জলবায়ু পরিবর্তন ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী
বিদ্যমান কৃষিকাজে পরিবর্তন আনতে হবে। বিশেষত দক্ষিণাঞ্চলের জন্য আমাদের লবণাক্ততাসহিষ্ণু শস্য, ফল ও ফসল খুঁজতে হবে। এছাড়াও যেসব অঞ্চলে নিয়মিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে সেসব অঞ্চলে শস্যবীমা খুবই প্রয়োজনীয়। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন সহিষ্ণু শহর গড়ে তোলায় সামগ্রিক দৃষ্টিপাতে দারিদ্র্য নিরসন করা টেকসই উন্নয়নকে এক ধাপ এগিয়ে রাখতে সহায়তা করবে।
প্রকাশ | ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
সুমাইয়া আকতার
জলবায়ু পরিবর্তন উদ্বেগজনক হারে বাড়ায় বদলে গেছে প্রাকৃতিক পরিবেশের স্বাভাবিক ক্যালেন্ডার। সঠিক সময়ে ফলন হচ্ছে না, পানির লবণাক্ততা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, আকস্মিক বন্যা এবং অসময়ে তীব্র দাবদাহ বৃদ্ধির পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি আঘাত করছে দারিদ্র্যসীমাকে। ধনী দেশগুলোতে জলবায়ুগত পরিবর্তন তাদের আর্থসামাজিক অবস্থাকে যতটা না প্রভাবিত করে, ঠিক ততটাই প্রভাবিত করে দরিদ্র দেশগুলোকে অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে। ধনী দেশগুলোতে পরিবর্তনশীল জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য সম্পদ এবং নেটওয়ার্ক এবং অনিয়মিত আবহাওয়ার ঘটনা এবং দুর্যোগ মোকাবিলা করার জন্য আরও স্থিতিস্থাপক অবকাঠামো (যেমন পানির ব্যবস্থা এবং আবাসন) থাকার প্রবণতা রয়েছে। যদিও দরিদ্র দেশগুলোর প্রায় সব সময়ই কম সম্পদ এবং দুর্বল অবকাঠামো থাকে- যা তাদের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের জন্য আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। চরম আবহাওয়ার ধরন, প্রাকৃতিক বিপত্তি এবং খাদ্য ও পানির ঘাটতি দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাসকারী মানুষের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলছে এবং দরিদ্র মানুষের ব্যর্থ ফসল, ধ্বংস হওয়া বাড়ি এবং স্বাস্থ্য সংকট থেকে পুনরুদ্ধার করা তত কঠিন। আমাদের দেশে যারা আয় এবং খাদ্যের জন্য চাষাবাদের ওপর নির্ভর করে, তাদের জন্য প্রভাব বিশেষভাবে প্রকট। দুর্বল ভূমি ব্যবস্থাপনা নীতি এবং টেকসই উন্নয়ন মাটির ক্ষয় ও মরুকরণসহ জমির অবক্ষয় ঘটাচ্ছে- যা জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবকে ত্বরান্বিত করছে। এবং উচ্চ তাপমাত্রা, পরিবর্তিত বৃষ্টিপাতের ধরন এবং বর্ধিত জলের ঘাটতি ভূমির বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে খাদ্য উৎপাদনের অনুপযোগী করে তুলছে। যখন দুর্যোগ আঘাত হানে, তারাই কম শক্তি এবং কম সম্পদের অধিকারী যারা সর্বদাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে তারা দারিদ্র্যকে আরও বাড়িয়ে তোলে, কারণ যারা খরা বা বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাদের অবশ্যই কম দামে তাদের জমি বা গবাদি পশু বিক্রি করতে হবে, কার্যকরভাবে দরিদ্র থেকে ধনীদের কাছে সম্পদ স্থানান্তর করতে হবে। এটি অনুমান করা হয়েছে যে, ২০৩০ সালের মধ্যে, জলবায়ু পরিবর্তন ১২০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষকে দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিতে পারে। আমাদের দেশে জলবায়ুর ঝুঁকি বাড়ায় দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ এখন দারিদ্র্যের শীর্ষ সীমায় এসেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ গরিব হয়ে পড়ছে। ফলে, এসব অঞ্চলে সামাজিক সুরক্ষার কর্মসূচিও বেশি দিতে হচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চলে দারিদ্র্য ও সামাজিক সুরক্ষার আওতা বাড়ার কারণ সম্পর্কে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দক্ষিণাঞ্চলের দারিদ্র্য বাড়ছে। এসব অঞ্চলে লবণাক্ততা বাড়ছে। বিশেষ করে বরিশাল অঞ্চলটি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খুব বেশি আক্রান্ত, মারাত্মক ঝুঁকিতে। জমিতে লবণাক্ততা বাড়ছে, কৃষি উৎপাদন কমছে।
তিনি বলেন, এ অঞ্চল অন্য অঞ্চলের তুলনায় অনুন্নতও। সে কারণে আমরা মনে করি, এসব এলাকায় উন্নয়ন ঘটবে। সব মিলিয়ে এ অঞ্চলটি দরিদ্র অঞ্চল। আবার কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা দরিদ্র অঞ্চল। এখানে প্রাকৃতিক কিছু কারণ আছে। বরিশাল বিভাগ প্রাকৃতিকভাবে ওই ক্যাটাগরিতে পড়ে। সাধারণত যেখানে দারিদ্র্য বেশি, সেখানেই সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বেশি দেওয়া দরকার।
বরিশাল বিভাগে মোট জনসংখ্যার ২৬ দশমিক ৯ শতাংশই দরিদ্র- যা জাতীয় হারের অনেক। জাতীয় পর্যায়ে দারিদ্র্যের হার ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। গ্রামীণ অতি দারিদ্র্যও সবচেয়ে বেশি বরিশালে। ১৩ দশমিক ১ শতাংশ গ্রামীণ অতি দরিদ্র বরিশালে বসবাস করে। এক্ষেত্রে ঢাকা বিভাগের অবস্থা সবচেয়ে ভালো। এ বিভাগে এ ধরনের দারিদ্র্যের হার ১ দশমিক ৯ শতাংশ। গ্রামীণ অতি দারিদ্র্যের জাতীয় হার ৬ দশমিক ৫ শতাংশ।
ব্যক্তিগত ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দারিদ্র্য হ্রাস থমকে গিয়েছে। খাদ্যপণ্যের উচ্চমূল্য বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারগুলোর ওপর প্রভাব ফেলেছে। এ পরিবারগুলো তাদের আয়ের অর্ধেকেরও বেশি খাবারের পেছনে ব্যয় করে। যেহেতু জলবায়ু হলো আবহাওয়ার গড় অবস্থা। বিগত কয়েক বছর যাবত জলবায়ু সংকট সমস্যা দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রকে পুনরাবৃত্তি করছে। যেখানে মানুষ দরিদ্রতার কবল থেকে মুক্তি পেতে চাইলেও পরোক্ষভাবে পুনরায় দরিদ্রতার ভেতরেই আবদ্ধ হয়ে যায়। সহজ ভাষায় বলতে গেলে দরিদ্র থেকে আরও বেশি দরিদ্র হওয়া। মাথাপিছু আয় এবং বিনিয়োগ কম থাকার কারণে পুনরায় দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে পতিত হতে হয়। তাছাড়া যেসব অঞ্চলে জলবায়ুর পরিবর্তন বেশি সেসব অঞ্চল বা এলাকায় দারিদ্র্যের হার থাকে বেশি। আর আমাদের দেশে এই হার বাড়ার উলেস্নখযোগ্য অন্যতম কারণ হলো, পানি সংকট। দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততার সংকট, বরেন্দ্র অঞ্চলে খরা এমনকি পার্বত্য চট্টগ্রামেও পানির তীব্র সংকট। এসব অঞ্চলে মানুষ সুপেয় পানি পাচ্ছে না, চাষাবাদের পানি নেই। এছাড়াও স্থানীয় দুর্নীতি ও সাবেক সরকারের অবকাঠামো ব্যবস্থাও দায়ী। দীর্ঘস্থায়ী দারিদ্র্যের জন্য, সমস্যা যেমন খাদ্য নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সামাজিক গতিশীলতা ব্যাহত করে। তেমনি ভূমিহীনতা বৃদ্ধি বাংলাদেশের দারিদ্র্যের কারণ। অসময়ে কিংবা বারবার প্রকৃতিক দুর্যোগে মানুষ রোগ-বালাই এর শিকার হয়ে উৎপাদন সক্ষমতা ও শ্রমের ক্ষমতা হারাতে বসেছে।
ফলে, বাস্তুচু্যত হচ্ছে অগণিত মানুষ এবং শিশুরাও। বাস্তুচু্যত হওয়ার ঘটনাগুলোর ৯৫ শতাংশই ঘটে বন্যা ও ঝড়ের কারণে। তাই দারিদ্র্য নিরসন প্রকল্পে জলবায়ু পরিবর্তনে মানবসৃষ্ট হুমকিসমূহকে প্রতিহত করতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে। পরিবেশ রক্ষায় রিসাইকেলিং প্রক্রিয়াকে গতিশীল করার পাশাপাশি পলি-ইথিলিনের ব্যবহার কমাতে হবে। ব্যয়বহুল এবং দরিদ্র মানের স্বাস্থ্য যত্ন সেবার কারণে দরিদ্ররা তাদের এলাকায় সঠিক স্বাস্থ্যপরিষেবা অভাবে ভুগছে। বিশেষত বরিশাল বিভাগে দারিদ্র্যপ্রবণতা ও কম ৩৭.৯২ শতাংশ নিরাপদ শৌচাগারের প্রতুলতা বিদ্যমান। তাই নিরাপদ শৌচাগার বিনির্মাণের অন্তরায়গুলোকে অপসারণ করতে হবে।
বিদ্যমান কৃষিকাজে পরিবর্তন আনতে হবে। বিশেষত দক্ষিণাঞ্চলের জন্য আমাদের লবণাক্ততাসহিষ্ণু শস্য, ফল ও ফসল খুঁজতে হবে। এছাড়াও যেসব অঞ্চলে নিয়মিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে সেসব অঞ্চলে শস্যবীমা খুবই প্রয়োজনীয়। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন সহিষ্ণু শহর গড়ে তোলায় সামগ্রিক দৃষ্টিপাতে দারিদ্র্য নিরসন করা টেকসই উন্নয়নকে এক ধাপ এগিয়ে রাখতে সহায়তা করবে।
সুমাইয়া আকতার : কলাম লেখক