রোহিঙ্গা নিগৃহীত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী

প্রকাশ | ১৯ মে ২০১৯, ০০:০০

মু. হামিদুর রশিদ জামিল শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
রোহিঙ্গাকে ঐতিহাসিকভাবে আরাকানী ভারতীয়ও বলা হয়ে থাকে। রোহিঙ্গা হলো পশ্চিম মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের একটি রাষ্ট্রবিহীন ইন্দো-আর্য জনগোষ্ঠী। ২০১৬-১৭ মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের পূর্বে অনুমানিক ১ মিলিয়ান রোহিঙ্গা মিয়ানমারে বসবাস করত। অধিকাংশ রোহিঙ্গা ইসলাম ধর্মের অনুসারি যদিও কিছু সংখ্যক হিন্দু ধর্মের অনুসারিও রয়েছে। ২০১৩ সালে জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের বিশ্বের অন্যতম নিগৃহীত সংখ্যরলঘু জনগোষ্ঠী হিসেবে উলেস্নখ করেছে। ১৯৮২ সালের বার্মিজ নাগরিকত্ব আইন অনুসারে তাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করা হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্যমতে, ১৯৮২ সালের আইনে "রোহিঙ্গাদের জাতীয়তা অর্জনের সম্ভাবনা কার্যকরভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। ৮ম শতাব্দী পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের ইতিহাসের সন্ধান পাওয়া সত্ত্বেও, বার্মার আইন এই সংখ্যালঘু নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীকে তাদের জাতীয়তা নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করছে।" এ ছাড়াও তাদের আন্দেড়েনের স্বাধীনতা, রাষ্ট্রীয় শিক্ষা এবং সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রোহিঙ্গারা ১৯৭৮, ১৯৯১-১৯৯২, ২০১২, ২০১৫ ও ২০১৬-২০১৭ সালে সামরিক নির্যাতন এবং দমনের সম্মুখীন হয়েছে। জাতিসংঘ ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর চড়োনো দমন ও নির্যাতনকে জাতিগত নির্মূলতা হিসেবে আখ্যা দিয়েছে; যেখানে গণহত্যার মতো অপরাধের তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যেতে পারে। জাতিসংঘে নিযুক্ত মিয়ানমারের বিশেষ তদন্তকারী ইয়াংহি লি বিশ্বাস করেন, মিয়ানমার পুরোপুরি তাদের দেশ থেকে রোহিঙ্গাদের বিতড়িত করতে চায়। ২০০৮ সালের সংবিধান অনুসারে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এখনো সরকারের অধিকাংশ বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে থাকে- যার মধ্যে অন্তুর্ভুক্ত রয়েছে স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও সীমান্তবিষয়ক মন্ত্রণড়েয়া। সেনাবাহিনীর জন্য সংসদে ২৫% আসন বরাদ্দ রয়েছে এবং তাদের মধ্য থেকে একজন উপরাষ্ট্রপতি থাকবেন। জাতিসংঘের তদন্তের প্রতিবেদন অনুসারে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের ভেতরে অতি জাতীয়াতাবাদী বৌদ্ধদের দ্বারা ঘৃণা এবং ধর্মীয়া অসহিষ্ণুতার শিকার হচ্ছে। একই সঙ্গে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যা, অবৈধ গ্রেপ্তার, নির্যাতন, ধর্ষণ এবং অপব্যবহারের শিকার হওয়ার পাশাপাশি তাদের জোরপূর্বক শ্রমে বাধ্য করছেন। জাতিসংঘের মতানুসারে, রোহিঙ্গাদের ওপর চলা এ নির্যাতনকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বলা যেতে পারে। বিবিসি জানিয়েছে, ২০১৫ সালের রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট এবং ২০১৬ ও ২০১৭ সালের সেনাবাহিনীর অভিযানের পূর্বে মিয়ানমারে ১.১ থেকে ১.৩ মিলিয়ান রোহিঙ্গা বাস করতেন। যাদের অধিকাংশের বাসস্থান ছিল মূলত ৮০-৯৮% রোহিঙ্গা অধু্যষিত রাখাইন রাজ্যে।. ৯০০,০০০ লক্ষ্যেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে দক্ষিণ-পূর্বের পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। এছাড়া অন্যান্য প্রতিবেশী দেশসহ বেশ কিছু মুসলিম দেশে পালিয়ে গিয়েছে। ১০০,০০০-এর বেশি রোহিঙ্গা অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচু্যত হয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী নিয়ান্ত্রিত ক্যাম্পে রয়েছে। ২৫ আগস্ট ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলায়া ১২ জন নিরাপত্তা কর্মী নিহত হওয়ার পর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে "ক্লিয়ারেন্স অপারেশন" শুরু করে। এই অপারেশনে ৪০০-৩০০০ রোহিঙ্গা নিহত হন, অনেক রোহিঙ্গা আহত, নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হন। তাদের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয় এবং ৪০০,০০০ (মিয়ানমারের রোহিঙ্গার ৪০%) এর বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। ১৮৯১ সালে ব্রিটিশদের করা এক আদমশুমারিতে দেখা যায়া, আরাকানে তখন ৫৮,২৫৫ জন মুসলিম ছিল। ১৯১১ সালে এ সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১৭৮,৬৪৭ জন হয়। অভিবাসনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ বাংলার সস্তা শ্রম যা আরাকানের ধান ক্ষেতের কাজে লাগত। বাংলার এই অধিবাসীরা (বেশিরভাগই ছিল চট্টগ্রাম অঞ্চলের) মূলত আরাকানের দক্ষিণেই অভিবাসিত হয়েছিল। এটা নিশ্চিত যে, ভারতের এই অভিবাসন প্রক্রিয়া ছিল পুরো অঞ্চল জুড়ে, শুধু আরাকানেই নয়। ২০০৫ সালে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক কমিশনের কমিশনার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু মিয়ানমারে অবস্থিত রোহিঙ্গা শিবিরেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে সে চেষ্টা বাতিল হয়ে যায়। ২০১২ সালে রাখাইন রাজ্যে দাঙ্গার পরও ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১৪০,০০০ রোহিঙ্গা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ শিবিরে বসবাস করত। জাতিসংঘের বেশ কিছু চেষ্টার পরও বাংলাদেশে শরণার্থী হয়ে আসা রোহিঙ্গারা ২০১২ সালের দাঙ্গার পর নির্যাতনের ভয়ে আর ফিরে যেতে চাননি। বাংলাদেশ সরকারও সে সময়া রোহিঙ্গাদের জন্য বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছিল ভবিষ্যতে রোহিঙ্গারা যাতে অনুপ্রবেশে উৎসাহ না পান। ২০০৯ সালের ফেব্রম্নয়ারিতে মলস্নাক্কা প্রণালিতে ২১ দিন সাগরে ভাসার পর অনেক রোহিঙ্গাকে সে সময় স্থানীয়া জেলেরা উদ্ধার করেছিল। হাজার হাজার রোহিঙ্গা থাইল্যান্ডেও আশ্রয় গ্রহণ করে। তবে অভিযোগ রয়েছে থাইল্যান্ড থেকে রোহিঙ্গাদের পুনরায় নৌকায় করে খেড়ো সাগরে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিল। ২০০৯ সালের ফেব্রম্নয়ারিতে ১৯০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে থাই সেনাবাহিনী সাগরে ভাসিয়ে দেয় বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। ইন্দোনেশিয়ার কর্তৃপক্ষের কাছে উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গারা বলেছেন, তাদের থাই সেনাবাহিনী ধরেছিল এবং নির্যাতন করে পুনরায় খেড়ো সাগরে ভাসিয়ে দেয়। ২০০৪ সালে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে: রোহিঙ্গাদের চলাচলের স্বাধীনতা ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রিত এবং তাদের অধিকাংশের বার্মার নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছে। তাদের ওপর বিভিন্ন রকম অন্যায় ও অবৈধ কর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। তাদের জমি জবর-দখল করা, জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা, ঘরবাড়ি ধ্বংস করা এবং বিবাহের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। লন্ডনের কুইন ম্যারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক স্টেট ক্রাইম ইনিশিয়েটিভ কমিটির গবেষকরা বলেন, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের গণহত্যা করে দেশ থেকে বিতাড়িত করার শেষ পর্যায়ে রয়েছে। ২০১৬ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নির্মূল করা হচ্ছে বলে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। ২০১৬-১৭ মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতন বা নিপীড়ন বলতে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী এবং পুলিশের দ্বারা দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয়া রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর চলমান সামরিক অভিযানকে বুঝানো হয়া। এটি ২০১২ সালের অক্টোবরে অজ্ঞাত বিদ্রোহীর দ্বারা বার্মা সীমান্তে হামলার একটি প্রতিক্রিয়া ছিল। বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড, গণধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও শিশুহত্যাসহ অত্যধিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ অভিযুক্ত হয়েছে। রোহিঙ্গা জনগণের ওপর সামরিক অভিযান জাতিসংঘ (যা 'মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ' হিসেবে চিহ্নিত), মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনড়ে, মার্কিন ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট, প্রতিবেশী বাংলাদেশ সরকার এবং মালয়েশিয়ার সরকার থেকে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। মিয়ানমার সরকার তাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করেছে, যা তাদের বাংলাদেশের অবৈধ অভিবাসী হিসেবে বর্ণনা করেছে। অতি সাম্প্রতিক সহিংসতার আগে, ১৭ মার্চ ২০১৬-তে "এট্রোসিটিজ প্রিভেনশন রিপোর্টে", মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের সারসংক্ষেপ: রাখাইন ও রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঐতিহাসিক উত্তেজনা সংমিশ্রণ, সামাজিক-রাজনৈতিক সংঘাত, আর্থ-সামাজিক অবনয়ান এবং বার্মার সরকার দ্বারা রাখাইন ও রোহিঙ্গা উভয়েই দীর্ঘস্থায়ী প্রান্তিককরণ, রাখাইন রাজ্যের অবস্থা গুরুতর করে তুলেছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দারিদ্র্যতার হার সর্বোচ্চ (৭৮ শতাংশ) এবং দেশটির সব থেকে দরিদ্র রাজ্য। একদিকে যেমন কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বারা বিনিয়োগের অভাবের ফলে জীর্ণশীর্ণ অবকাঠামো এবং নিকৃষ্ট সামাজিক সেবায় পরিণত করেছে, অপরদিকে আইনশৃঙ্খলার অযোগ্যতাগুলি নিরাপত্তাহীনতার দিকে ধাবিত করছে। মি. কবির বলেন, 'এ সমস্যা সমাধানের জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের এনগেইজড (জড়িত) থাকতে হবে। সেটা তৈরি হয়েছে। কিন্তু সেখান থেকে কতটা ফল পেয়েছি সেটি এ মুহূর্তে মূল্যায়ান করা যাবে না।' সাবেক রাষ্ট্রদূত নাসিম ফেরদৌস মনে করেন, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়ে মিয়ানমার যেভাবে টড়েবাহানা করছে তাতে দেশটির ওপর বেশি আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি হয়েছে বলে মনে হয় না। তিনি বলেন, 'বিশ্ব দেখেছে, বিশ্ব শুনেছে। নানা দেশ থেকে নানা ডেলিগেশন এসেছেন এবং দেখেছেন। এটাই আমাদের একমাত্র অ্যাচিভমেন্ট (অর্জন) আমি মনে করি।' বিশ্লেষকরা বলছেন, কূটনৈতিক তৎপরতা যেভাবেই চালানো হোক না কেন, নিকট ভবিষ্যতে রোহিঙ্গা সংকটের কোনো সমাধানের কোনো লক্ষণ তারা দেখছেন না। শিবিরে নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ধর্ষণের শিকার বেশ কিছু রোহিঙ্গা নারী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছে। মংডুর নাইসং এলাকায়া বাড়ি ছিল সড়েমার (ছদ্ম নাম)। তিনিও ধর্ষণের শিকার হন মিয়ানমার সৈন্যদের দ্বারা। জানালেন, স্বামী দুই মাস হলো কাজের খোঁজে গিয়ে এখনো ফেরেনি। 'ধর্ষণের পর মানসিক যে কষ্ট এবং গস্নানি সেটা কাউকে বোঝানো যাবে না'। সেই মানসিক চাপের সঙ্গে যোগ হয়েছে স্বামীর লাপাত্তা হয়ে যাওয়া। এখানে আসার পর তিনি কোনো চিকিৎসা নিয়েছেন? জবাবে জানান, '(স্থানীয়) ক্লিনিকে গেলে তারা ইনজেকশন দিয়েছিল, পরে আবার যেতে বলেছিল কিন্তু আমি আর যাইনি'। মিজ শারমিন বলছিলেন, 'এসব নির্যাতিত নারীদের এখন দরকার কাউন্সেলিং অর্থাৎ মানসিক পরামর্শ। যাতে করে তারা এই ট্রমা থেকে বের হয়ে আসতে পারে। একই সঙ্গে দরকার ফলো-আপ যাতে করে তাদের কোনো শারীরিক অসুবিধা না হয়। কিন্তু সেটা তারা করে না'। সুতরাং, আলোচনার শিকড় হচ্ছে রোহিঙ্গাদের হেয় না করে তাদের প্রতি আমাদের সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকানো। তাহলেই, মুসলমানদের একজনের অধিকার অপরজনের প্রতি নিশ্চিত করার সুযোগ থাকবে।