বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মুখ রক্ষার চেষ্টা
এবার বিএনপি না এলেও নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার বড় কোনো সুযোগও পাচ্ছে না যুক্তরাষ্ট্র। সুতরাং, নির্বাচন নিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলে, একদিকে বাংলাদেশকে অস্বস্তিতে ফেলার পাঁয়তারা তাদের। আরেকদিকে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য ভোট নিয়ে ভিন্নমত আছে বলেও মন্তব্য করছে।
প্রকাশ | ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
ড. অরুণ কুমার গোস্বামী
গত ৪ ফেব্রম্নয়ারি, ২০২৪ তারিখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে দেওয়া এক চিঠিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। চিঠিখানা সদ্যসমাপ্ত সফল দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পূর্বে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার বিপরীতে 'মুখ রক্ষার চেষ্টা' হিসেবে পর্যবেক্ষকগণ মনে করছেন। বিষয়টি একটু খোলাসা করে বলা যেতে পারে।
জানা গিয়েছিল, মনমতো নির্বাচন না হলে বাংলাদেশে "আরব বসন্ত" সৃষ্টির পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এই ষড়যন্ত্র করা হচ্ছিল! ষড়যন্ত্রের পস্নট করা হয়েছিল এভাবে যে নির্বাচন যদি আমেরিকার কাছে সন্তোষজনক মনে না হয় তাহলে নির্বাচনের পরে এই ষড়যন্ত্র কার্যকর করা হবে। এটি ছিল নির্বাচনের আগেকার পরিস্থিতি। এর বিপরীতে সফলতার সঙ্গে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন একটি চিঠি দিয়েছেন। যেখানে (দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ধারাবাহিক) বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করার যুক্তরাষ্ট্রের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন।
নির্বাচনের পূর্বে পিটার হাসের দৌড়ঝাঁপ এবং আরব বসন্ত সৃষ্টির মার্কিন ষড়যন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীতে এখন শেখ হাসিনা সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডের অংশীদার হওয়া সম্পর্কিত যুক্তরাষ্ট্রের অভিপ্রায় স্বাভাবিকভাবেই আলোচনার ঝড় তুলেছে!
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি পাঠিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বাংলাদেশের উচ্চাভিলাষী অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে সমর্থনের পাশাপাশি একটি অবাধ ও মুক্ত ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল প্রতিষ্ঠার অভিন্ন স্বপ্ন পূরণে অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠায় ঢাকার সঙ্গে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, এভাবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পার্টনার হিসেবে কাজ করার আকাঙ্ক্ষা আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যক্ত করল কেন? নির্বাচনের আগেকার ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতার বিষয়টি বিবেচনা করলে এটিকে যুক্তরাষ্ট্রের মুখ রক্ষার চেষ্টা হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। এই পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি এই প্রশ্নটিও প্রাসঙ্গিক হয়ে দেখা দিচ্ছে যে, বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের কাছে বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুখ রক্ষার প্রয়োজন হলো কী কারণে?
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়নের সঙ্গে দেশটির ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের ভূমিকা রয়েছে। বিষয়টি দেশটির কৌশলগত জোট ভারত, অর্থনৈতিক মিত্র চীন এবং আরব বিশ্ব দ্বারাও প্রমাণিত। দেশটি তৈরি পোশাকশিল্পে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অবস্থান দখল করেছে। এ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান বাজার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে।
একদিকে যুক্তরাষ্ট্র যখন দক্ষিণ চীন সাগর ও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে নিজের জোট সদস্যদের নিয়ে চীনের ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, ঠিক একই সময়ে জাপানের অর্থায়নে বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তুলতে যাচ্ছে। যা কেবল বাংলাদেশের সামুদ্রিক সক্ষমতা বাড়াবে না, এটা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যকার সংযোগ স্থাপনকারী দেশ হিসেবে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ স্থাপন করবে। ফলে আঞ্চলিক সংযোগ ও ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একক অবস্থানের ভিত্তি গড়ে তুলতে যাচ্ছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ।
এসব বিষয় বিবেচনায় নিলে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বর্তমান বাংলাদেশের গুরুত্বের কারণ সহজেই বোঝা যায়।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যারা অংশগ্রহণ করেননি নির্বাচন সফলভাবে সম্পন্ন হবার পর তারা লজ্জায় মুখ লুকাচ্ছেন।
বিশ্ব মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অপরিহার্যভাবেই ক্ষমতা চর্চা করতে হবে। আর ক্ষমতা চর্চার জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে সখ্যতা বজায় রাখা দৃশ্যত যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আবশ্যকীয় হয়ে উঠেছে।
এটি স্মরণে রাখা সঙ্গত যে, গত বছর ২০২৩-এর ১৫ ডিসেম্বর বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর একটি রাষ্ট্র রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বাংলাদেশে আরব বসন্তের পরিবেশ সৃষ্টির মার্কিন প্রচেষ্টা সম্পর্কে একটি বিবৃতি জারি করেছিলেন। এ বিষয়ে স্থানীয় সময় মঙ্গলবার (১৯ ডিসেম্বর) ব্রিফিংয়ে একজন সাংবাদিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারের কাছে তার মন্তব্য জানতে চেয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। ম্যাথিউ মিলার স্পষ্টত প্রশ্নটি এড়িয়ে গিয়েছিলেন, বলেছিলেন, 'আমরা বাংলাদেশে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনকে সমর্থন করি এবং এর চেয়ে বেশি বলার মতো আমার আর কোনো মন্তব্য নেই।' পাশাপাশি 'আরব বসন্ত' নয়, 'বাংলা বসন্তের' জন্য এদেশের মানুষ প্রস্তুত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছিলেন বিপস্নবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। এসবের অর্থ হচ্ছে নির্বাচন প্রতিহত করার অভিলাষী দলের মধ্যে সেই সময় মার্কিনী অভিসন্ধির ব্যাপারে বেশ "জোশ" লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। অর্থাৎ নির্বাচনে বাধা দেওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হবার পরে নির্বাচন বিরোধীরা মার্কিনী তৎপরতায় সেই সময় বেশ পুলকিত অনুভব করছিলেন! তাহলে ব্যাপারটি এরকম দাঁড়ায় যে "আরব বসন্ত" বাংলাদেশে রপ্তানি করার লক্ষ্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বহুমুখী ষড়যন্ত্র চলমান থাকা সম্পর্কিত বক্তব্যের সারবত্তা ছিল। কিন্তু তাদের সেই ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে এবং শত্রম্নর মুখে ছাই দিয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সফল হবার মাধ্যমে নির্বাচন প্রতিহত প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে!
বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে মুখ রক্ষা হয়নি যুক্তরাষ্ট্রের!
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমের কয়েকটি দেশের নানা রকম অযাচিত কর্মকান্ড এবং দৌড়ঝাঁপের মধ্যে গেল ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নিরঙ্কুশ বিজয় নিয়ে পঞ্চমবারের মতো ও টানা চতুর্থবারের মতো শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে বিজয়ের পর বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা অভিনন্দন জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। ঢাকায় থাকা বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও মিশনপ্রধানরাও সশরীরে গণভবনে গিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতির সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।
কিন্তু চুপ ছিল একমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তবে রোববার (৪ ফেব্রম্নয়ারি) শেখ হাসিনাকে চিঠি লিখেন দেশটির প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। চিঠিতে তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে পাশে থাকবে যুক্তরাষ্ট্র। উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল গড়ে তুলতে যৌথভাবে কাজ করারও প্রতিশ্রম্নতি দেন বাইডেন। এছাড়া আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা, জলবায়ু পরিবর্তন, জ্বালানি ও বৈশ্বিক বিষয়ে একত্রে কাজ করার আশা প্রকাশ করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
উলেস্নখ্য, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে গেল বছরখানেক যাবত দৌড়ঝাঁপের মধ্যে ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। কখনো রাজনৈতিক দল ও নেতাদের দুয়ারে ধরনা দিয়েছেন তিনি। আবার কখনো বিএনপি-জামায়াত ও জাতীয় পার্টির নেতাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে দফায় দফায় বসেছেন তিনি। সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের ধোঁয়া তুলে নানা সবক দেওয়ার চেষ্টা করেছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। কিন্তু গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশের নামে বিএনপি-জামায়াতের নজিরবিহীন তান্ডবের পর নীরব হয়ে যান পিটার হাস।
তবে মন্ত্রিসভার শপথের পরদিনই ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের সঙ্গে দেখা করেন পিটার হাস। এরপর ধারাবাহিকভাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রীসহ বিভিন্ন মন্ত্রীদের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার কথা বলে আসছেন তিনি।
সবশেষ রোববার বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। সেখানেও একই কথা বলেছেন তিনি। তবে সব মন্ত্রীর সঙ্গেই দেখা করার পর গণমাধ্যমে একটি কথা বলে আসছেন পিটার হাস, নির্বাচন নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে তাদের। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক মজবুত করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ তারা।
এখন কী তবে নিজেদের মুখ রক্ষার জন্য ভিন্ন মতের কথা বলছে যুক্তরাষ্ট্র? এ বিষয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনের পর থেকে পিটার হাসের মন্তব্য এবং বাইডেনের চিঠির ভাষা প্রমাণ করে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের স্বার্থে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী হলেও ২০২৪-এর ০৭ জানুয়ারির ভোট নিয়ে দেশ-বিদেশে এক অস্বস্তি তৈরি করতে চায় দেশটি। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র খুব করে চেয়েছিল বাংলাদেশে তাদের পছন্দের সুশীলদের নিয়ে একটি অনির্বাচিত সরকার আনতে।
২০০৬-২০০৭ সালের দিকে ঢাকায় সে সময়ের মার্কিন রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে. টমাস ও প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিস অনির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠায় সফল হলেও, এবারে ব্যর্থ হয়েছেন পিটার হাস ও বাইডেন প্রশাসন।
এবার বিএনপি না এলেও নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার বড় কোনো সুযোগও পাচ্ছে না যুক্তরাষ্ট্র। সুতরাং, নির্বাচন নিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলে, একদিকে বাংলাদেশকে অস্বস্তিতে ফেলার পাঁয়তারা তাদের। আরেকদিকে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য ভোট নিয়ে ভিন্নমত আছে বলেও মন্তব্য করছে।
ড. অরুণ কুমার গোস্বামী : সাবেক অধ্যাপক ও কলাম লেখক