পাঠক মত

বাঁচার লড়াইয়ে হেরে গেলেন নুসরাত

প্রকাশ | ২৫ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

তন্বী ঢাকা
মা-বাবার আর্তি, সতীর্থদের প্রার্থনা আর চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ চেষ্টায়ও বাঁচানো গেল না ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে। সম্প্রতি ফেনীর সোনাগাজীতে নুসরাত জাহান রাফি নামে এক মাদ্রাসাছাত্রীর শরীরে কেরোসিন ঢেলে শরীরে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। রাফি সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে আলিম পরীক্ষা দিতে গেলে ঘটে এই মর্মান্তিক ঘটনা। দগ্ধ ও মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে প্রথমে সোনাগাজী স্বাস্থ্য কমপেস্নক্স এবং অনতি পরেই ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে। চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ চেষ্টা সত্ত্বেও বাঁচার লড়াইয়ে হেরে গেলেন নুসরাত। তার এই হেরে যাওয়া যেমনি নিষ্ঠুর-নৃশংস, তেমনি হৃদয়বিদারক। যে বিষয়টিতে আরও অধিক মর্মাহত হয়েছি তাহলো যিনি এই হত্যাকান্ডের মূল সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ উদ দৌলা, তারই মুক্তির দাবিতে মিছিল বের করা। যারা এই মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছে এবং অংশ নিয়েছে তারা কি আসলেই মানুষের কাতারে পড়ে? একজন নিরীহ ছাত্রীকে জ্বালিয়ে হত্যা করা হলো, হত্যাকারীর বিচারের দাবিতে রাস্তায় না নেমে উল্টো তার মুক্তির দাবি জানানো হচ্ছে। হায় মানবতা! এই তো দুদিন আগে পবিত্র মসজিদের ভিতরেই নিষ্পাপ শিশু মনিরকে খুন করে আরেক মাদ্রাসার অধ্যক্ষ। আট বছরের শিশু মনির হোসেন মসজিদে গিয়েছিল ইমাম হাদিরের মক্তবে পড়তে। কিন্তু ওই তথাকথিত হুজুরই মুক্তিপণের লোভে তাকে আটকে গলাকেটে হত্যা করেন। মৃতু্য নিশ্চিতের পরও শিশুটির দুটি হাত কাটেন। এরপর বস্তাভর্তি করে লুকিয়ে রাখেন মসজিদের সিঁড়ির নিচে। গ্রেপ্তারকৃত রাজধানীর ডেমরার ডগাইর নতুনপাড়ার নুর-ই-আয়েশা জামে মসজিদের ইমাম হাদির নিজেই প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশের কাছে শিশুটিকে হত্যার নৃশংস ওই বর্ণনা দিয়েছেন। আট বছরের শিশুর সঙ্গে এ ধরনের নৃশংসতা, হৃদয়ের কান্না কিছুতেই যেন থামাতে পারছি না। দিনের পর দিন নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা যেন পালস্না দিয়ে বেড়ে চলেছে। বিশেষ করে বর্তমান মাদ্রাসার সন্তানদের সঙ্গে তথাকথিত হুজররা যেভাবে গর্হিত কাজ করে যাচ্ছে তা যেন লুতের (আ.) যুগকেও হার মানাচ্ছে। একজন আলেম সমাজের কাছে সম্মানী ব্যক্তি আর তাদের কাছেই যদি আমাদের সন্তানরা নিরাপদ না থাকে তাহলে কার কাছে নিরাপদ থাকার আশা করতে পারি? প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ধর্ষণ, গণধর্ষণসহ জোরপূর্বক বিয়ের ঘটনা ঘটছে। আর ঘটনাটি কেবল বিয়ে বা ধর্ষণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্ষিতাকে হত্যা করা হচ্ছে নির্মমভাবে। অথবা ধর্ষিতা পরিবার সমাজ ও লোকলজ্জার ভয়ে আত্মহত্যা করছে। তদুপরি তথাকথিত ফতোয়া বা সামাজিক বিচারের রায়ে ধর্ষকের পরিবর্তে শাস্তি দেয়া হচ্ছে ধর্ষিতাকে, এমন সংবাদও আমরা পেয়ে থাকি। সম্প্রতি আমরা লক্ষ্য করছি বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষকরা এই জঘন্য অপরাধের সঙ্গে বেশি করে জড়িয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া ওয়াজগুলোতে সমাজের চাহিদার দিকে লক্ষ্য না রেখে বিভিন্ন উস্কানিমূলক বক্তব্য দিতেই যেন হুজুররা ব্যস্ত থাকে। একের পর এক নারীরা নির্যাতিত হচ্ছে, পুড়িয়ে হত্যা করা হচ্ছে অথচ আমাদের হুজুররা এসব বিষয় নিয়ে কোনো চিন্তাই করেন না, তারা শুধু আছেন কাকে কাফের ফতোয়া দেয়া যায়, কাকে মুরতাদ ঘোষণা করা যায় আর কাকে নাস্তিক বানানো যায়। আলেম সমাজ যদি উস্কানিমূলক বক্তব্য পরিহার করে পবিত্র কোরআন হাদিসের প্রকৃত শিক্ষা প্রচার করতেন তাহলে হয়তো সমাজ থেকে বিভিন্ন ধরনের অপরাধের মাত্রা কমতে থাকত। নুসরাত জাহান রাফির সঙ্গে যে নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়েছে তাও করেছে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আবার ৮ বছরের শিশুকে নৃশংসভাবে যিনি হত্যা করেছেন তিনি মসজিদের ইমাম। তাই আমি মনে করি এ ধরনের পিশাচদের নামের আগে 'মাওলানা' শব্দ ব্যবহার করাও ঠিক নয়। যাদের দ্বারা এ ধরনের নিকৃষ্ট কাজ সংঘটিত হতে পারে তারা মানুষ নামে কলঙ্ক। এসব তথাকথিত হুজুর বা মাওলানারা আজ সমাজ ও দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে। প্রার্থনা করি, এদের হাত থেকে জাতি যেন নিরাপদ থাকে। এ দেশের নারীরা আজ নির্মমভাবে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার। নুসরাত জাহান রাফির মতো কত নারীই ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃতু্যর জন্য অপেক্ষা করে। একের পর এক ধরনের ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে আর অপরাধীরা পারও পেয়ে যাচ্ছে। পার পেয়ে যাচ্ছে বলেই তো এ ধরনের জঘন্য কাজটি করতে অপরাধীদের মনে কোনো ধরনের ভীতির সঞ্চার হয় না। ধর্ষণের সংখ্যা ও ব্যাপ্তি বাড়ছে দিন দিন। প্রতি মাসে গড়ে ৫৫ শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। ২৬৯টি বেসরকারি সংস্থার পস্নাটফর্ম বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের ২০১৮-এর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই পরিসংখ্যান। গত বছরের প্রথম তিন মাসে ১৭৬ জন শিশু শিকার হয়েছে ধর্ষণের। এর মধ্যে হত্যা করা হয়েছে ২৫ শিশুকে। গত বছর ধর্ষণের শিকার হয়েছিল ১৪৫ শিশু। এর কারণ দুর্বল চার্জশিট, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, সর্বোপরি বিচারহীনতার সংস্কৃতি। নির্যাতন, নিপীড়নের শিকার শিশুরা অসহায় ও দরিদ্র বিধায় অপরাধীরা ক্ষমতাবান হলে মামলার গতি মুখ থুবড়ে পড়ে। আদালতে ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানি প্রমাণ করাও কঠিন। তদুপরি রয়েছে সামাজিক সম্মান ও লোকলজ্জা। যে কারণে আজ পর্যন্ত প্রায় কোনো ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। ফলে ধর্ষণের প্রকোপ বেড়েই চলেছে। নারীর ক্ষমতায়নসহ অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও উন্নয়নে বাংলাদেশের নারীসমাজ বিশ্বে ঈর্ষণীয় পর্যায়ে এগিয়ে থাকলেও পিছিয়ে আছে এদিক থেকে। নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ইত্যাদি প্রতিরোধে ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার সম্পন্নসহ দেশে যথেষ্ট ভালো আইন রয়েছে। ধর্ষকদের ক্রসফায়ারে দেয়ার দাবিও উঠেছে। তবে দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করতে হয় যে, বিস্তৃত পরিসরে এর প্রয়োগ প্রায় নেই বললেই চলে। অবশ্য এর জন্য নিম্ন আদালতসহ থানা-পুলিশও কম দায়ী নয় কোনো অংশে। সেখানে ঘুষ-দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ আছে বিস্তর। প্রশ্ন হলো- আর কত দিন এভাবে নারী ও শিশুরা নির্যাতিত হতে থাকবে? নারী এবং শিশুদের ওপর নির্যাতনকারীদের তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় যত দিন না আনা হবে তত দিন সম্ভব নয় এ দেশ থেকে নারী ও শিশু নির্যাতন বন্ধ করা। একই সঙ্গে প্রত্যেক পরিবারকেও হতে হবে সচেতন। অপরাধী যেই হোক তাকে কোনোভাবে ছাড় দেয়া যাবে না।