বৈশ্বিক সূচকে অবনমন

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত হোক

প্রকাশ | ২০ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
গণমাধ্যমকে বলা হয় একটি রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। সুতরাং রাষ্ট্রের সমৃদ্ধি এবং রাষ্ট্র পরিচালকদের নানাবিধ কর্মকান্ডের নিরপেক্ষ ও যৌক্তিক সমালোচনার জন্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের কোনো বিকল্প থাকা উচিত নয়। কিন্তু আমাদের দেশে বিষয়টি যেন উল্টো! আর এ কারণেই দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়টি নানান সময়ে আলোচনার শীর্ষে উঠে এসেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্ব সংবাদমাধ্যম স্বাধীনতা সূচক ২০১৯-এও (ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স ২০১৯) বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা লঙ্ঘন মারাত্মকভাবে বেড়েছে বলে জানা যাচ্ছে। প্যারিসভিত্তিক সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার প্রকাশিত বার্ষিক ওই সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান নির্ণয় করা হয়েছে ১৫০তম। গত বছরের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪৬তম। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ৪ ধাপ অবনমন ঘটেছে দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, 'ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গৃহীত কড়া নীতির যৌথ শিকার বাংলাদেশি সাংবাদিকরা'। আমরা মনে করি, সরকারের পক্ষ থেকে যখন গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা নানানভাবে তুলে ধরা হচ্ছে, তখন এ ধরনের একটি প্রতিবেদন উদ্বেগজনক এক বাস্তবতাকেই স্পষ্ট করে। একটি গণতান্ত্রিক দেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার অবনমন অত্যন্ত পরিতাপের। তথ্য অনুযায়ী, প্যারিসভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার (আরএসএফ) সারাবিশ্বের সাংবাদিকদের ওপর নিপীড়ন ও হামলার ঘটনা নথিবদ্ধ করে তা প্রতিরোধে কাজ করে। সঙ্গত কারণেই আরএসএফ প্রকাশিত প্রতিবেদনটি আমলে নিতে হবে সরকারকে। কেননা, সরকার তথা দেশের নীতিনির্ধারকরা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে। সংস্থাটির বিশ্লেষকরা বলছেন, সাংবাদিকদের ওপর ঘৃণা সহিংসতায় পরিণত হচ্ছে। বাংলাদেশে গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর হামলার ঘটনার দিকে তাকালেও এটি স্পষ্ট হতে পারে। সাংবাদিক শহিদুল আলমের গ্রেপ্তারের ঘটনা সামনে এনে আরএসএফ তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, বিরোধীদের দমন করতে বিচারব্যবস্থাকে ব্যবহারের নজির এই ঘটনা। পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে সংবাদকর্মীদের ওপর রাজনৈতিক কর্মীদের হামলা, নিউজ ওয়েবসাইট বন্ধ এবং সাংবাদিক গ্রেপ্তারের ঘটনা বেড়েছে বলে উলেস্নখ করা হয়েছে। '২০১৮ সালের অক্টোবরে প্রণীত আইনকে সর্বশেষ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে নির্বাহীরা। এই আইনে নেতিবাচক প্রচারণার শাস্তি ১৪ বছরের কারাদন্ড। যেসব সাংবাদিক এবং বস্নগাররা সমাজে অতিরিক্ত ধর্মনিরপেক্ষ মতপ্রকাশের সুরক্ষা চান তারা উগ্রবাদী ইসলামপন্থিদের হয়রানি আর হত্যার শিকার হচ্ছে' বলে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। আমরা মনে করি, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে এসব বিষয় বিবেচনায় নেয়ার বিকল্প নেই। বিশিষ্টজনরা বারবার বলে আসছেন, দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু অতীতে লক্ষ্য করা গেছে, গণমাধ্যম তথা স্বাধীন মতপ্রকাশের চর্চাকারী ব্যক্তিদের ওপর উগ্রপন্থিদের আক্রমণ ও হুমকি প্রদানের বিরুদ্ধে সরকার তেমন কঠোর অবস্থান নেয়নি, বরং এক ধরনের নমনীয়তা প্রদর্শন করে এসেছে- আর এটিই উঠে এসেছে সাম্প্রতিক বৈশ্বিক এ সূচকে। এ পরিস্থিতি একটি দেশের সামগ্রিক মঙ্গলের প্রতিবন্ধক, কেননা এতে জাতির গণতান্ত্রিক বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়। সর্বোপরি বলতে চাই, বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা যে সংকুচিত হয়েছে, তা অনুধাবন করার জন্য বৈশ্বিক এ সূচকের দিকে না তাকালেও চলে। এ দেশের গণমাধ্যমে কর্মরত পেশাদার সাংবাদিক থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী নাগরিক পর্যন্ত প্রত্যেকেই তা উপলব্ধি করছেন। তবু আরএসএফের সর্বসাম্প্রতিক বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান আমলে নেয়া প্রয়োজন। আমরা মনে করি, রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবক্ষয়ের পরিবেশে যখন সুশাসন, জবাবদিহি, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে, তখন গণমাধ্যমই জনগণের পক্ষে এসবের প্রধান রক্ষাকবচ হিসেবে ক্রিয়াশীল থাকে। জনগণের দেয়া ম্যান্ডেট যখন ক্ষমতার অপব্যবহারে রূপান্তরিত হয় এবং এর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক কোনো প্রতিরোধ থাকে না, তখন গণমাধ্যম সঠিক তথ্য প্রদান ও গঠনমূলক সমালোচনার দ্বারা শাসনযন্ত্রকে সঠিক পথে চলতে সহযোগিতা করে। সর্বোপরি, গণমাধ্যম গণতন্ত্র ও আইনের শাসন অটুট রাখার পক্ষে কাজ করে। সেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্রমেই সংকুচিত হলে জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই সরকারের দায়িত্ব গণমাধ্যমের স্বাধীনভাবে কাজ করার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখা। তার উল্টোটা কিছুতেই কাম্য নয়।