স্বাস্থ্য খাতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা

আমাদের দেশে স্বাস্থ্য খাতে এখনো নানা সমস্যা বিরাজমান, যেমন দেশব্যাপী পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবার অভাব, চিকিৎসক স্বল্পতা এবং ব্যয়বহুল চিকিৎসাব্যবস্থা। যাদের আর্থিক সচ্ছলতা আছে তারা বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণের সুযোগ পেলেও ব্যাপক সংখ্যক গরিব মানুষ চিকিৎসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে দুঃসহ জীবনযাপন করছেন।

প্রকাশ | ০৮ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

ডা. সমীর কুমার সাহা
প্রতি বছর ৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তত্ত্বাবধানে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস পালিত হয়। ১৯৫০ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যবিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টির জন্য এই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এই দিবসটি পালিত হয়। স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নকে সামনে রেখে ওই দিন বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পালন করা হয়। প্রতি বছর আমরা এই দিবসটি গুরুত্বসহকারে পালন করে আসছি, আমাদের দেশে স্বাস্থ্য খাতে এখনো নানা সমস্যা বিরাজমান, যেমন দেশব্যাপী পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবার অভাব, চিকিৎসক স্বল্পতা এবং ব্যয়বহুল চিকিৎসাব্যবস্থা। যাদের আর্থিক সচ্ছলতা আছে তারা বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণের সুযোগ পেলেও ব্যাপক সংখ্যক গরিব মানুষ চিকিৎসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে দুঃসহ জীবনযাপন করছেন। এই প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আমাদের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে প্রাকৃতিক চিকিৎসা পদ্ধতি (আয়ুর্বেদ ও ইউনানী) একটি ভূমিকা পালন করতে পারে। তাই এ দিবসকে সামনে রেখে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে প্রাকৃতিক চিকিৎসা পদ্ধতির ভূমিকা নিয়ে আলোকপাত করতে চাই। সংশ্লিষ্ট সবাই এগিয়ে এলে এই চিকিৎসা পদ্ধতি আমাদের দেশে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে উলেস্নখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হবে। আয়ুর্বেদ হচ্ছে পৃথিবীর প্রাচীন ঐতিহ্যগত চিকিৎসা পদ্ধতি। এটা ব্যক্তির আরোগ্যের ক্ষেত্রে সার্বিক বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে দেহ ও মন তথা সার্বিক সুস্বাস্থ্য রক্ষা করা। আয়ুর্বেদ এখন আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণার দ্বারা প্রমাণিত একটি চিকিৎসা পদ্ধতি। সারা বিশ্বে প্রতিনিয়ত এই চিকিৎসা পদ্ধতির প্রসার হচ্ছে। জটিল-কঠিন রোগ তথা এ শতাব্দীর বড় চ্যালেঞ্জ অসংক্রামক ব্যাধিগুলোর চিকিৎসায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা উপকৃত হচ্ছেন এই পদ্ধতির মাধ্যমে। আয়ুর্বেদের লক্ষ্য হচ্ছে খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাপন পদ্ধতির বিষয়ে নির্দেশনা দান করা, যাতে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ব্যক্তিরা তাদের সুস্বাস্থ্য রক্ষা করে চলতে পারেন এবং যারা স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন তারা তাদের স্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন করতে পারেন। সারা বিশ্বে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে আয়ুর্বেদ অন্যতম। আয়ুর্বেদের উলেস্নখযোগ্য প্রাকটিসগুলো হলো ধ্যান (মেডিটেশন), যোগ ব্যায়াম, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ব্যায়াম (প্রাণায়াম), পঞ্চকর্ম এবং বিভিন্ন হার্বস বা ওষুধ। আয়ুর্বেদে খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম ও জীবনযাপন পদ্ধতির মাধ্যমে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য গুরুত্বারোপ করা হয় এবং মন ও শরীরের সুস্থতার প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়। আয়ুর্বেদ একটি প্রাকৃতিক চিকিৎসা পদ্ধতি যেখানে মন, শরীর, আচরণ ও পরিবেশের বিষয়টি ব্যাপক একটি ব্যবস্থার মাধ্যমে সমাধান করে সুস্থতা অর্জনে সহায়তা করা হয়। আয়ুর্বেদে বলা হয় যে, মন, শরীর ও আত্মার ভারসাম্য রক্ষার ওপর মানুষের সুস্থতা নির্ভর করে। আয়ুর্বেদকে জীবনের বিজ্ঞান বলে অভিহিত করা হয় যেটা কিনা প্রকৃতি এবং জীবনের সবদিক নিয়ে আলোচনা করে। প্রাকৃতিক এই চিকিৎসা পদ্ধতি আমাদের সার্বিক ব্যবস্থার একটি ধারণা দেয় যা আমরা স্বাস্থ্যকর খাদ্যগুলো, ওষুধ ও ব্যায়ামের মাধ্যমে রোগব্যাধি থেকে মুক্ত হতে পারি। আমরা হয়তো অনেকেই জানিনা যে, অনেক আধুনিক ওষুধগুলো প্রাকৃতিক এই ঐতিহ্যগত চিকিৎসা পদ্ধতিকে অনুসরণ করে তৈরি করা হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ তাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার জন্য এই ভেষজভিত্তিক ঐতিহ্যগত চিকিৎসা পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল। এখনো পর্যন্ত প্রায় ৫০০ ধরনের উদ্ভিদ ঔষধি গুণ সম্পূর্ণ বলে প্রমাণিত হয়েছে। প্রাকৃতিক এই দ্রব্যাদির প্রতি মানুষের আগ্রহ দিন দিন বেড়েই চলেছে কারণ এগুলো নতুন কোনো ওষুধ তৈরির ক্ষেত্রে বিশাল একটি সোর্স। সারা বিশ্বে এই ঐতিহ্যগত চিকিৎসা পদ্ধতির প্রতি মানুষের এক বিশাল আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ঐতিহ্যগত এই চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহারের একটি সুবিধা হলো এই যে, ব্যয়বহুল বিদেশি ওষুধ আমদানির ওপর আমরা নির্ভরশীলতা কমিয়ে ফেলতে পারি, তার পরিবর্তে আমরা স্থানীয় সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেরাই কম খরচের ওষুধ তৈরি করতে পারি। আমরা জানি যে, অনেক আধুনিক ওষুধগুলো ঐতিহ্যগত ওষুধের প্রাকটিস অনুসারে আবিষ্কার করা হয়েছে। ঐতিহ্যগত এই চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে অনেক রোগের সাফল্যজনকভাবে চিকিৎসা করা হয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে এবং আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান এটাকে উলেস্নখযোগ্য চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। প্রাচীন এই চিকিৎসা পদ্ধতি আমাদের দেশে একটি বিশেষত্ব লাভ করেছে এবং আধুনিক উৎপাদন পদ্ধতির মাধ্যমে মানসম্মত অবস্থায় মানুষের কাছে ক্রমান্বয়ে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে। এই চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে যে বিভিন্ন রোগের আরোগ্য করা সম্ভব সে বিষয়ে পশ্চিমা বিজ্ঞানীরা স্বীকার করেছেন। যদি এই ধারা সাফল্যজনকভাবে অব্যাহত থাকে তাহলে এর মাধ্যমে অল্প খরচে চিকিৎসা প্রদান করা যেমন সম্ভব হবে। এতে এই দেশের স্বাস্থ্য খাত ও ঔষধশিল্পে একটি বিপস্নব নিয়ে আসতে পারে। ঐতিহ্যগত চিকিৎসাব্যবস্থা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে গভীরভাবে মিশে আছে। বাংলাদেশে অনেক মেডিসিনাল পস্নান্ট রয়েছে যার অনেকাংশই অনাবিষ্কৃত রয়েছে। ওই সব সম্পদগুলোর অনুসন্ধান করা দরকার এবং সেগুলো এমনভাবে ব্যবহার করা দরকার যাতে মানুষের আরোগ্যের ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে কাজে লাগে। আমরা ভারত ও চীনের দিকে তাকালে দেখতে পাই যে, এই দুটো দেশ তাদের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে তারা এই ঐতিহ্যগত পদ্ধতি অনুসরণ করে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে। শ্রীলংকা, ভুটান, নেপাল ও পাকিস্তানেও এই চিকিৎসাপদ্ধতির প্রতি জনপ্রিয়তা বাড়ছে। ভারত তার কমিউনিটি স্বাস্থ্যসমস্যার মোকাবেলায় এই পদ্ধতি ব্যবহার করেছে। শ্রীলংকাতে বিকল্প চিকিৎসা বিষয়ে আলাদা একটি মন্ত্রণালয় রয়েছে। বাংলাদেশ যে সব স্বাস্থ্য সমস্যা সমূহ মোকাবেলা করছে এ ক্ষেত্রে বলা যায় যে, আমাদের সব চিকিৎসাব্যবস্থার অন্বেষণ ও উন্নয়ন করা ছাড়া আমাদের কোনো বিকল্প নেই। প্রাকৃতিক এই চিকিৎসাব্যবস্থা আমাদের কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে, এ অর্থে যে এটা আমরা সহজেই পেতে পারি এবং এটা আমাদের ক্রয়ক্ষমতার ভিতরেই আছে। অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার ক্ষেত্রে আমাদের দেশে ডাক্তার, নার্স ও মিডওয়াইফের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। প্রাকৃতিক চিকিৎসার কর্মীবাহিনী ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা এ ঘাটতি পুষিয়ে নিতে পারি আমাদের স্বাস্থ্য খাতে। আমাদের জন্য এখন সময় এসেছে প্রাকৃতিক এই চিকিৎসা পদ্ধতির সক্ষমতাকে স্বীকৃতি দেয়া এবং এই ক্ষেত্রে কর্মরত জনশক্তিকে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করা। বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে আয়ুর্বেদ ও ন্যাচারোপ্যাথি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আয়ুনস্‌) ঐতিহ্যগত চিকিৎসা পদ্ধতির উন্নয়নে কাজ করে আসছে। এই চিকিৎসা পদ্ধতির গুরুত্ব তুলে ধরে দেশের সংশ্লিষ্ট তরুণ সমাজের মধ্যে এই বিষয়ে সচেতনতার সৃষ্টি ও এই বিষয়ে গবেষণা এবং উন্নয়নের জন্য আয়ুন্‌স ভূমিকা পালন করছে। আয়ুন্‌স মনে করে, এই খাতে উন্নয়ন সাধন করা গেলে আমরা স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক উন্নতি অর্জন করতে পারব। এই জন্য তারা এই চিকিৎসা পদ্ধতির ওপর আমাদের দেশে ব্যাপকভাবে গবেষণা চালানোর ওপর জোর দেন। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এই সেক্টরে আমাদের দেশে বেশকিছু সমস্যা আছে যেগুলো দূরীভূত করতে পারলে আমরা এই সেক্টরে উন্নতি অর্জন করতে পারব। নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো নিতে পারলে আমরা কাঙ্ক্ষিত ফলাফল আশা করতে পারি। এই সেক্টরে সরকারের তরফ থেকে অধিক পৃষ্ঠপোষকতা আসা দরকার, যে সব ইউনানী ও আয়ুর্বেদ ছাত্র গ্র্যাজুয়েট ও ডিপেস্নামা ডিগ্রি নিয়ে বের হচ্ছেন তাদের বিভিন্ন হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে নিয়োগ দানের ব্যবস্থা করতে হবে। ওই ডিগ্রিধারীদের জন্য উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রতিটি বিভাগে ১টি করে আয়ুর্বেদ ইউনানী মেডিকেল কলেজ স্থাপন ও প্রতিটি জেলায় ভেষজ বাগান তৈরি করতে হবে। ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক ওষুধ যাতে মানসম্মতভাবে তৈরি করা হয় সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। আয়ুর্বেদ ও ইউনানী সিস্টেমকে মনিটর করার জন্য বিএমডিসির মতো স্বতন্ত্র একটি কাউন্সিল গঠন করা দরকার। আমরা যদি আমাদের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন দেখতে চাই এবং জনগণের জন্য মানসম্মত স্বাস্থ্য পরিচর্যার বিষয়টি নিশ্চিত করতে চাই, তাহলে ঐতিহ্যগত পদ্ধতির উন্নয়নের জন্য উপরোক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে এবং তার সফল বাস্তবায়ন করতে হবে। আমাদের দেশের অধিকাংশ জনগণ গরিব। তাই তাদের পক্ষে বিপুল অর্থ ব্যয় করে চিকিৎসা কাজ চালানো দুরূহ ব্যাপার। ঐতিহ্যগত চিকিৎসা পদ্ধতিতে একজন মানুষ অল্প খরচেই চিকিৎসা সুবিধা গ্রহণ করতে পারে। প্রাকৃতিক পদ্ধতি হওয়ায় এই পদ্ধতিতে চিকিৎসার কোনো নেতিবাচক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই, যা কিনা আধুনিক পদ্ধতিতে ব্যাপক লক্ষ্য করা যায়। ঐতিহ্যগত পদ্ধতির আওতায় অনেক জটিল রোগেরও আরোগ্য করা সম্ভব। সংশ্লিষ্ট সবাই যদি এগিয়ে আসেন এবং তাদের ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেন, তাহলে প্রাকৃতিক চিকিৎসা পদ্ধতি আমাদের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে একটি বিপস্নবী ভূমিকা পালন করতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষে আশা করব যে, প্রাকৃতিক চিকিৎসা তথা, আয়ুর্বেদ ও ইউনানী চিকিৎসা বিষয়ে জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হবে এবং এই চিকিৎসা পদ্ধতির গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। ডা. সমীর কুমার সাহা: প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, আয়ুর্বেদ ও ন্যাচারোপ্যাথি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আয়ুন্‌স)