চার শতাব্দীরও অধিক পুরনো শহর আমাদের রাজধানী ঢাকা। অতীতের জৌলুস বেশ সমৃদ্ধ থাকা সত্ত্বেও এই নগরী দিন দিন বসবাসের যোগ্যতা হারাচ্ছে। একদিকে যেমন বাড়ছে জীবনযাত্রার ব্যয় অন্যদিকে ভোগান্তিও কমছে না কোনো অংশে। জীবনযাত্রার ব্যয়ভার বৃদ্ধির প্রথম পর্যায়ে স্থান পায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন, আকাশচুম্বী ঊর্ধ্বগামিতা। প্রাকৃতিক পরিবেশের অবক্ষয়, সর্বত্র পরিবেশ দূষণ, অবকাঠামগত অনিরাপত্তা, আবাসন সমস্যা, অপরিকল্পিত নগরায়ন, ব্যক্তিগত সুরক্ষার অনিশ্চয়তাসহ আরও বিভিন্ন দিক বিবেচনায় রাজধানী ঢাকা এখনো সন্তোষজনক অবস্থানে পৌঁছাতে পারেনি।
বসবাসের যোগ্যতার বিবেচনায় আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার মতে, ঢাকা নগরী তুলনামূলক বেশ পিছিয়ে। যদিও ব্যয়ের দিক থেকে ঢাকা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে মুম্বাইয়ের পরই অবস্থান করছে। একটি নগরী ব্যয়ের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে থেকেও বসবাসের যোগ্যতায় কেন দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে তা সত্যিকার অর্থে ভাবার বিষয়।
বিশ্বের ১৭৩টি শহরের স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, স্থিতিশীলতা, অবকাঠামো ও পরিবেশসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনা করে 'দি ইকোনমিক্স'র প্রকাশিতর্ যাংকিংয়ে ঢাকার মোট পয়েন্ট ৪৩ দশমিক ৮। যা সূচকের ৫০-এ অবস্থান করে। পরিবেশ দূষণেও ঢাকা মহানগরী কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। যুক্তরাষ্ট্র ও সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের এর তথ্য অনুসারে বিশ্বের বায়ুদূষণে শীর্ষ শহরগুলোর তালিকায় উঠে এসেছে ঢাকার নাম। এ ছাড়া জাতিসংঘের বার্ষিক ফ্রন্টিয়ার্স রিপোর্টেও সার্বিকভাবে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের নামের তালিকায়ও জায়গা করে নিয়েছে ঢাকা মহানগরী। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান বু্যরোর তথ্য অনুযায়ী, কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা নগরীতে ১ হাজার ৭০০ মানুষ নতুন করে প্রবেশ করে। গৌরবে মহিমান্বিত এ নগরীর যানজটের কথা যেন বলাই বাহুল্য। ঢাকার কথা মনে পড়লেই যেন সবার প্রথমে 'যানজট' শব্দটিই মাথায় আসে। অতিরিক্ত প্রাইভেট কার এবং রিকশা চলাচলের ফলে যানজট নিয়ন্ত্রণ যেমন সম্ভব হচ্ছে না তেমনি ভোগান্তিও পিছু ছাড়ছে না। রাস্তায় যত না অন্য যানবাহন তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি রিকশা আর প্রাইভেট কার। এদিক বিবেচনায় ঢাকাকে 'মসজিদের নগরী' বলার পাশাপাশি 'রিকশার নগরী' অথবা 'প্রাইভেট কারের নগরী'ও বলা চলে। এ ছাড়া গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার রাস্তার ধুলোয় সিসা ও নিকেলের পরিমাণ এত বেশি যে তা একজন সুস্থ মানুষের হৃদরোগ ও ক্যানসার সৃষ্টি করতে সক্ষম।
অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা শহরটির বিভিন্ন এলাকায় আবাসিক স্থাপনা ও কলকারখানা একই জায়গায় গড়ে উঠেছে যা অনিয়ন্ত্রিত দূষণের অন্যতম কারণ। অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে আবাসন, পানি সরবরাহ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা, চিকিৎসা, যোগাযোগসহ মানসম্মত জীবনযাপন সুনিশ্চিত করা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বিশ্বের নবম জনবহুল মেগাসিটি ঢাকায় সাম্প্র্রতিক সময়ে গ্রীষ্মকালের অতিরিক্ত তাপ আর শীতকালের অনিয়ন্ত্রিত ঠান্ডাও বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এই তো কিছুদিন আগে প্রচন্ড দাবদাহের কারণে ব্যাপক অস্বস্তিতে ভুগছিল বাসিন্দারা। এখনো তা কিছুটা চলমান। পক্ষান্তরে তীব্র দাবদাহ এড়ানোর বিশেষ মাধ্যম বৃষ্টিতে যে স্বস্তি পাবে তারও জো নেই। সামান্য বৃষ্টি হলেই রাস্তা-ঘাট ডুবে জলাবদ্ধতায় একাকার হয়ে যায়। বেশকিছু এলাকায় যানবাহন তো পানির ওপর দিয়েই চালানো হয়। সব মিলিয়ে গ্রীষ্মের দাবদাহ, বর্ষার জলাবদ্ধতা ও শীতের তীব্রতায় যেন বছরজুড়ে অশান্তির শেষ নেই।
প্রশাসনিক, রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগ কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানসহ শিল্পপ্রতিষ্ঠান ঢাকায় হওয়ায় জনসংখ্যার ঘনত্ব দিন দিন বেড়ে চলছে। বর্তমানে ঢাকা নগরীতে ৩৩ শতাংশ মানুষের বসবাস বিদ্যমান যা সেটার ধারণ ক্ষমতার অনেকটাই বাইরে। বিশেষজ্ঞদের মতে, নগরায়নের বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০৫১ সালের মধ্যে ৫৫ শতাংশ মানুষ নগরবাসী হয়ে যাবে।
বসবাসের জন্য এসব প্রতিবন্ধকতা কমাতে ঢাকা নগরীকে ঢেলে সাজানো ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই। শহরের পরিধি যে রকম বেড়েছে সেই সঙ্গে প্রশাসকদের ব্যাপক কর্মযজ্ঞও হাতে নিতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতু্য, নিত্যকার যানজট কমাতে প্রথমেই রাস্তায় প্রাইভেট কার ও রিকশার মিছিল কমাতে হবে। শহরের গণপরিবহণগুলোয় আনতে হবে শৃঙ্খলা। মানুষের মধ্যে ট্রাফিক আইন না মানার যে প্রবণতা বিদ্যমান তা আইনের প্রত্যক্ষ বাস্তবায়নের মাধ্যমে দূর করতে হবে। প্রয়োজন হলে বর্তমানের চাইতে আরও শাস্তির পরিমাণ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি বাইপাস সড়ক নির্মাণের সংখ্যাও বাড়াতে হবে।
দেশে মানুষ বাড়বে, সময়ের প্রয়োজনে বাড়বে নগর অবকাঠামো। কিন্তু তার জন্য থাকতে হবে সুষ্ঠু পরিকল্পনা। এর মধ্যে বর্তমানের সবচেয়ে জরুরি হলো নগর বিকেন্দ্রীকরণ। রাজধানীতে সবকিছু জমা না করে দেশের অন্য সব জেলা শহরেও পরিকল্পিতভাবে নগরায়নের ব্যবস্থা নিতে হবে। রাজধানী ঢাকায় বেশির ভাগ সদর দপ্তর অবস্থিত থাকায় কিছু কিছু কাজ ঢাকাতে না এসে সমাধানের উপায় থাকে না। এগুলো সুযোগ-সুবিধা বুঝে যে জেলায় স্থাপন করলে ভালো হবে সেখানে স্থাপন করা যেতে পারে। সুশিক্ষাকে ঢাকা-শহরের বাইরে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। ঢাকাতেই বেশির ভাগ নাম করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকায় দেখা যায় যে, গ্রামসহ সারাদেশ থেকে ছাত্রছাত্রী ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার উদ্দেশে ঢাকামুখী হয়ে থাকে। গ্রামগঞ্জের প্রতিটি জেলা শহরে রাজধানীর মতো সমানতালে শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। মানসম্মত প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলতে হবে।
এছাড়া জীবনের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থেকে যায় সেটি হলো চিকিৎসার জন্য অধিকাংশ লোককে রাজধানীমুখী হতে হয়। জেলা শহর বা গ্রামে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকার কারণেই একটু অসুস্থ হলেই ঢাকামুখী হতে হয়। সেজন্য প্রত্যেকটি জেলায় অন্তত দুই থেকে তিনটি সর্বাধুনিক ও মানসম্মত চিকিৎসা পাওয়া যায় এমন চিকিৎসালয় স্থাপন করতে হবে। যে চিকিৎসা ঢাকাতে এসে পাওয়া যাবে তা যেন সেই চিকিৎসালয়গুলোতেই বিদ্যমান থাকে। উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত থাকলেই তবে মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সারতে পারবে এবং ঢাকামুখী কম হবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শিল্পের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। ঢাকামুখী হওয়ার অন্যতম একটি কারণ কর্মসংস্থান। যদিও ঢাকায় পুরোপুরি পূর্ণাঙ্গভাবে সবার কর্মসংস্থান নিশ্চিত নয় তবুও অন্যান্য শহরের তুলনায় তুলনামূলকভাবে চলনসই। সেই হিসেব থেকেই গ্রাম থেকে ঢাকামুখী হয় ব্যাপক পরিমাণ মানুষ। শিল্প-কারখানাগুলো ও বিভিন্ন কর্মসংস্থান উপযোগী প্রতিষ্ঠানকে শুধু ঢাকায় নয় সারাদেশের শহরে স্থাপন করতে হবে। তবেই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ তাদের হাতের কাছেই সৃষ্টি হবে। ফলে তারা ঢাকায় আসার প্রয়োজন বোধ করবে না।
রাজধানী ঢাকা থেকে গমনাগমন ও যোগাযোগের পথ অন্যান্য শহর থেকে আরও সুগম করতে হবে। যাতে ঢাকায় বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোতে কোনো কাজে থাকলেও তা যেন ভোগান্তিতে না পড়তে হয়। তবে আমাদের আশার ব্যাপার এই যে সাম্প্রতিক সময় সরকার যানজট নিরসনে উড়ালসেতু নির্মাণ, মেট্রোরেল সিস্টেম, এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কাজ হাতে নিয়েছে এবং কিছু শেষও করেছে।
পরিকল্পিতভাবে নগরায়ণ বাস্তবায়ন সম্ভব হলে দূষণের চাপ স্বয়ংক্রিয়ভাবে কমে যাবে বলে আশা করা যায়। মূলত পরিবেশ দূষণ ঘন বসবাসেরই অন্যতম কারণ। এজন্য দেশের প্রত্যেকটা জেলা শহরকে সমানতালে গুরুত্ব দিতে হবে। বাড়াতে হবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা।
শহর শব্দটা শুনলেই কেমন যেন বড় বড় বাড়ি, বড় বড় বিল্ডিং, গাড়ির বাহার ইত্যাদি আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে। এ ধারণার পাশাপাশি আমাদের শহরকে করে তুলতে হবে সবুজময়। বৃক্ষরোপণ করার পরিবেশ দূষণ কমানোর চেয়ে উত্তম বিকল্প আর নেই। দেশের জেলা শহরগুলোকে পরিকল্পিত উপায়ে সজ্জিত করে নগরের সুন্দর জীবনযাপন নিশ্চিত করা এখন সময়ের আবদার। প্রত্যেক জেলা শহরের জীবনযাত্রার মান এক রকম হলে মানুষ রাজধানীমুখী কম হবে এবং রাজধানীর ওপর অভিশপ্ত চাপ কমে আসবে। ফলে যেমন বসবাসের জন্য উপযোগিতা তৈরি হবে তেমনি সুনিশ্চিত হবে মানসম্মত জীবনযাপন। সমৃদ্ধি ও মানসম্মত জীবন যাপনের জন্য যে কথা না বললেই নয় তা হলো সরকারি-বেসরকারি, প্রশাসনিক সব উদ্যোগের পাশাপাশি আমাদের ব্যক্তিপর্যায় থেকে সর্বপ্রথম সচেতন হতে হবে। একজন একজন আমি করেই কিন্তু আজকের পরিস্থিতির শিকার আমরা। প্রত্যেকে নিজ জায়গা থেকে সচেতন হয়ে চলাফেরা করলে সমস্যার প্রতিকার অবশ্যই সহজভাবে সম্ভব হবে। অন্যথায় সরকার যতই পদক্ষেপ গ্রহণ করুক না কেন নিজ দায়িত্ব থেকে না মানলে সুষ্ঠু বাস্তবায়ন কোনোদিন সম্ভব হবে না। সুষ্ঠু জীবনযাপন নিশ্চিতকরণে আমাদের সচেতন হওয়া এখন সময়ের দাবি। নয়তো আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখায় দায় হয়ে পড়বে। মানসম্মত শান্তিপূর্ণ জীবন আমরা কে না চাই! সবাই চাই। সুতরাং সে অনুযায়ী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে আমাদের এগোতে হবে যাতে ঢাকা মহানগরী যেমন নামে তেমনি বসবাসেও সেরা নগরীতে পরিণত হয়।
সাইশা সুলতানা সাদিয়া
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা