রেমিট্যান্স যোদ্ধা ও সমাজ বাস্তবতা

কাঙ্ক্ষিত সেবা পেতে তাদের হয়রানি ও দুর্ভোগ লাঘব করা রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব। রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থেই রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের মূল্যায়ন করতে হবে।

প্রকাশ | ০১ জুলাই ২০২৪, ০০:০০

সাইফুল ইসলাম স্বপ্নীল
ঈদ উৎসব আনন্দে মাতোয়ারা হয় দেশের কোটি কোটি মানুষ। কিন্তু যাদের কষ্ট, শ্রম ও ঘামে দেশের বিরাট অংশ তাদের অভিলাষ ও উৎসব আনন্দ করতে পারে এবং দেশের অর্থনীতি এখনো টিকে আছে তারা হচ্ছেন রেমিট্যান্স যোদ্ধা। তাদের কথা হয়ত-বা অনেকেই বলে না- তবে বর্তমান বাস্তবতায় তারা হচ্ছেন দেশের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। একটা গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। দুই যুগ আগের কথা বলছি। শামীম মিয়া প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দা। পেশায় কৃষক হলেও কয়েক বছর ধরে তিনি রোগ-শোকে জরাগ্রস্ত। তার দুই ছেলে রাশেদ ও অমিত গ্রামের স্কুল থেকে সদ্য এসএসসি পাস করেছে। কিন্তু আর্থিক অনটনে সংসার চালাতে যেখানে হিমশিম খাচ্ছেন সন্তানদের উচ্চতর পড়াশোনা তো অনেকটা বিলাসিতা। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বড় ছেলে রাশেদকে কাতারে শ্রমিক হিসেবে পাঠাতে বাধ্য হন তিনি। সংসারের হাল ধরতে রাশেদও অনন্যোপায়। সে গ্রামে তখন ছেলে বুড়ো প্রায় সবাই কৃষি কাজ করত। গ্রামে অবস্থাপন্ন পরিবার বলতে হাতেগোনা কয়েকটি ছিল। আকবর মাদবরের বাড়িতেই আধাপাকা একটি ভবন ছিল। বাকি সবার বাড়ি বাঁশ, বেতের কিংবা ছনের তৈরি ছিল। হাতেগোনা কয়েকটি বাড়িতে টিনের ঘর ছিল। আজ দুই যুগ পর দৃশ্যপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই গ্রামের যুবক মধ্যবয়সিদের প্রায় ৮০ ভাগই প্রবাসী। তাদের রেমিট্যান্সের ওপর ভর করেই বড় বড় দালান উঠেছে। প্রত্যেকটি বাড়ির জীর্ণশীর্ণ অবস্থা থেকে সুন্দর, গোছানো, পরিপাটি ও নান্দনিক পরিবেশ গড়ে উঠছে। গ্রামের উঠতি বয়সি কোনো ছেলেমেয়ে বেকার নেই। কেউ হয়ত প্রবাসী হচ্ছে, না হয় প্রবাসী আত্মীয়ের কিনে দেওয়া ল্যাপটপে ফ্রিল্যান্সিং করে লাখ টাকায় উপার্জন করছে কিংবা কেউ প্রবাসী স্বজনের রেমিট্যান্সের ওপর ভর করে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। এ যেন এক আলাদিনের চেরাগ। যে চেরাগের স্পর্শে পুরো গ্রাম আলোকিত হচ্ছে। মানুষের সচ্ছলতা, সুখ ও সুদিন ফিরেছে। গল্পটি কি খুব চেনা? বাংলাদেশের অনেক গ্রামের খুবই পরিচিত চিত্র? কোন জাদুর পরশে প্রত্যন্ত গ্রামের অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জীবনে এমন আমূল পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে? সেই সোনার কাঠি রুপোর কাঠি আসলে কী? হঁ্যা, দৃশ্যমান বৈপস্নবিক পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে কঠোর পরিশ্রমী প্রবাসীদের জন্য। নিজের রক্তে, ঘামে ও পরিশ্রমে অর্জিত রেমিট্যান্স আত্মীয় ও পরিজনদের সুখের জন্য পাঠিয়ে দেন। নিজে অত্যন্ত কষ্টে জীবনযাপন করা সত্ত্বেও তার স্বজনদের ভরণপোষণ ও দায়িত্ব পালনে কখনোই পিছপা হন না। বাংলাদেশে আর্থসামাজিক উন্নয়ন, টেকসই সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, ডলার সংকট নিরসন, আমদানি-রপ্তানিতে ভারসাম্য ও দেশের সামগ্রিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিতে কঠোর পরিশ্রমী প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বলা যায় দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো অনেকটা টিকে আছে রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের রেমিট্যান্সের ওপর ভিত্তি করে। ঈদের খুশিতে যখন তাদের পরিবার-পরিজন অত্যন্ত আনন্দ ও উৎসবে সময় কাটাবে তখন পরবাসে পরিবার-পরিজনহীন, উৎসব-আমেজহীন একটি নিরানন্দ সময় কাটাচ্ছেন হাজারো প্রবাসী। হয়ত-বা নিজের অর্জিত পুরো রেমিট্যান্স চলতি মাসের পরিবারের সবার খুশির জন্য বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এবারের ঈদেও তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স কোটি পরিবারের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। পরিবারের সবার জন্য নতুন জামা কিংবা দামি কোনো উপহার দিতে কার্পণ্য করেন না তিনি। নিজের জন্য একটি জামা কেনার মতো অর্থ তার কাছে হয়ত-বা নেই। কিন্তু তবুও প্রবাসী ভাইটির কোনো আক্ষেপ নেই, অভিযোগ ও অনুযোগ নেই। তার সেই কষ্টের কথা হয়ত-বা পরিবারের কেউ জানে না। সবাই দেখছে চাহিদা পূরণ করছে, সংসারের ভরণপোষণ দিচ্ছে। নিজে কষ্টে থেকেও অন্যের মুখে হাসি ফোটাতে পেরে তিনি নিজে পরিতৃপ্ত হচ্ছেন। এরাই হচ্ছেন রেমিট্যান্স যোদ্ধা। এরাই হচ্ছেন প্রকৃত দেশপ্রেমিক। প্রায় ৪৬০ বিলিয়ন ডলারের জিডিপির এ দেশে প্রায় ৮০ বিলিয়ন ডলারের আমদানি ব্যয়ের বিপরীতে রপ্তানি আয় মাত্র ৫০ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। এত বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি মেটানো আমাদের মতো দেশের জন্য খুবই চ্যালেঞ্জিং। গত কয়েক বছর ধরে ২০ বিলিয়ন ডলারের ওপর রেমিট্যান্স পাঠিয়ে এ দেশের অর্থনীতিকে সচল ও মজবুত রাখছেন প্রায় এক কোটি বিশ লাখ রেমিট্যান্স যোদ্ধা- যা দেশের মোট জিডিপির ৪.৬ শতাংশ। পাশাপাশি বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, প্রবাসীরা হুন্ডি ও অবৈধ চ্যানেলে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার পাঠান। কোভিড-১৯ ও ইউক্রেন যুদ্ধের পর ডলারের বিপরীতে টাকার ব্যাপক দরপতন হলে অর্থনীতির চরম দুর্দিনে প্রবাসী ভাইদের পাঠানোর রেমিট্যান্স অর্থনীতির পরম উপশম ও মহৌষধ হিসেবে কাজ করেছে। চরম কষ্টার্জিত রেমিট্যান্স পাঠিয়ে এ দেশের অর্থনীতিকে চাঙা রাখছেন তারা। মনে প্রশ্ন জাগে, বর্তমান বাস্তবতায় বাংলা মায়ের দামাল সন্তান কারা? এ দেশের তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত ও উচ্চশ্রেণির এলিট যারা দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে দেশের বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার করে বেগমপাড়ায় রাজপ্রাসাদ গড়ে তারাই নাকি এ যুগের সূর্যসন্তান। রেমিট্যান্স যোদ্ধারা যাদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলা মায়ের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। ডলার সংকটের এই সময়ে তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স অর্থনীতিকে রক্ষা করছে। দেশের ক্রান্তিকালে অগ্রসৈনিক রেমিট্যান্স যোদ্ধারা ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হলেও তাদের সঙ্গে এ দেশের বিমানবন্দর অথবা বাংলাদেশি দূতাবাস ও ভিসা প্রসেসিং, দালালচক্র, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য কিংবা পাসপোর্ট অফিসে কেমন আচরণ করা হয়? উচ্চশিক্ষিত বলে দাবি করা লোকজন তাদের সঙ্গে কেমন হয়রানিমূলক আচরণ করেন তা সর্বজনবিদিত। তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও হয়রানির অভিযোগ পত্রপত্রিকা ও গণমাধ্যমে প্রায়শই শোনা যায়। তাদের দুর্ভোগ ও হয়রানি যেন নিত্যসঙ্গী। যেন দেখার কেউ নেই। দেশান্তরী হয়ে কাছের মানুষ দূরে থুইয়া বছরের পর বছর কামলা খেটে, জীবনযৌবন বিসর্জন দিয়ে এ মাটির জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেন রেমিট্যান্স যোদ্ধারা। কামলা বলে তাচ্ছিল্য করা রেমিট্যান্স যোদ্ধারাই এ দেশের আসল প্রাণশক্তি। তারা এ যুগের এ দেশের অর্থনীতির মুক্তিযোদ্ধা। যাদের রক্ত, শ্রম, ঘামের ওপর টিকে আছে দেশের অর্থনীতির ভিত্তি। তারা কি নূ্যনতম সম্মান প্রাপ্য নন? বিমানবন্দরে তাদের বিভিন্নভাবে কেন হেয়প্রতিপন্ন করা হবে? বিভিন্ন সেবা পেতে তাদের কেন হয়রানি ও দুর্ভোগের শিকার হতে হবে? তাদের যথাযথ সহযোগিতা ও সৌজন্যমূলক আচরণ এবং রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও মর্যাদা প্রদান সময়ে দাবি। কাঙ্ক্ষিত সেবা পেতে তাদের হয়রানি ও দুর্ভোগ লাঘব করা রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব। রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থেই রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের মূল্যায়ন করতে হবে। সাইফুল ইসলাম স্বপ্নীল : শিক্ষক ও কলামিস্ট