ঢাকা শহরকে বাসোপযোগী করে তোলা হোক

আশা করি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ শিগগিরই ঢাকা শহরের এসব সমস্যা চিহ্নিত করবে এবং অচিরেই এসব সমস্যার সমাধান আসবে। তবেই পৃথিবীর বুকে বাসোপযোগী শহর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে ঢাকা।

প্রকাশ | ০৪ জুলাই ২০২৪, ০০:০০

ইসতিয়াক আহমেদ হিমেল
বিশ্বে বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকার বর্তমান অবস্থান ষষ্ঠ। তালিকার ১৭৩টি শহর নিয়ে স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, পরিবেশ ও অবকাঠামোগত বিবেচনায় এই সূচক তৈরি করা হয়েছে লন্ডনভিত্তিক ম্যাগাজিন দি ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট কর্তৃক প্রকাশিত লিভাবিলিটি ইনডেক্স-অনুযায়ী। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, ২০২১ সাল থেকে রাশিয়া কর্তৃক ক্ষেপণাস্ত্র আর ড্রোন হামলায় বিধ্বস্ত ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ ঢাকার তুলনায় তিন ধাপ উপরে আছে? ঢাকার এমন লজ্জাজনক অবস্থানের কারণ হলো এটির জনসংখ্যা, পরিবেশ, অপরিকল্পিত অবকাঠামো ও যানজট ইত্যাদি। ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মতে, ঢাকা শহরের মোট জনসংখ্যা ১ কোটি ৭৫ লাখ। জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৩৪,৯৬৯ জন। বসবাসের অযোগ্যতার প্রধান কারণই হলো এই জনবিস্ফোরণ। এর কারণে যত্রতত্র গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিত আবাসস্থল। এসব আবাসস্থলে বসবাসরত জনগণের মধ্যে রয়েছে পয়ঃনিষ্কাশনের সংকট। মহানগরীর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা আছে মাত্র ৫ শতাংশ। বাকি ৯৫ শতাংশ এলাকায় যথাযথ পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় রাজধানীর লেক, খাল ও নদীর পানি উলেস্নখযোগ্যভাবে দূষিত হচ্ছে। ঢাকা শহরের এই জনবিস্ফোরণ অবকাঠামোর ওপর অতিরিক্ত চাপ এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। ঢাকা শহরের রাস্তায় গাড়ির বিকট হর্নের শব্দ এবং কালো ধোঁয়া পরিবেশ দূষণে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। কলকারখানার বর্জ্য, ইটভাটার কালো ধোঁয়াও ব্যাপকভাবে ঢাকার পরিবেশ দূষণ করছে। বায়ুদূষণের তালিকায় ঢাকার অবস্থান শীর্ষে। ঢাকার ধুলিদূষণ নির্ধারিত মাত্রার চেয়েও তিনগুণ বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে বায়ুদূষণের ফলে প্রাণহানির সংখ্যা প্রতি বছরে ১৫ হাজার, যার ৫০ শতাংশই শিশু। বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ গাড়ির কালো ধোঁয়া, বিভিন্ন শিল্পকারখানার বিষাক্ত পদার্থ, ইটভাটার ধোঁয়া, যত্রতত্র ময়লা ফেলা এবং তা পোড়ানো ইত্যাদি। এতে ঢাকার পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। জনজীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। ঢাকা শহরে গাড়ির সংখ্যা বিবেচনায় যথেষ্ট রাস্তা নেই। একটি আধুনিক নগরীতে মোট আয়তনের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ রাস্তা থাকা প্রয়োজন। কিন্তু ঢাকায় প্রয়োজনের এক-তৃতীয়াংশই রাস্তা আছে। নগরীর মোট জনসংখ্যার ৮৫ শতাংশই গণপরিবহণ ব্যবহার করে, বাকি ১৫ শতাংশ জনগণ ব্যক্তিগত যান ব্যবহার করে। কিন্তু সড়কের ৭০ শতাংশই ব্যক্তিগত যানের দখলে থাকে। তাছাড়া ঢাকায় পর্যাপ্ত পার্কিং ব্যবস্থা না থাকায় যত্রতত্র এসব গাড়ি পার্কিং করা হয়, ফলে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। যার কারণে নগরীর প্রায় এলাকাতেই তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে নষ্ট হয় নগরবাসীর কর্মঘণ্টা, উলেস্নখযোগ্যভাবে প্রভাব পড়ে দেশের অর্থনীতির চাকায়। অপরিকল্পিত নগরায়ণ সমস্যা ঢাকার জন্য অন্যতম বড় বাধা। ঢাকার ব্যাপারটা এখন এমন হয়েছে যে তিল পরিমাণ জায়গা পাওয়াও দুষ্কর। যেখানে সেখানে মানুষ অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ করছে, বস্তি বানাচ্ছে। দখলদারদের দৌরাত্ম্য তো আছেই। গত ২০ থেকে ২৫ বছরে নগরায়ণ পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয়নি। যেখানে সেখানে ঘরবাড়ি উঠছে, আবর্জনা ব্যবস্থাপনায় সমস্যা, পর্যাপ্ত ডাস্টবিনের অভাব ইত্যাদি। তাছাড়া, ঢাকা শহরের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাও অত্যন্ত নাজুক। প্রায়ই ভারি বর্ষণে জলাবদ্ধতার দেখা দেয়। এতে নগরবাসীর চলাচলে ব্যাপক দুর্ভোগ পেতে হয়। এই অবস্থার চূড়ান্ত শিকার হয় নারী ও শিশুরা। জলাবদ্ধতার কারণে বিদু্যৎস্পৃষ্ট হয়ে প্রাণহানির ঘটনাও দেখেছে দেশবাসী। অপরিকল্পিত নগরায়ণের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে যানজট। বলা যায়, পরিকল্পনার অভাবের ফলই হলো ঢাকা শহরের এই যানজট। আরও দেখা যায় সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রয়োজনে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির প্রতিযোগিতা চলছেই। এসব সমস্যা আসলে অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফল। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক গবেষণায় দেখা গেছে, নগরীতে বিক্ষিপ্তভাবে গড়ে ওঠা অবকাঠামোর ৭৩ শতাংশই পুরোপুরি অপরিকল্পিত। এমন অপরিকল্পিত অবকাঠামোর কারণেই যানজট আর জলাবদ্ধতার শহরে পরিণত হয়েছে ঢাকা। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পানিতে ও যাতায়াত পথে দুর্গন্ধ। রাস্তাঘাটের বেহাল দশা, ঢাকনাবিহীন ম্যানহোল, যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনার স্তূপ, মশা-মাছির যন্ত্রণাসহ আবাসন সংকট। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে আবাদি জমির পরিমাণ ক্রমেই কমছে। ফলে খাদ্য সংকট দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ঢাকা শহরের সুপেয় পানির অভাব একটি মারাত্মক সমস্যা- যা নগরবাসীর দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন অসুবিধা সৃষ্টি করে। ওয়াসা যেই পানি সরবরাহ করে সেটা যে দূষিত তা সবারই জানা। শহরের হোটেল রেস্টুরেন্টে এসব সাপস্নাইয়ের পানিই নগরবাসীদের খাওয়ানো হয়। ফলে, পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পানি সরবরাহ ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং পাইপলাইনের লিকেজের কারণে ওয়াসা কর্তৃক সরবরাহকৃত পানি সব জায়গায় পৌঁছায় না বা অপর্যাপ্তভাবে পৌঁছায়। এছাড়া, অনিয়মিত গ্যাস সাপস্নাইও দেখা যায়। শহরের বিভিন্ন জায়গায় সকাল-বিকাল গ্যাস পাওয়া যায় না। এতে দুর্ভোগ পোহাতে হয় নগরবাসীদের। ঢাকা শহরের এতসব সমস্যার কারণেই মূলত জনজীবন বসবাসের অযোগ্য ও দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। সরকারের উচিত হবে জনগণের ঢাকা কেন্দ্রিকতা বিলোপ করা এবং জনবিস্ফোরণ ঠেকানো। ঢাকার বাইরে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও শিল্পায়ন জোরদার করা জরুরি। শহর থেকে দূরে শিল্পকারখানা, গার্মেন্টস ইত্যাদি গড়ে তোলা। এতে শহরের অভ্যন্তরে চাপ কমবে পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষা পাবে। ফসলি জমিতে কোনো শিল্পকারখানা নয়। ফসলি জমিতে আবাদ করে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। যানজট নিরসনে রাস্তাঘাট নির্মাণ ও এর পরিচর্যার বিকল্প নেই। যেহেতু নতুন করে রাস্তা নির্মাণের জায়গা নেই সেহেতু ঢাকা শহরকে আরও বেশি ফ্লাইওভার, মেট্রোরেলের আওতায় আনা হোক। এক্ষেত্রে পাতাল ট্রেনও উলেস্নখযোগ্য অবদান রাখতে পারে। পর্যাপ্ত পার্কিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা। যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং করলে শাস্তির আওতায় আনা। গণপরিবহণকে একটি নির্দিষ্ট নিয়মের ভেতরে আনা, এসব গাড়ির ফিটনেসের প্রতি নজর দেওয়া, ভাড়া নির্ধারণ করে দেওয়া। পাশাপাশি এসব গণপরিবহণ চালকদের ট্রাফিক নিয়ম সম্পর্কে নূ্যনতম ধারণা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। পরিকল্পিত নগরায়ণের জন্য সুস্পষ্ট ও দীর্ঘমেয়াদি নগর পরিকল্পনা তৈরি করা এবং তা বাস্তবায়নে কাজ করা। আইনের কঠোর প্রয়োগ ও যথাযথ আইনি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। দখলদারদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। প্রচুর পরিমাণে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করতে হবে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় দক্ষ জনবল নিয়োগ ও ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ঘটানো প্রয়োজন। সর্বোপরি, বিকল্প নগরায়ণের কথা ভাবতে হবে। সুপেয় পানির জন্য প্রথমেই ঢাকাস্থ নদী ও জলাশয় দূষণ রোধে কর্মসূচি গ্রহণ করা জরুরি। শিল্পকারখানার বর্জ্য কোনোভাবেই যেন নদী বা জলাশয়ের পানি দূষিত করতে না পারে। সুপেয় পানি সরবরাহের পাইপে লিকেজ সংশোধন করা। সর্বোপরি পাইপলাইনগুলোর সংস্কার এবং আধুনিকায়ন করা। সুপেয় পানি পানের গুরুত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা এবং সুপেয় পানি পানের জন্য উদ্বুদ্ধ করা। পানি সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর নজরদারি রাখা এবং যে কোনো সমস্যা দেখা দিলে দ্রম্নত তার সমাধান করা। আশা করি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ শিগগিরই ঢাকা শহরের এসব সমস্যা চিহ্নিত করবে এবং অচিরেই এসব সমস্যার সমাধান আসবে। তবেই পৃথিবীর বুকে বাসোপযোগী শহর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে ঢাকা। ইসতিয়াক আহমেদ হিমেল : নবীন কলাম লেখক