পাঠক মত

ঐতিহ্যে, সংস্কৃতিতে বাঙালির নববর্ষ

প্রকাশ | ১৬ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

মো. শামসুল ইসলাম সাদিক শিক্ষার্থী এমসি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, সিলেট
নদীর আছে গন্তব্য, মিশে যায় মোহনায়। ম্রিয়মাণ ছায়া পেছনে ফেলে রৌদ্রোজ্জ্বল দিনও বাড়ি যায়। অস্তমিত হয় শেষ বিকেলের সূর্য। সময় এমনি হয়। সেই সময়ের পথ ধরে পুরনো হয়ে গেল আরও একটি গল্পের পান্ডুলিপি। কবির ভাষায়- বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক/যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া গীতি/অশ্রম্নবাষ্প সুদূরে মেলাক্ত। বাংলা নববর্ষ উদযাপন আমাদের বাঙালির জাতীয়জীবনে অসাম্প্রদায়িক, সার্বজনীন প্রধান একটি উৎসব পহেলা বৈশাখ। এদিনটি প্রতিটি বাঙালির জীবনে নিয়ে আসে উৎসব আমেজ আর ফুরফুরে বাতাসের দিন বসন্ত। এদিন আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেয়া হয় নতুন বছরকে। জীর্ণশীর্ণ পুরাতনকে পেছনে ফেলে নতুনের আহ্বানে সামনে এগিয়ে যাওয়ার দিন, বাঙালির চিরায়ত উৎসবে মেতে ওঠার দিন, প্রাণ খুলে আনন্দে ভেসে যাওয়ার দিন। অতীতের ভুলত্রম্নটি ও ব্যর্থতার গস্নানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদযাপিত হয় বাঙালির নববর্ষ। প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশে উৎসবমুখর পরিবেশে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করা হয়। শিশু-যুবা-বৃদ্ধসহ সব বয়সের এবং সব শ্রেণির মানুষ এ দিনটি উদযাপন করে মহাধুমধামে। বাংলা নববর্ষ উদযাপন বাঙালি সমাজ, ঐতিহ্যে ও সংস্কৃতির একটি অন্যতম প্রধান উপাদান। এ উৎসবের প্রধান অনুষঙ্গ বৈশাখি মেলা। এ ছাড়া অন্যান্য অনুষঙ্গ আমানি, রাজপুণ্যাহ, হালখাতা, গাজনের গান ইত্যাদি গ্রামীণ অনুষ্ঠান যা আগের দিনে মাসজুড়ে চলতো। বাংলা নববষের্র সূচনা মুসলমানদের হাতে। মুসলিম ঐতিহ্যের হিজরি সনকে ভিত্তি করেই বাংলা সনের উৎপত্তি হয়েছে। মুঘল সম্রাট আকবরের (১৫৫৬-১৬০৫) আমলে বাংলার কৃষকদের সুুবিধার্থে হিজরি সনকে ভিত্তি ধরে বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। বাংলা নববর্ষের যাত্রা খুব বেশিদিন আগের নয়। সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহণের বছর ৯৬৩ হিজরি সনকে শুরুর বছর ধরে ফসলি সন নামে যে সন প্রবর্তন করা হয় কালক্রমে তাই বাংলাদেশে বাংলা সন নামে পরিচিত লাভ করে। মূলত মুঘল শাসনামলে হিজরি সনের ভিত্তিতে এ দেশে বছর গণনা হতো। হিজরি বছর সৌর বছর থেকে ১১ দিন ছোট হওয়ায় এ দেশের ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে হিজরি বছরের মিল হয় না। এতে কৃষকদের ফসলি সন গণনায় সমস্যা হয়। অধিকন্তু কৃষকের কাছ থেকে জমিদারের খাজনা আদায়েও সমস্যা দেখা দেয়। এ জন্য কৃষক ও জমিদারের সমস্যা দূর করতে মূলত বাংলা সনের প্রবর্তন করা হয়। তাই দেখা যায় বাংলা নববর্ষ সব বাঙালির হলেও উৎসবের আমেজটা কৃষকের একটু বেশি। উলেস্নখ্য, হিজরি সন গণনা হয় রাসূলে পাকের (সা.) মক্কা থেকে মদিনা হিজরতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। হযরত ওমর (রা.) রাসূলের (সা.) হিজরতকে স্মরণীয় রাখতে হিজরতের বছরকে ভিত্তি বছর ধরে হিজরি সনের প্রবর্তন করেন। পরে মুঘল সম্রাট আকবর তার সভাজ্যোতিষী আমীর ফতেউলস্নাহ সিরাজীর (দৈবে দশমরত্ন) পরামর্শে হিজরি ৯৬৩ সনকে বাংলা ৯৬৩ সন ধরে বাংলা সন গণনার নির্দেশ দেন। জমির খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে এ সন প্রবর্তন করা হয়। এর আগে এ দেশের দেশীয় সন হিসেবে শকাব্দের প্রচলন থাকলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে হিজরি সন চালু ছিল গোটা ভারতবর্ষে। আর এ কারণেই হিজরি সনকে ভিত্তি বছর ধরে এ বাংলা সনেরও প্রবর্তন করা হয়। অন্যদিকে এ সনের মাসের নামগুলো নেয়া হয় শকাব্দ থেকে। এভাবে দেখা যায় সনটি প্রবর্তনে এখানকার প্রধান দুটি ধর্ম অর্থাৎ মুসলমান এবং হিন্দু উভয় ধর্মের একটি প্রভাব সনটির ওপর পড়েছে। বাংলা সন ছাড়াও প্রায় সব সনের ক্ষেত্রেই এ ধর্মীয় প্রভাবের একটি দিক থাকে। বাংলা সনের ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলিমের এ মিলিত স্রোত সনটিকে একটি অসাম্প্রদায়িক অবস্থানে এনে দাঁড় করিয়েছে যা উদার ইসলামী সংস্কৃতির পাশাপাশি বাংলাদেশি সংস্কৃতির সঙ্গেও পুরোপুরি সামঞ্জস্যশীল। কৃষকের জমির খাজনা আদায়ের সুবিধার্থেই এ সন প্রবর্তন করা হয়েছিল। ফলে সন প্রবর্তনের সময় থেকেই সাধারণ মানুষের সঙ্গে এ সনের পরিচয় ও সম্পর্ক সুগভীর। আজও গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে যদি জানতে চান আজ বাংলা কত তারিখ, তাহলে তিনি হাতের আঙ্গুলে গুণে আপনাকে কোন মাসের কত তারিখ তা বলে দেবেন। গ্রামের মানুষের কাছে বাংলা সনের পর দ্বিতীয় গুরুত্ব হচ্ছে হিজরি সন বা চন্দ্র মাসের হিসাব। ইংরেজি সন গ্রামের মানুষের কাছে আজও ব্যাপক হারে স্থান লাভ করেনি। বাংলা সন প্রবর্তনের বছর থেকেই জমির খাজনা পরিশোধ করা হচ্ছে। এ সনের হিসাব মতে এবং তা আজ পর্যন্ত এ নিয়মেই বিদ্যমান। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও তৎপরবর্তীকালের ঘটনা বাংলা 'নববর্ষ' উদযাপনকে প্রাণবন্ত ও বিস্তৃত করেছে। অবশ্য সাম্প্রতিককালের 'নববর্ষ' বা 'বর্ষবরণ' ও আগের দিনের 'নববর্ষ' বা বর্ষবরণের মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট। বিশ্বায়নের ফলে আধুনিক যুগের বাংলা নববর্ষ উদযাপনের মনোহরি চাকচিক্য বাড়লেও আন্তরিকতার যথেষ্ট অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। অথচ বাংলা নববর্ষের সূচনাই হয়েছে বাঙালি কৃষকের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে। বাংলা নববর্ষের মূলে কৃষক ও কৃষি। বাংলা নববর্ষকে কেন্দ্র করে গ্রামেগঞ্জে বৈশাখি মেলা বসে। কৃষিজ পণ্য, কুঠিরশিল্প দ্রব্য, মৃৎ ও হস্তশিল্প দ্রব্য প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় আসবাবপত্র, খেলনা ইত্যাদি ক্রয়-বিক্রয়ের ধুম পড়ে যায় মেলায়। আগের দিনে মেলায় প্রদর্শনী হতো বাঁশের বেতের তৈজস আর নানা জাতের খেলনা সামগ্রী, নারকেল মুড়কিসহ আরও কত কি থাকে এসব মেলায়- তার ইয়ত্তা নেই। মেলার সময়ে নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা, কুস্তির আসর এমনকি মেলায় ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, বলি খেলা ইত্যাদি বিনোদন অনুষ্ঠান বসতো। তখন মেলা ছিল বাঙালির প্রাণের উৎসব। মেলা উপলক্ষে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়ানো ও আপ্যায়নের ব্যবস্থা হতো। আর বিবাহিতা মেয়েরা নাইয়র আসতো বাপের বাড়িতে। আবালবৃদ্ধবণিতা সবাই বৈশাখি মেলায় আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠতো। এমনিভাবে বাংলা নববর্ষ উদযাপনে বাংলার গ্রামে গ্রামে আনন্দের ধুম পড়ে যেত। বৈশাখি মেলায় আগের দিনে লাঙ্গল-জোয়াল-মইসহ বিভিন্ন কৃষি সরঞ্জামাদি, গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় মাটির হাঁড়ি-পাতিলসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র, শিশুদের খেলাধুলার জন্য ঘুড়ি মাটির তৈরি হাতি-ঘোড়া ইত্যাদি বেচা-কেনা হতো। মেয়েদের হাতের চুড়ি, কানের দুল গলার হার ইত্যাদি দ্রব্যও বেচা-কেনা হতো মেলায়। এ ছাড়া জুড়ি-বুন্দি জিলাপি রসগোলস্না ইত্যাদি মুখরোচক খাবারের সমারোহ তো ছিল বেশ চমৎকার। প্রাচীন বর্ষবরণের রীতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবেই জড়িত একটি বিষয় হলো- হালখাতা। তখন প্রত্যেকে চাষাবাদবাবদ চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সব খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করে দিত। এর পরদিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ ভূমির মালিকরা তাদের প্রজা সাধারণের জন্য মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়নের ব্যবস্থা রাখতেন। যা পরবর্তিতে ব্যবসায়িক পরিমন্ডলে ছড়িয়ে পড়ে। দোকানিরা সারা বছরের বাকির খাতা সমাপ্ত করার জন্য পহেলা বৈশাখের দিনে নতুন সাজে বসেন দোকানে। গ্রাহকদের মিষ্টিমুখ করিয়ে শুরু করেন নতুন বছরের ব্যবসার সূচনা। এ উৎসবগুলো সামাজিক রীতির অংশ হিসেবে পরিণত হয়েছে প্রতিটি বাঙালির ঘরে। দৃঢ়ভাবে আঁকড়িয়ে ধরতে না পারলে প্রাণশক্তি হারিয়ে আমাদের জাতি কালের গর্ভে তলিয়ে যাবে। আর অপসংস্কৃতি প্রতিহত করতে হলে নিজস্ব সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করতে হবে। উচ্চকিত করতে হবে মানবিক ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাঙালি সংস্কৃতি।