পাঠক মত

সমাজকর্ম পেশার প্রয়োজনীয়তা

প্রকাশ | ২৭ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

মেহেদী সজীব শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
আঠারো শতকের শেষাংশে এবং উনিশ শতকের প্রারম্ভে ইউরোপে প্রযুক্তিগত ব্যাপক উন্নতি ঘটে। কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থা থেকে মেশিননির্ভর সমাজব্যবস্থায় রূপ নেওয়া পশ্চিমা সমাজে বিজ্ঞানের অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়। বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার ফলে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে ছোঁয়া লাগে নতুন এক বিশ্বব্যবস্থার। যে ধারা শুরু হয় শিল্প বিপস্নবের মধ্য দিয়ে। এ সময় পূর্বের সহজ-সরল সমাজকাঠামো ভেঙে এক জটিল সমাজব্যবস্থার সৃষ্টি হয়। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি রূপ নেয় শিল্পভিত্তিক অর্থনীতিতে। উৎপাদন ব্যবস্থায় ইঞ্জিনের ব্যবহার সাধারণ মানুষের জীবনমানে উলেস্নখযোগ্য প্রভাব ফেলে। ইঞ্জিনের ব্যবহারের ফলে সমাজের অর্থনীতির চাকা আগের চেয়ে দ্বিগুণ গতিতে ঘুরতে থাকে। সম্ভাবনার পাশাপাশি এ সময় মানুষের জীবনে দেখা দেয় মনস্তাত্ত্বিক, পারিবারিক ও সামাজিক নানাবিধ সমস্যা। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয়, সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বের পাশাপাশি দেখা মেলে শিশুশ্রম ও অবাধ নারীশ্রম। ফলশ্রম্নতিতে সৃষ্টি হয় বস্তি এলাকার, ভেঙে পড়ে একান্নবর্তী পরিবারগুলো। তৎকালীন সমাজের বিভিন্ন সংস্থা, পরিবার, গোষ্ঠী এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের অপারগতার ফলে পার্শ্চাত্য দেশগুলোতে সর্বপ্রথম আধুনিক সমাজকল্যাণের সূচনা হয়। পরে যা রূপ নেয় পেশাদার সমাজকর্মে। ইংরেজি ঙপপঁঢ়ধঃরড়হ এর বাংলা আভিধানিক অর্থ বৃত্তি। মানুষ জীবনধারণের জন্য যা করে থাকে, তাই তার বৃত্তি। অপরদিকে চৎড়ভবংংরড়হ বা পেশা একটি তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক ধারণা। কোনো কাজ বা বৃত্তি পেশা হিসেবে বিবেচিত হবে কিনা, তা কিছু বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভর করে। জ. অ. ঝশরফসড়ৎব ও গরষঃড়হ এ. ঞযধশবৎবু পেশা সম্পর্কিত কিছু মাপকাঠি নির্ধারণ করেছেন, যা হলো- বিশেষ জ্ঞান ও যোগ্যতা, বিশেষ দক্ষতা ও নৈপুণ্য, জনকল্যাণমুখিতা, পেশাগত দায়িত্ব, পেশাদার প্রতিষ্ঠান, সামাজিক স্বীকৃতি, পেশাগত মূল্যবোধ, নৈতিক মানদন্ড, জ্ঞানের বাস্তবমুখিতা, ঐতিহাসিক পটভূমি ও ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধ ও জবাবদিহিতা। পেশার উক্ত বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সমাজকর্ম পেশাকে বিচার করলে দেখা যাবে, অন্যান্য সকল পেশার মতো এটিও পেশার সব বৈশিষ্ট্য ইতোমধ্যে অর্জন করে ফেলেছে। পেশাদার সমাজকর্মের উদ্ভব ঘটে ইংল্যান্ড তথা ইউরোপে, কিন্তু পূর্ণতা পায় আমেরিকায়। শিল্পভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় বহুমুখী সমস্যা মোকাবিলার জন্য সমাজকর্ম পেশার উৎপত্তি হয়। অপরদিকে আধুনিক সমাজকর্মের ভিত্তি হচ্ছে পারস্পরিক সহমর্মিতা, সহানুভূতি ও ধর্মীয় অনুপ্রেরণায় সৃষ্ট সমাজসেবা কার্যক্রম। সমাজকর্ম একই সঙ্গে একটি বিজ্ঞান ও কলা, যা ব্যক্তি, দল ও সমষ্টির সমস্যা সমাধানে কাজ করে। ইংল্যান্ড ও আমেরিকার মতো শিল্পায়ন, নগরায়ন, সামাজিক, মানসিক ও অন্যান্য সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে বাংলাদেশে পেশাদার সমাজকর্মের আবির্ভাব ঘটে। মানুষ সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করে। সমাজিক জীব হিসেবে ব্যক্তি মানুষের জন্য সমাজকর্ম পেশার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। আধুনিক সমাজে সমাজকর্ম মূলত সমস্যা নির্ধারণ ও তা সমাধানে হস্তক্ষেপ করে। সমাজকর্ম কয়েকটি বিষয়কে মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে কাজ করে, যার মধ্যে উলেস্নখযোগ্য- ব্যক্তি, পরিবার, দল, সংগঠন ও সমষ্টি। উলিস্নখিত উপাদানসমূহের সামাজিক ভূমিকা পালনে বিদ্যমান সমস্যা সমাধান ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করানোর মতো উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে পেশাগত সমাজকর্ম কাজ করে। আর তাই সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, সুবিধাবঞ্চিত, দুস্থ, অস্বচ্ছলতার দীর্ঘস্থায়ী সমাধানে সমাজকর্ম পেশার ভূমিকা রয়েছে। সমাজকর্মের বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞান ও পদ্ধতি ব্যবহার করে বর্তমান বিশ্বের বহুমুখী সমস্যার কারণ, প্রভাব, প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য উদ্ঘাটন করা সহজতর হয়। সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করে বাস্তবসম্মত ও যুগোপযোগী নীতি, পরিকল্পনা ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে সমাজকর্মের জ্ঞান বিশেষভাবে উপযোগী। উন্নত রাষ্ট্রসমূহে সমাজকর্ম একটি স্বীকৃত পেশা। যা সমাজকর্মের প্রয়োজনীয়তাকেই স্পষ্ট করে। অন্যদিকে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের আর্থ-সামাজিক সমস্যা যেমন- দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, বেকারত্ব, অপরাধ ইত্যাকার সমস্যা সমাধানে সমাজকর্ম শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সমাজকর্ম সর্বদাই জনকল্যাণমুখী পেশা। একজন সমাজকর্মী বিদ্যমান সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান দিয়ে থাকেন। সমাজকর্মের পঠনপাঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলি সম্পর্কে একজন সমাজকর্মী বিশেষ জ্ঞান ও সুনিপুণ দক্ষতার পরিচয় দেন। পেশাগত দায়িত্ব ও মূল্যবোধ অনন্য হওয়ায় নৈতিকতার মানদন্ডেও সমাজকর্মের পাঠ আমাদের জীবনমান পরিবর্তনে অসামান্য অবদান রেখে আসছে। মানবসভ্যতার সূচনালগ্নেই সমাজকল্যাণের আবির্ভাব ঘটে। কিন্তু এটি পেশা হিসেবে ধীরে ধীরে আজকের অবস্থানে পৌঁছায়। আর এজন্যই সমাজকর্ম পেশার একটি ঐতিহাসিক পটভূমি লক্ষ্যণীয়। বাংলাদেশে সমাজকর্ম পেশা হিসেবে স্বীকৃতি না পেলেও একটি পূর্ণাঙ্গ পেশা হিসেবেই তার কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। সমাজের বিদ্যমান নানাবিধ সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা এবং এর সুষ্ঠু সমাধানে সমাজকর্ম মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। আর এজন্যই বাংলাদেশে সমাজকর্ম একটি পেশা হিসেবে স্বীকৃত পাওয়া এখন সময়ের অন্যতম দাবি। বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ার লক্ষ্যে সমাজকর্মকে পেশা হিসেবেই বিবেচনা করে দেশের অভ্যন্তরীণ আর্থ-সামাজিক সমস্যাগুলো সমাধান করা অপরিহার্য। মেহেদী সজীব শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়