ক্ষমতা চর্চায় নির্বাচন সংবিধান সংশোধন প্রসঙ্গ

অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার জুলাই বিপস্নবকে মূল্যায়ন করবে, মানুষের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে এনে দেশের মানুষকে উপহার দেবে উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ; এটাই এখন প্রাণের দাবি।

প্রকাশ | ১০ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

মো. আব্দুর রাজ্জাক
জুলাইয়ের গণবিপস্নব একটি যুগান্তকারী ঘটনা, যেখানে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থার সমূলে আঘাতের মাধ্যমে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের চেষ্টা ও চেতনায় পথ বিনির্মাণের সুযোগ তৈরি হয়েছে। ফ্যাসিজম একক ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতা নয় বরং রাষ্ট্র পরিচালনার অব্যবস্থার নাম, যেখানে আইনকে দলীয় মোড়কে খোলসবন্দি করে বিরোধী মতকে নিপীড়ন করা, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকর করা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক চেতনাকে নিয়ন্ত্রিত ভাবধারায় পরিচালিত করার মাধ্যমে গোটা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় অলিখিত-অদৃশ্য পরাধীনতার জাল বিস্তার করা হয়- যার ফলশ্রম্নতিতে পরাধীন মানুষের ক্ষোভ আর অসন্তোষ সময় ও সুযোগের মেলবন্ধনে আগ্নেয়গিরির লাভার মতো ফুঁসে উঠে বিপস্নবে পরিণত হয়। ১৭৭৬ সালের পর আড়াইশ বছর অদ্যাবধি যুক্তরাষ্ট্রকে রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোয় হাত দিতে হয়নি, ১৪ পৃষ্ঠার সংবিধানেও আনতে হয়নি তেমন কোনো পরিবর্তন। সেখানকার শক্তিশালী গণতন্ত্র কখনো ফ্যাসিবাদকে জেঁকে বসতে দেয়নি, কোনো সরকারকে বিপস্নবের মুখে লাঞ্ছিতও হতে হয়নি। কিন্তু জাতি হিসেবে আমাদের দুর্ভাগ্য যে, স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময় বা পরবর্তী তেপান্ন বছরের অধুনা ইতিহাসে কোনোকালেই আমরা জনদরদি সরকার পাইনি। ক্ষমতালোভী বেশিরভাগ সরকারকে উৎখাত করতে রাজপথে ঝরাতে হয়েছে বহু রক্ত। ২০২৪-এর জুলাই বিপস্নবেও প্রায় সহস্র তাজা প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশের মানুষ অর্জন করেছে দ্বিতীয় স্বাধীনতা। কিন্তু কথায় আছে, স্বাধীনতা অর্জন অপেক্ষা রক্ষা করা বেশি কঠিন। একইভাবে বিপস্নব আর সরকার পরিচালনা এক কথা নয়। তাই বাংলাদেশকে আর পথ হারাতে দিতে না চাইলে ছাত্র-জনতার এই বিপস্নবকে সফল ও দীর্ঘস্থায়ী করা এখন সময়ের দাবি। 'বৈষম্যহীন' এবং 'সংস্কার' এই বিপস্নবের দুটি মূল প্রপঞ্চ। রোগীর চিকিৎসা অপেক্ষা রোগের চিকিৎসা যেমন জরুরি, তদ্রূপ বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় নতুন পাত্রে পুরাতন মদ না চাইলে অবিলম্বে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থাসহ যাবতীয় ক্ষমতা কাঠামোয় জনবান্ধব সংস্কারকে গুরুত্ব দিতে হবে। গুরুত্ব দিতে হবে। আশার কথা হলো টেকসই গণতন্ত্র, সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতি-শোষণমুক্ত দেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে অন্তর্র্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য জনপ্রশাসন, বিচার প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও দুদক- এই চার প্রতিষ্ঠানের সংস্কার জরুরি। দেশে প্রকৃত ক্ষমতার চর্চা হয় নির্বাচিত সাংসদ এবং তাদের অধীনস্থ আমলাদের দ্বারা। ক্ষমতার সংস্কারে তাই ক্ষমতাশীল নির্বাচনের পথ ও পদ্ধতির সংস্কার অপরিহার্য। তবে এই সংস্কারকে ফলপ্রসূ করতে সংবিধান ও জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালিবিধির কতিপয় সংশোধন জরুরি। সুযোগ যেমন মানুষকে চোর বানায়, তদ্রূপ জাতীয় নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা রাজনৈতিক দলগুলোর ফ্যাসিস্ট হওয়ার পথ তৈরি করে। ভোটের নির্বাচনে দলগুলোর মাঝে সমানুপাতিক ব্যবস্থা প্রবর্তিত হলে কোনো দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। উপরন্তু সংসদ অধিকতর প্রতিনিধিত্বশীল হবে, বিরোধীদলগুলোর উপস্থিতি সংসদকে প্রাণবন্ত করে তুলবে। সংসদীয় কমিটিগুলোতে বিরোধী দলের উপস্থিতি নানাবিধ কার্যক্রমের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা আনয়নে নিশ্চায়কের ভূমিকা পালন করবে। নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন-২০২২ পরিবর্তন করে সার্চ কমিটিতে বিরোধীদলকে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। নির্বাচন চলাকালে নির্বাচনকে জেলা প্রশাসনের আওতায় না রেখে ডি-ফ্যাক্টো এডমিনিস্ট্রেশনের আওতাভুক্ত করা উচিত। নির্বাচন কমিশনের অধীনে নিজস্ব আইন প্রয়োগকারী সংস্থা গঠিত হলে রাজনীতির প্রভাবমুক্ত হয়ে আপদকালীন সহিংসতা, হয়রানি, হত্যা প্রতিরোধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। ২০২৩ সালের নির্বাচনী আইন ও বিধি সংস্কার করে নির্বাচনের আগের দিন প্রার্থীর মৃতু্য ব্যতীত সমগ্র নির্বাচনী এলাকার ভোট স্থগিত বা বাতিলের খর্বিত ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত। ১৯৭২-৭৩ সালের তৎকালীন পশ্চাৎপদ নারী সমাজ ও সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সৃষ্ট সংরক্ষিত নারী আসন বিলুপ্ত করে যৌক্তিক প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করা উচিত। সেক্ষেত্রে অধিকার এবং কর্তব্য সচেতন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নারী সমাজের ক্ষমতায়ন এবং সাংসদ হিসেবে অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরির লক্ষ্যে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থিতা বাছাইয়ে ন্যূনতম ৩৩ শতাংশ আসনে নারীদের মনোনয়ন দিতে হবে। সর্বোপরি, জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিতকরণে এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নিরীক্ষকগণের সুবিধার্থে ভোট গণনায় ফটো কুইক কাউন্ট প্রক্রিয়া ব্যবহার করা যেতে পারে। সংবিধান অনুযায়ী সরকারের নির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগের মাধ্যমে ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নীতি স্বীকৃত থাকলেও প্রধানমন্ত্রী অতিমাত্রায় ক্ষমতা ভোগ করেন- যা রাষ্ট্রীয় শাসনে সংকটের মূল কারণ। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি একমাত্র পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ভোগ করে থাকলেও যে কোনো অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নিম্নকক্ষ হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভের সম্মতি এবং সিনেটের অনুমোদনের ওপর নির্ভরশীল থাকেন। কাজেই বিশ্বের পরাশক্তি রাষ্ট্রটির সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রেসিডেন্ট চাইলেও দেশটির প্রভুময় শাসক হয়ে উঠতে পারেন না। বাংলাদেশেও আইন প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রাষ্ট্রের দুটি কক্ষ দ্বারা নির্ধারিত হওয়া উচিত। সেক্ষেত্রে নীতি-নির্ধারণ ও আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে একটি কক্ষ জনপ্রতিনিধি, আর অপর পক্ষে সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, ব্যবসায়ী এমনকি কৃষক-শ্রমিকের প্রতিনিধিত্ব বিধান করা যেতে পারে। সেইসঙ্গে নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা কমিয়ে আইন বিভাগের কাছে দায়বদ্ধতার বিষয়টিতে আরও গুরুত্বারোপ করতে হবে। সংবিধানের ৭০নং অনুচ্ছেদ বাতিল করে নিজ দলের বিপক্ষে ভোট প্রদানের স্বাধীনতার মাধ্যমে জনবান্ধব সাংসদদের জনঅধিকার বাস্তবায়নের সুযোগ নিশ্চিত করা জরুরি। সুপ্রিমকোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি নিয়োগ কমিটিতে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি এবং বিরোধী দলের সমন্বয় ঘটানো উচিত। বিচারপতি অপসারণের ক্ষেত্রে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। সরকার পরীবর্তনের সঙ্গে যেই দেশের বিচারপতিরা স্বেচ্ছা অবসরে যেতে বাধ্য হন, সেই ব্যবস্থার ওপর আস্থা রাখা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জার। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে রাজনীতিবিদ, আমলা ও ব্যবসায়ী শ্রেণি 'কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের' ক্ষেত্রে প্রবল অপ্রতিরোধ্য হয়ে পরস্পর নিজেদের ব্যবহার করার মাধ্যমে ব্যাপক বৈষম্য-শোষণের রামরাজত্ব কায়েম করে। এককব্যক্তি তিনটি অভিন্ন ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে দেশটির দুর্দশার শেষ থাকে না। ১৯৭৩ সালে সংসদে ব্যবসায়ীদের সংখ্যা ছিল ১৮ শতাংশ- যা দ্বাদশ সংসদে ৬৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ফলস্বরূপ, নীতিনির্ধারণ ও আইনপ্রণয়নে মুনাফাখোর, শোষক শ্রেণি শোষণের রাজত্ব কায়েম করেছে আর অপরদিকে, আমজনতা একের পর এক ব্যাংক, বিদ্যুৎ, শেয়ারবাজার, পরিবহণ, যোগাযোগ, পোশাক, শিল্প-বিনিয়োগ ইত্যাদি খাতে হরিলুটের মচ্ছব দেখেছে। দেশের রাঘববোয়াল ব্যবসায়ী মহলের একচ্ছত্র আধিপত্য ও শোষণের করালগ্রাস থেকে দেশের জনগণকে মুক্ত করতে হবে। দেশের আইন, বিচার বা নির্বাচন ব্যবস্থাসহ যাবতীয় সব সংস্কারের মূলে রয়েছে সংবিধান সংশোধন। ২০২৪-এর জনবিপস্নবের ফসল অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারকে বৈধতাদানসহ রাষ্ট্র সংস্কারকে ফলপ্রসূ করতে অবিলম্বে ডক্ট্রিন অব নেসেসিটির আওতায় সংবিধান সংশোধন করতে হবে। প্রয়োজনে গণপরিষদ কিংবা গণভোটের মাধ্যমে সংশোধিত সংবিধান পাস করাতে হবে। সংশোধনের কার্যকারিতা নির্ভর করবে রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছার ওপর। পরিশেষে যেহেতু সংশোধিত সংবিধানের স্টেকহোল্ডার হবেন রাজনৈতিক দলগুলো- তাই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দায়িত্ববোধ ও মালিকানাবোধ তৈরি করা জরুরি। এ লক্ষ্যে সংবিধান সংস্কার প্রক্রিয়ায় তাদের অন্তর্ভুক্ত করা অত্যাবশ্যক। পালস সার্ভে-২০২৪ শীর্ষক বিআইজিডি জনমত জরিপ অনুযায়ী, দেশের ৭১ ভাগ মানুষ মনে করছে দেশ সঠিক পথে চলছে এবং ৮১ ভাগ মানুষ চায় যে, দেশ সংস্কারের জন্য যতদিন দরকার ততদিন ক্ষমতায় থাকুক অন্তর্র্বর্তী সরকার। জনগণের এই একনিষ্ঠ সমর্থনকে সমুন্নত রাখতে বর্তমান সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হলো জনগণসহ সব রাজনৈতিক পক্ষের মধ্যে ঐক্য বজায় রেখে রাষ্ট্র সংস্কারের চেতনাকে বাস্তবায়ন করা। ২০১১ সালে তিউনিসিয়ায় জেসমিন বিপস্নব বা বসন্ত বিপস্নবের মাধ্যমে স্বৈরাচার বেন আলীর পতন হয়েছিল ঠিকই কিন্তু অপরিবর্তিত ছিল তাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা। তাদের সেই বিপস্নব বেহাত হয়ে পুনরায় জেঁকে বসেছে কাইস সাইদের মতো নতুন এক স্বৈরাচার। বাংলাদেশকেও তিউনিসিয়ার ভাগ্যবরণ থেকে বাঁচাতে চাইলে শুধু সংস্কারের রূপরেখা প্রণয়নই যথেষ্ট নয়, সেই সঙ্গে প্রয়োজন সব উদ্যোগের সফল বাস্তবায়ন। অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার জুলাই বিপস্নবকে মূল্যায়ন করবে, মানুষের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে এনে দেশের মানুষকে উপহার দেবে উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ; এটাই এখন প্রাণের দাবি। মো. আব্দুর রাজ্জাক : শিক্ষক ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী