাবিকভাবে অনেকেই মেনে নিতে পারেনি। তারা শত্রম্নতা করছে বাংলাদেশের, কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের কতিপয় রাজনৈতিক দল ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। এদের চরিত্র এমন বাংলাদেশের ক্ষতি হলেও তাদের কোনো সমস্যা নেই; তাদের দরকার যে কোনো উপায়ে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করা। সব দিক বিবেচনায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে আয়োজনে যথেষ্ট প্রতিকূলতাকে মাড়িয়ে যেতে হয়েছে রাষ্ট্রকে। তথাপি রাষ্ট্র চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছে। প্রথম সংসদ, দ্বিতীয় সংসদ, তৃতীয় সংসদ, চতুর্থ সংসদ, পঞ্চম সংসদ, ষষ্ঠ সংসদ, সপ্তম সংসদ, অষ্টম সংসদ, নবম সংসদ, দশম সংসদ, একাদশ সংসদ, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন যথাক্রমে ৭ মার্চ, ১৯৭৩, ২৮ ফেব্রম্নয়ারি, ১৯৭৯, ৭ মে, ১৯৮৬, ৩ মার্চ, ১৯৮৮, ২৭ ফেব্রম্নয়ারি ১৯৯১, ১৫ ফেব্রম্নয়ারি, ১৯৯৬, ১২ জুন, ১৯৯৬, ১ অক্টোবর, ২০০১, ২৯ ডিসেম্বর, ২০০৮, ৫ জানুয়ারি, ২০১৪, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৮, ৭ জানুয়ারি ২০২৪ অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে যথাক্রমে ৫৫%, ৫১.১২%, ৫৯.৫৮%, ৫৪.৯২%, ৫৫.৪৫%, ২৬.৫%, ৭৪.৯৬%, ৭৫.৫৯%, ৮৭.১৩%, ৪০.০৪%, ৮০.২০%, ৪১.৮% শতাংশ জনগণ ভোটাধিকার প্রদান করে থাকে। উলিস্নখিত বাস্তবতায় আমরা যখন তুলনামূলক বিশ্লেষণে যাব- তখন আদতে আমাদের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিতে হবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়কাল কেবলমাত্র ধর্তব্য বিষয় নয়, এর সঙ্গে বৈশ্বিক রাজনীতি, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামো, সর্বত্র যুদ্ধের দামামা, সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসী ভূমিকা ইত্যাদি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ক্রীড়নক হিসেবে দেখা দিয়েছে। এই নির্বাচনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেভাবে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করেছে তা এককথায় নজিরবিহীন। শুধু এখানেই তারা ক্ষান্ত হয়নি, মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ও গুজব ছড়িয়ে নির্বাচন কমিশন ও সরকারের সঙ্গে সাধারণ জনগণের দূরত্বকে তৈরি করার ক্ষেত্রে গোষ্ঠীটি কাজ করেছে। তবে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে, রাষ্ট্রের স্বার্থে গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে ভোটাররা তাদের নাগরিক দায়িত্ব পালন করেছে। দেশি-বিদেশি একটি গোষ্ঠী প্রতিরোধের মুখে ভোট বর্জনের হুমকি স্বত্তেও কমিশন নাগরিকদের আশ্বস্ত করেছে আপনারা ভোটকেন্দ্রে আসুন, আপনার ভোটাধিকার প্রয়োগ করুন। ভোট আপনার অধিকার, আপনার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিন। এই মর্মে কমিশন জনগণকে আশ্বস্ত করেছে। আশ্বস্ত করেই কমিশন বসে থাকেনি, ভোটাররা যাতে নির্বিঘ্নে কেন্দ্রে আসতে পারে তার নিরাপত্তাও নিশ্চিত করেছে কমিশন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ভোটকেন্দ্রের পরিবেশকে সুশৃঙ্খল রাখতে সর্বোচ্চ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। নির্বাচন কমিশনের ব্যবস্থা ও আয়োজন দেখেও বিদেশি পর্যবেক্ষকরা সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন করেও বিদেশি পর্যবেক্ষকরা ভোট গ্রহণের ব্যাপারে তাদের সন্তুষ্টির বিষয়টি গণমাধ্যমে জানিয়েছে। আইনগত প্রক্রিয়ায় প্রার্থীদের আচরণগত ত্রম্নটি পরিলক্ষিত হওয়ায় কমিশন তৎক্ষণাৎ শোকজ প্রদান করেছে। কয়েকজন প্রার্থীর প্রার্থিতাও বাতিল করেছে কমিশন। অর্থাৎ কমিশন তার প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সুষ্ঠু ভোট আয়োজনে সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের চেষ্টা করেছে। কমিশন দেখিয়েছে, দলীয় সরকারের অধীনে কমিশনের ক্ষমতাবলে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন অনুষ্ঠান সম্ভব। সরকার নির্বাচন আয়োজনে কমিশনকে হস্তক্ষেপ করেছে এমন নমুনা আমরা যেমন দেখিনি ঠিক তেমনিভাবে কমিশনের পক্ষ থেকে কোনরূপ অভিযোগ উত্থাপিত হয়নি। সরকার কমিশনের আগ্রহে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরবর্তী সময়ে সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সরকারও মনে প্রাণে চেয়েছে দেশে-বিদেশে নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতার জন্য নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। সে লক্ষ্যে সরকার কমিশনকে যথাযথভাবে সহযোগিতা করেছে। শুধু তাই নয়, কমিশনের কাজে ব্যাঘাত ঘটে এমন কোনরূপ কর্মকান্ড সরকারদলীয় কোনো প্রার্থী করেনি এবং যেখানে আইনের ব্যত্যয় হয়েছে মন্ত্রীদেরও শোকজ দিয়েছে কমিশন। অর্থাৎ সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা সরকারের পক্ষ দেখে আমরা দেখেছি। সরকারও খুব করে চেয়েছে নির্বাচিত সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া সম্ভব সে বিষয়টি প্রমাণ করতে। তবে যে কথাটি নিশ্চিত করে বলা যায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বাঁধাগ্রস্ত করতে দেশি-বিদেশি যে ষড়যন্ত্রের রূপরেখা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে এমন নজিরবিহীন ঘটনা ইতোপূর্বে কখনো ঘটেনি। সে জায়গা থেকে নির্বাচন কমিশন ও সরকার এই নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেছিল এবং চ্যালেঞ্জে নির্বাচন কমিশন সফলতা দেখিয়েছে। দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকরা নির্বাচন নিয়ে তাদের সন্তুষ্টির ব্যাপারে উলেস্নখ করেছেন। নির্বাচনের পরবর্তী সময়ে গঠিত সরকারের প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছে পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্র এবং অব্যাহতভাবে শুভেচ্ছা বার্তা আসছে। কাজেই আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, সরকার ও নির্বাচন কমিশন যদি আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে তাহলে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন মোটেই দুষ্কর নয়। এ দেশের সাধারণ জনগণও নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাকে ইতিবাচকভাবে দেখছে। বিশেষ করে যারা নির্বাচনে ভোট প্রদান করতে এসেছে তারা প্রত্যেকেই ভোটকেন্দ্রের পরিবেশ নিয়ে উচ্ছাস প্রকাশ করেছে। তবে একটি পক্ষ যারা ভোট দিতে ভোটকেন্দ্রে আসেনি তারা ভোটকেন্দ্রের পরিবেশ নিয়ে ও ভোট প্রদান নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। আপনারাই বিবেচনা করুন, যারা ভোট দিতে আসেনি তারা কীভাবে ভোটকেন্দ্রের পরিবেশে নিয়ে অভিমত ব্যক্ত করে। জোর করে পোলিং এজেন্টকে ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে এমন অভিযোগ কোনো কেন্দ্র থেকে আসেনি, জাল ভোট গ্রহণ করা হয়েছে এমন অভিযোগ পাওয়া যায়নি, সিল মারার অভিযোগও আসেনি। দুয়েকটি জায়গায় নিয়ন্ত্রণহীন পরিস্থিতি তৈরি হলে কমিশন তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নিয়ে ভোটকেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছে। \হভোট গ্রহণের দিন সকাল ৮টায় ব্যালট বাক্স নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে কেন্দ্রে এসেছে; ব্যালট ছিনতায়ের কোনো ঘটনা ঘটতে পারেনি। সর্বোপরি নির্বাচন কমিশন ও সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় একটি নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন সম্ভবপর হয়েছে। মো. সাখাওয়াত হোসেন : সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়