আগামীর জন্য যে শিক্ষা
এই মুহূর্তে দেশের সঙ্গে বহির্বিশ্বের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য স্বাভাবিক রাখা, অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করা, বৈদেশিক সম্পর্ক ও কৌশলগত দিকগুলো সাবধানতার সঙ্গে মোকাবিলা করা, দেশের নাগরিকদের স্বাভাবিক রেখে পরিস্থিত নিয়ন্ত্রণে রাখাই হবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
প্রকাশ | ০৮ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
সাজ্জাদ হোসেন
গত জুলাই মাসের শুরু থেকে কদিন পর্যন্ত সময়টা ছিল এ দেশের মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সময়। কেউ ভেবেই উঠতে পারেনি যে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার ইসু্যকে কেন্দ্র করে তা রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। আন্দোলন শুরুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে না পারাটা ছিল শেখ হাসিনা সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। এই আন্দোলনের আগুন যখন বাড়তে শুরু করে তখন তার সঙ্গে শুধু ছাত্ররা নয় বরং একে একে শিক্ষক, অভিভাবকরা শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোও নিজেদের মতো করে এই আগুনে বাতাস দিতে থাকে এতে কোনো সন্দেহ নেই। ১৮ জুলাইয়ের সংঘর্ষ ও পুলিশের গুলিবর্ষণ সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইন্টারনেট বন্ধ রেখে দেশের তথ্য-যোগাযোগকে ব্যাহত করা। এর পরের ঘটনা আমাদের সবারই জানা। তবে ৫ আগস্ট যা ঘটলো তা বাংলাদেশের জন্য তথা আওয়ামী লীগের জন্য একটি জঘন্য ঘটনা। আওয়ামী লীগের যত সব অর্জন ছিল তা পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে দেশ থেকে পালিয়ে গেলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি শুধু একটি রাজনৈতিক দলকেই ধ্বংস করলেন না বরং মেয়ে হয়ে পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও অপমানের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করালেন।
যাহোক, বলা হচ্ছে, শেখ হাসিনা তার এই ক্রান্তিকালে তার দলের নেতাকর্মীদের সহযোগিতা পাননি। এটা শতভাগ সত্য কারণ গণমাধ্যমের খবরই বলে দিচ্ছে গত এক সপ্তাহে তার দলের বহু হেভীওয়েট নেতাকর্মীরা দেশত্যাগ করেছেন। আওয়ামী লীগ সমর্থিত যেসব বাঘা বাঘা ব্যবসায়ী ছিলেন যারা দেশের ব্যবসাবাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে চলছিলেন তারাও তাকে সহযোগিতা করেননি। এর পেছনের কারণ হচ্ছে, শেখ হাসিনা তার অধীনস্থ সব সেক্টরে নিজের অনুসারী লোকবল নিয়োগ করে রেখেছিলেন- যা সম্পূর্ণরূপে স্বৈরাচারিত্বের বহিঃপ্রকাশ। এতে করে, এমন একটি চেইন অব কমান্ড তৈরি হয়- যা আসলে ব্যবসাবাণিজ্যের জন্যই হুমকি হয়ে উঠেছিল। ব্যবসায়ীরা রাজনীতি নাম লেখানোর প্রধান উদ্দেশ্য হলো নিজের ব্যবসাকে চাঙা করা। এখানে উল্টোটা হচ্ছিল কিন্তু কেউই এই চেইন অব কমান্ডের বাহিরে যেতে পারছিলেন না। উপরন্তু চলমান ডলার সংকট ও বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতিও একটি বড় কারণ হয়ে উঠেছিল। শেখ হাসিনা দলের লোকদের সমর্থন না পাওয়ার প্রধান কারণ হলো- তিনি বিগত নির্বাচনে বহু তৃণমূল নেতাকে তাদের প্রাপ্য অধিকার বঞ্চিত করেছেন। টাকার বিনিময়ে পদ বিক্রি করে তিনি ত্যাগী ও পরিশ্রমী নেতাকর্মীদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ তৈরি করেছেন- যা স্বয়ং আওয়ামী লীগের মধ্যেই বারংবার আলোচিত হয়েছে।
রাষ্ট্র পরিচালনায় শেখ হাসিনা অনেক দৃশ্যমান উন্নয়ন করেছেন কিন্তু তার পেছনে রয়েছে কোটি কোটি ডলারের ঋণের বোঝা- যা প্রকৃতপক্ষে দেশেকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করে রেখেছে। মেধার সঠিক মূল্যায়ন না করা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিপর্যয়, নিজ দলের নেতাকর্মী, মন্ত্রী ও আমলাদের সীমাহীন দুর্নীতি ও কালো টাকার মালিক বনে যাওয়া, দুর্নীতি, ঘুষ ও নেতাকর্মীদের মাধ্যমে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকান্ড, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, ছাত্ররাজনীতি ও রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি যেমন আওয়ামী লীগের সমর্থক না হলে নানাভাবে হয়রানি করাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে তার দাম্ভিক স্বৈরাচারিত্ব প্রকাশ পেয়েছে কিন্তু কেউই এর প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি। বিগত কয়েকদিনে বহু পুলিশ নিহত ও আহত হয়েছেন। এর কারণ হলো পুলিশ গত ১৮ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে গুলি চালিয়েছে আর এতদিন ধরে উপরোক্ত দুর্নীতিগুলোকে পুলিশ লালনপালন করে আসছিল। সব মিলিয়ে তরুণ সমাজ পুলিশকে সরকারের দুর্নীতির পৃষ্টপোষক হিসেবে সায়েস্তা করেছে- যদিও কোনো প্রকার প্রাণহানিই কারও কাম্য নয়। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার কার্যালয় ও যানবাহনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের কারণও একই।
শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর অন্তর্বর্তীর সরকার গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। দেশবাসী প্রত্যাশা করে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেন দেশকে তার ক্রান্তিলগ্ন থেকে বের করে এনে একটি দুর্নীতিমুক্ত, সুখী ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্র উপহার দিতে পারে।
এই মুহূর্তে দেশের সঙ্গে বহির্বিশ্বের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য স্বাভাবিক রাখা, অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করা, বৈদেশিক সম্পর্ক ও কৌশলগত দিকগুলো সাবধানতার সঙ্গে মোকাবিলা করা, দেশের নাগরিকদের স্বাভাবিক রেখে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখাই হবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
যেসব কারণে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের অধঃপতন ঘটেছে সেই কারণগুলো যেন আসছে সরকার মনে রেখে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে দেশ পরিচালনায় আত্মনিয়োগ করে।
সাজ্জাদ হোসেন : ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক